বিভীষিকাময় জীবনে নারীরা আশ্রয় খোঁজে সিরিয়ালে

সুচিত্রা সরকার: ইদানিং কথা হচ্ছে সিরিয়াল ‘পটল কুমার’ এর একটি মেয়ে চরিত্র নিয়ে। পটল কুমারের বাবা সুজন কুমারের দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে। বাচ্চা একটি মেয়ে, ধীরে ধীরে খলচরিত্র পেয়ে গেল। সবাই ছিঃ ছিঃ করছেন, এতো ছোট শিশুটিকে দিয়ে এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করানো নিয়ে। কিন্তু আমরা কি মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে জুজু দেখে ভয় পাচ্ছি না?

মেয়েটি আগে এমন ছিল না। অতোটা খারাপ নয়! যেই দেখলো মেয়েটির বাড়িতে মেয়েটির স্নেহের কোলে অন্য কেউ ভাগ বসিয়েছে, তখনই মেয়েটি পাল্টে গেছে। শিশুদের মধ্যে এমনিতেই এক ধরনের কমপ্লেক্স কাজ করে। বাবা-মা কাকে বেশি ভালবাসে! সেটা বেশি হয়, কোনো পরিবারে বড় সন্তানের অনেক বছর পর আরেকটি সন্তান হলে! শিশুটির মধ্যে তখন অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়।

Serial 1অদ্ভুত ব্যাপার! সকলেই বলছে, ভিলেন শিশুটির কথা। কিন্তু কেউ বলছে না, শিশুটি এমন পরিবেশে কেন বড় হবে, সেই কথা! কেন সুজন কুমারকে দুই বিয়ে করতে হবে (হয়তো সেটাও দেখানো হয়েছে, কোনো নারীর ষড়যন্ত্রে! জানা নেই আমার!)। দ্বিতীয় স্ত্রীর সামনে প্রথম স্ত্রীর বেনারসি ধরে হাউমাউ কান্না জুড়তে হবে?

যে মেয়েটা প্রতিদিন শ্বশুড়বাড়িতে তার অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে, সেই বাড়িতে সতীনের ভূতকেও নারীরা ভয় পায়! আর পটলকুমারের বোনটা তো শিশু! ভয় পাবেই!
এক সময় খুব ‘তোমায় আমায় মিলে’ দেখতাম। শুনেছি নামটা ঋতুপর্ণের দেয়া। দেখার অন্যতম কারণ উশষীর বুদ্ধিমত্তা। পুলিশ অফিসার মেয়ে সমাজে কটা দেখা যায়? ওমা, দেখতে দেখতে চালাকিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। পনের দিন দেখলাম উশষীর শাশুড়ি উশষীকে পরীক্ষায় ফেলেন। দাঁত মুখ খিঁচে উশষী সেই পরীক্ষায় পাশ দেন। শাশুড়ি উপহার দেন তৎক্ষণাৎ! স্বামীর মুখ উজ্জ্বল। পনের দিন বাদে আবার! হয় স্বামী বিগড়ায়, নয় শাশুড়ি। কাঁহাতক ভাল লাগে? বাদ দিলাম দেখা!

গ্রামে আগে রাত নামতো সন্ধ্যে হলেই। এখন মাসি, মামীরা- কিরণমালা, কৃষ্ণ, মহাভারত দেখে ঘুমাতে যায়! যেদিন বিদ্যুৎ থাকে না, মাসির মাথা ধরে!
কারণটা ‘কিরণমালা’, ‘বোঝেনা সে বোঝেনা’- আরো যেসব আছে, সেগুলোর নির্মাণ গুনে নয়! ওরা এতো ভালো বানায় না যে, আমার দেশের নাটক, নাচ গান, সংবাদ বাদ দিয়ে সেসব দেখতে হবে।

কারণটা সিরিয়ালের গল্প। কাহিনী। ভূতু সিরিয়ালটা একটা বাচ্চা ভূতকে নিয়ে। মজারই হওয়ার কথা। কিন্তু সেই মজা কতদিন দেখা যায়? এবার এই সিরিয়ালেও দেখি একই মসলা পড়লো। ভূতুর বাড়িতে যেসব ভাড়াটিয়াই আসে, সবার পরিবারেই একজন বা দুজন করে মেয়ে থাকে, যারা খল। যারা শাশুড়ী বা ননদ। তো, ভূতু ম্যাজিক দিয়ে তাদের পাল্টে দেয়। যে মেয়েটির বিভীষিকার জীবন, সেখানে আসে প্রশান্তি!

Suchitra Sarkerমেয়েরা তাই দেখে! নারীরা তাই দেখে। অবলারা তাই দেখে! বিবাহিতারা তাই দেখে। তারা চায়, কোনো এক ভূতু তাদের জীবনও ম্যাজিক করে পাল্টে দেবে।
বাংলার প্রত্যেক ঘরের, প্রত্যেকটি বউ অন্য বাড়ি থেকে আসে। আসতে হয়। মানিয়ে-গুছিয়ে নেয়। নিতে হয়! ফেরার রাস্তা বন্ধ! আসবার আগে বাবা কন্যাকে দান করে দিয়েছে। মা কড়ে নখ দাঁতে কেটেছে। মেয়ে বলেছে, তোমার সব ঋণ শোধ করলাম! তাই ফিরে যাবার জায়গাটি বন্ধ!

নতুন বাড়িতে মেয়েটি পরীক্ষায় পাশ করে একা একা। পরীক্ষক অনেক। গভীর রাতে যে ছেলেটির শয্যাসঙ্গী হয় মেয়েটি, দিনে মেয়েটিকে চেনে না ছেলেটি। (বারবনিতা কিন্তু নয় মেয়েটি!) তাতে ছেলেটির, পুরুষটির বিরাট সুবিধা। ভালো থাকা যায়! সবদিক থেকেই।

মা গর্ব করে বলে, আমার ছেলে বউ নেওটা নয়। স্ত্রৈন নয়! পুরুষসিংহ। বীরপুরুষ! রবীন্দ্রনাথ বীরনারীর কবিতা লেখেননি, তলোয়ার উঁচিয়ে যে মাকে বাঁচায়। এটাই পুরুষের তৃপ্তির জায়গা! তাই এক জীবনের গাছ, মাছ, পাখি, আকাশ ছেড়ে এসে মেয়েটি টিকে থাকে অন্য আকাশে, অন্য হাওয়ায়। হাসি দিয়ে, ডিনারে স্পেশাল ডিশ দিয়ে, মাদার তেরেসার ক্ষমতা দিয়ে! সব মেয়ের গল্প এটা।

তাই মেয়েরা যখন গল্প করে, সেখানে তারকোভস্কি, হকি, ক্রিকেট আসে না। বোমা হামলায় ক’জন মরলো, তার তাতে কী! দিন দিন মেয়েটি মরছে কোনো না কোনো বোমা হামলায়! সবার অলক্ষ্যে!

তাই শাশুড়ির অলক্ষ্যে, ননদের, স্বামীর, শ্বশুর বাড়ির অলক্ষ্যে সেও বিড়বিড় করে। নিজের সঙ্গে। পাশের বাড়ির আরেক ‘না ফোঁটা কলি’র সঙ্গে। সেই বিষন্নতা কাটানোর কৌশলটারই নাম হয় কুটনামী। সেই আড্ডায় সমস্যার সমাধানের নাম ‘কানপড়া’ দেওয়া। সেই মেয়েরা যদি দেখে, ওদের জীবনের কথা, লড়াইয়ের কথা, গুমড়ে মরার কথা- সিরিয়ালে পাওয়া যাচ্ছে, দেখবে না কেন? আগে লাইন ধরে উঁকুন বাছতে বাছতে যে গল্প নিজেরা করতো, সেই গল্প আজ স্টার জলসা করছে। মেয়েরা শুনছে।

সিরিয়াল দেখতে দেখতে আমি অনেক মেয়েকে অঝোরে কাঁদতে দেখেছি। যেমন দেখেছি আব্বাস কিরোস্তামির ‘শিরিন’ (২০০৮) সিনেমায়। শিরিনের কাহিনি শিরি ফরহাদের প্রেম নিয়ে। এই প্রেমের গল্পটির সিনেমা দেখছে অনেক নারী দর্শক। এটাই পুরো সিনেমা। ছবির সাউন্ড ট্র্যাকের সঙ্গে নারী দর্শকরা হাসেন, কাঁদেন, উদ্বেলিত হন।
কিরোস্তামী বলেন, শিরিন ছবিতে নারী দর্শকদের কান্না শিরিনের জন্য নয়। নারীরা নিজের জীবনকেও দেখতে পান শিরিনের মধ্যে।

তো, ভুলটা কোথায়! সমাজটা পাল্টাক! সিরিয়াল পাল্টে যাবে। পুরুষরা সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে সরে আসুক! উশষীর শাশুড়িকেও আর তখন পরীক্ষা নিতে হবে না।

পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নারীর পক্ষে নির্মাণ হোক! এসব বস্তাপঁচা সিরিয়ালের তখন দরকার হবে না! নারীরাও তখন ক্রিকেট, আবাহনী, মোহনবাগান, শেয়ার বাজার আর দেশের অর্থনীতির পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে মাথা ঘামাবে! তার আগে নয়!

২৪.৮.২০১৬
দারুস সালাম, ঢাকা

শেয়ার করুন:

আমার বউ যখন সিরিয়াল দেখতে বসে,তখন রান্নাবান্নার কাজটাও আমার করতে হয় । প্রায় প্রতিদিন আমার রান্না করতে হয় । এমনকি কাপড় কাচাটাও । রান্না রেডি গোসল করে খতে বসবে ? না,আগে সিরিয়ালটা শেষ হওয়া চায়,এদিকে আমার পেট ক্ষিদেই খাওমাও করে । কিছু বলতে গেলেই ঝগড়া,কথা কাটাকাটি কার ভালো লাগে,তাই নিরবে হজম করে যাচ্ছি দিনের পর দিন । কারো কাছে অভিযোগ করার নেই, এইসব কাহিনী কোন সিরিয়াল বা সিনেমাতেও নেই যেটা দেখে আমি আমার মনের তৃপ্তি মিটাবো । আমি নারী বিদ্বেশী কথা বলছি না । আমার সয়ে যাওয়ার কথা বলছি । কিছু বললেই রাগ করবে,ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিবে,কথা বলাও বন্ধ । যদি জোর করি তখন ঝগড়া ঝাটি । আমার আর এইসব ভালো লাগে না । তাই চুপচাপ থাকি একটি দিনের আশায় যে দিন ওর হূঁশ আসবে । মনে মনে ভাবি হয়ত এখনও বোঝেনা,ভবিষ্যতে হয়ত বুঝবে । আমি ওকে অনেক ভালোবাসি,তাই এইসব মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় আমার নেই । আমি পুরুষ,তাই চোখের জল ফেলে কিছুটা হালকা হবো তাও উপায় নেই । চোখে জল আসেনা । আমার ভালোবাসার প্রতিদান কি এভাবেই আজীবন দিয়ে যেতে হবে আমার ? ঐ সিরিয়ালটা কি আমার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে ?