আমরাও কি আত্মহত্যা করেছি?

সাদিয়া নাসরিন: সিমি নামের এক শ্যমলা মেয়েকে চিনতাম আমরা বেশ কয়েক বছর আগে। নারায়ণগঞ্জ চারুকলায় পড়তো মেয়েটা। বিয়ে বাড়িতে আলপনা এঁকে পড়াশোনার খরচ চালাতো… মাঝেমাঝে কাজ শেষ করে ফিরতে রাত হয়ে যেতো। আর প্রতিদিন ঘরে ফেরার পথে বখাটেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করছিলো আমাদের সেই মেঘবতী কন্যা। মারা যাবার আগে সিমি চিরকুটে লিখে রেখেছিলো ছয় বখাটের নাম… তার মধ্যে একজন খিলগাঁও থানার দারোগা বাশার…

Sadia Nasrinখুলনার ফুটফুটে সেই স্কুল ছাত্রী রুমির কথা মনে আছে কারো? বখাটেদের সীমাহীন লাঞ্ছনা আর অপমান সহ্য করতে না পেরে সিলিং ফ্যানে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছিল ফারজানা আফরিন রুমি। মহীমার কথা? বখাটেরা ধর্ষণের পর ভ্রষ্টা হিসেবে ঘোষণা করে একঘরে করেছিল মহিমাকে… মহিমা আত্মহত্যা করে বিদায় দিয়েছিলো এই পৃথিবীকে। স্কুলে যাবার সময় একদল বখাটে কিশোরী সেলিনা আক্তারকে তুলে নিয়ে গিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে…. সেলিনাও করেছিলো আত্মহত্যা।

কোজাগরী পূর্ণিমার এই দিনে নিশ্চয়ই ভীষণ করে মনে পড়ে পূর্ণিমার কথা? সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমাকে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার অপরাধে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা গণধর্ষণ করে। নবম শ্রেণীতে পড়া পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করতে এসেছিলো ১০-১২ জনের একটি দল… এতোটুকুন মেয়েটা এতোজনের অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না দেখে পূর্ণিমার মা কান্না করতে করতে বলেছিলেন, “বাবা’রা আমার মেয়েটা ছোট… মরে যাবে। তোমরা একজন একজন করে আসো।”

বেশ ক’বছর আগে আমরা খুব করে চিনেছিলাম দিনাজপুরের ইয়াসমিন নামের এক কিশোরীকে। রাতের আঁধারে পুলিশ ভ্যানে যাকে গণধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়েছিল। পুলিশ নিরাপদ হেফাজতে নিরাপদে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গিয়েছিল একজন সীমা চৌধুরী? টাঙ্গাইলের গীতিদা রেমা বা খাগড়াছড়ির পণেমালা ত্রিপুরাকেও আমরা খানিকটা চিনতাম বটে!

শাজনীনকে অবশ্য সেদিনই আমরা মনে করেছি, কারণ তাকে হত্যার বিচারের রায় হয়েছে। ধর্ষণ একটি পুরুষতান্ত্রিক হাতিয়ার হওয়ার কারণে প্রভাবশালী-বিত্তশালী পিতার বিত্ত বা প্রভাবও রায়কে প্রভাবিত করতে পারেনি। স্কলাসটিকা স্কুলের নবম শ্রেণীর মেয়ে ছিলো শাজনীন… বয়স মাত্র ১৫ বছর। বাড়ির ঠিকাদার ও তার তিন বন্ধু মিলে শাজনীনকে ধর্ষণ করে হত্যা করে নিজ বাড়িতেই… শাজনীনকে মোট ২০ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিলো… ঘাড়ে বাটালী দিয়ে আঘাত করে করে ফেলা হয়েছিলো ৩ ইঞ্চি গর্ত। কারো মনে পড়ে গাইবান্ধার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী তৃষার কথা? বখাটেদের হাত থেকে বাঁচতে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাওয়া সেই সাঁতার না জানা মেয়েটা? তানিয়া নামের সেই চার-পাঁচ বছরের শিশুটা? সুমাইয়া নামের এক বাচ্চার নামও আমরা জেনেছিলাম কয়েকদিন আগে, ছোট হওয়ার কারণে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে খুন করেছে মৌলভী সাহেব! যোনিপথ ধর্ষণের উপযুক্ত না হওয়াই ছিল যার অপরাধ।

না, না, লাঠিয়াল বাহিনীর বিশেষ নিরাপত্তায় নিরাপদে ছিন্ন-ভিন্ন হওয়া তনুর জন্য আজ আর কিছু লিখবো না। লিখবো না ততোধিক নিরাপদ ক্যাডেট কলেজে রেগিং নির্যাতনে নিরাপদে “আত্মহত্যা” করা তুবার কথাও। থাক রাজা-রাজরাদের এলাকার রাজগল্প আজ আমি লিখবো না।

তবু আজ জান্নাতুল নামে এক কিশোরীর কথা লিখতে ইচ্ছে করছে। ষোল/সতের বছর বয়সে পেট ভরে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খাওয়ার জন্য সে এসেছিলো আমাদের এই নগরে। কাজ নিয়েছিল এক নামকরা শিল্পীর বাসায়। যে সে শিল্পী নয়, জাত শিল্পী। তার ওপর মানবতাবাদী। সেই শিল্পীর ঘরে জান্নাতুল নাকি এক দুপুরে ভাত রাঁধতে ভুলে গিয়েছিল। শিল্পীর তাতে বেজায় রাগ হলো আর জান্নাতুলকে একটু বকুনি (?) দিলেন। আর বেআক্কেল জান্নাতুলটা সোজা গিয়ে ঝুললো ফাঁসির রশিতে!! পাগলামতো মেয়েটা ফাঁসিতে ঝুলতে ঝুলতে কেন আমাদের জামাইবাবুকে এমন করে খামচে-খুমচে আদর করে দিলো কে জানে!!

আর আফসানা? আহা আফসানা ! না না, কেউ মারেনি তাকে। “শফিউজ্জামান” রোগে আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করলো মেয়েটি। নিজের ঘর ছেড়ে, হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে গিয়ে!! কোনো এক রাতে তার ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ ডাক শুনেছিল কেউ কেউ। টেনে হিঁচড়ে টেনে নিতেও দেখেছে কেউ কেউ। তবু বাঁচেনি আফসানা। এই নাগরিক জীবনে কেউ কাউকে বাঁচায় না, সবাই নিজের জন্য বাঁচে।

চলো এবার কিছুদিন আফসানার জন্য চিৎকার করি। আজ আফসানা, কাল তনু, পরশু সুমাইয়া…. বিচার চাই, বিচার চাই বলে চেঁচিয়ে গলা ফাটানো ছাড়া তো আমাদের আর কোনো কাজ-কাম নাই। আমাদের কন্যারা, বোনেরা একে একে ধর্ষিত হোক, ক্ষত-বিক্ষত হোক, নগ্ন হোক, লাশ হয়ে পড়ে থাকুক ঝোঁপে-জঙ্গলে অথবা এক থানা হেফাজত থেকে অন্য মর্গে, আর আমরা মোমবাতি হাতে বসে থাকি কামদাপ্রাসাদ এর “ইন্টারকোর্স” তত্ত্ব আর শফিউজ্জামানের “আত্মহত্যা” সার্টিফিকেট নিয়ে ঘরে ফিরে যাবো বলে।  

ইয়াসমিন থেকে আফসানা। খরচযোগ্য জীবন দিয়ে ওরা আমাদের বিবেকের দরজায় লাত্থি মেরে যায়। আমরা তাড়িত হই, আওয়াজ তুলি, পথে নামি। কিছুদিন বিচার বিচার খেলা চলে, কামদাপ্রাসাদ আসে, সফিউজ্জামান প্রতিবেদন দেয়, আর আমাদের কন্যারা আত্মহত্যা করতে থাকে। আমাদের কন্যাদের পঁচে গলে যাওয়া দেহে “সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স” এর সীল পড়ে যায়। আর আমরা নীরবে ঘরে ফিরে ভরপেট ভাত খাই, সঙ্গম করি, আরো আফসানা জন্ম দিতে থাকি। তারপর অপেক্ষায় থাকি আবার নতুন কোন আফসানা ধর্ষিত হবে, অতঃপর লাশ এবং আত্মহত্যা।

এরপর হয়তো আমারই আত্মজ…এক একটা শঙ্কা ও বেদনার দিন গুনে যাওয়া কেন আমাদের? আমরা কী জেনে যাইনি এখনো, এই অক্ষম আক্রোশে নিস্ফল বেদনা ও অশ্রু দিয়ে আর যাই হোক, শঙ্কা মোচন সম্ভব নয়? তবে কেন এখনো এই নীরবতা আর শোকগাঁথা? কার স্বার্থে এই নীরবতা? তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই সবুজ বাংলাদেশের সাড়ে চার দশকে নারীর সম্ভ্রম ও প্রাণহানির এই বিপুল সংখ্যাও কেন আমাদের দুর্বার করে তুলছেনা? আমরা ও কী তবে আত্মহত্যা করেছি?

….এখন, এখনও যদি ঘরে বসে নিজেকে বাঁচাই

যদি বাধা না দিই, তত্ত্ব করি কী হলো কার দোষে

যদি না আটকাই, আজও না-যদি ঝাপিয়ে পড়তে পারি

আমার সমস্ত শিল্প আজ থেকে গণহত্যাকারী … (জয় গোস্বামী)

শেয়ার করুন: