শিল্পী জলি: বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে কিছু বিষয় আছে যার ওপর এক কলম লিখতে গিয়ে দশ বার ভাবতে হয়, নইলে হয়তো জান নিয়ে দৌড়েও কূল পাওয়া যায় না। আর তিনি যদি লেখক না হয়ে লেখিকা হন, তাহলে তো কথাই নেই।
তাই দেশে মেয়েরা লিখতে গেলে সভ্য বিষয়, সভ্য শব্দ, পরোক্ষ ভাষা, ইশারা-ইঙ্গিতে গভীর বিষয়ের উপস্হাপনা, নানাবিধ উপমা ইত্যাদি ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো সামাজিক ইস্যুকে উপস্হাপনের চেষ্টা করেন, যেন কেউ ঝাঁপিয়ে না পড়ে।
তারপরও কি শেষ রক্ষা হয় ?
সভ্যতা রক্ষা কি শুধু ভাষা দিয়ে হয়?
সেদিন ভারতের সত্যি ঘটনার উপর একটি রিপোর্ট দেখলাম– এমনই হৃদয় বিদারক ঘটনা যে সীমারের মত কঠিন চরিত্রের মানুষেরও চোখ গড়িয়ে পানি নামবে–
পাঁচ বছরের একটি মেয়েকে রেপ করা হয়েছিল। মেয়েটি কিশোরী হতে না হতেই তাকে অপদার্থ শ্রেণীভুক্ত করে তার নিজেরই বাবা এবং ভাই দিনের পর দিন রেপ করতে থাকে। তারা মাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দরজা আটকে দিয়ে হুমকি দেয়, পুলিশে রিপোর্ট করলে মা-মেয়ে দু’জনকেই মেরে ফেলবে।
মা উপায় না দেখে একদিন মেয়েটিকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়, এবং নিজে গিয়ে পুলিশে জানায়।
এতো জঘন্য, অবিশ্বাস্য ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ে পুলিশও থমকে যায়। বুঝতে পারে না– কে সত্যি বলছে, আর কে মিথ্যা?
বাবা-ভাই, নাকি মেয়ের মা?
সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় মা-মেয়ে দু’জনেই খুন হয়ে যায় আপনজনের হাতে। অকালে ঝরে যায় দু’টি প্রাণ।
মেয়েটি ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিল আপন মানুষ দ্বারা গর্ভবতী হয়েছে কীনা তা চেক করাতে, কিন্তু বলতে পারেনি–কতোটা ভয়াবহ!
সম্প্রতি এক প্রিয় বন্ধু ফেসবুকে লতাপাতা-নদীনালা নিয়ে পোস্ট দিতে দেখে বললেন, হাইকোর্টের ‘টু-ফিঙ্গার রেপ ভিকটিম টেস্ট পদ্ধতি বাতিলকরণ’ প্রতিবেদনটির উপর যদি লিখি!
প্রতিবেদনটি পড়তেই মাথা একশ-আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল। ঐ মেডিকেল চেকআপ পদ্ধতিটিতে মূলত দেখা হতো যোনিপথের ঘনত্ব এবং হাইমেন ইনজুরড কিনা এবং ইনজুরি থাকলে সেটি ঘড়ির কাঁটার দশ-তিন পজিশনে (ইচ্ছেকৃত মিলন), নাকি পাঁচ-আট পজিশনে (রেপ)?
কথা হলো, কুমারী মেয়ে ছাড়া আর কারও যেন রেপ হয় না! যেসব মেয়ে খেলধূলা এবং একটিভ জীবনযাপন করে তাদের হাইমেন এমনিতেই ছিঁড়ে যেতে পারে। আবার যেসব মেয়ে বিবাহিত এবং সহবাস যাদের জীবনের একটি নিত্য পার্ট, হাইমেন বা সতীত্বের পর্দা বহু আগেই তাদের ছিন্ন হয়ে যায়, তাদের ধর্ষণ করা হলে যোনিপথে ততটা ক্ষতের সৃষ্টি নাও করতে পারে– তাহলে তাদের রেপ কি রেপ নয়?
এতদিন দেশে লক্ষ লক্ষ মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, অথচ তাদের মেডিকেল পরীক্ষা কীভাবে করা হয়েছে, বিচার কীভাবে করা হয়েছে– ভাবতেই অবাক লাগে!
গত ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন অনুসারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে নাকি কোনো নারী চিকিৎসক নেই, কোনো নারী নার্স নেই, কোনো আয়াও নেই। এমনকি নারীর শারীরিক পরীক্ষার জন্যে পৃথক কক্ষও নেই।
বারান্দায় একটি টেবিলের উপর রেপ ভিকটিমকে শুইয়ে খোলা আকাশের নিচে ওয়ার্ড বয়কে ডেকে নাকি মেডিকেল করানো হয়। একবার এক ওয়ার্ডবয় একজন রেপ ভিকটিমের মেডিকেল করতে গিয়ে কাপড় তুলতে যেতেই নাকি সে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে!
কোথায় ভিকটিমের মডেস্টি রক্ষা?
কোথায় ভিকটিমের প্রতি সহানুভূতি?
কোথায় তার আস্থা অর্জন?
কতোটা অমানবিকতা, কতোটা ভয়াবহতা, কতোটা গাফিলতি এবং কতোটা বর্বরতা থাকলে খোলা বারান্দায় রেপ ভিকটিমের মেডিকেল করানো সম্ভব?
আমেরিকায় পথে-ঘাটে মেয়েরা বিকিনি পরে ঘুরে বেড়ালেও রোগীদের সাধারণ ব্রেস্ট এক্সাম, প্যাপ এক্সাম, রেকটাল এক্সাম, প্রোস্টেট এক্সাম সবকিছুই একটি নিরিবিলি রুমে চাদর দিয়ে ঢেকে করা হয়। শুধু তাই নয়, ঐ পরীক্ষার সময় ডাক্তারের সাথে অবশ্যই আরেকজন মানুষ থাকতে হবে। সাক্ষী।
দু’জনের একজনকে অন্তত মেয়ে হতে হবে যদি পেশেন্ট একজন মেয়ে হন। অকারণে পেশেন্টের পুরো শরীর অনাবৃত করা যাবে না। পরীক্ষার আগে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হবে যেন পেশেন্ট হঠাৎ করে আঁৎকে না ওঠেন। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তিটি উপস্হিত থাকলেও অকারণে তাকাবার নিয়ম নেই। সবই করা হয় যেন তাদের আত্মসম্মানবোধ এবং মর্যাদায় আঘাত না লাগে।
অথচ আমাদের দেশে রেপ-ভিকটিম মানেই হয়তো অবজ্ঞা, ক্ষয়ে যাওয়া , সম্মানহীনতা, লজ্জায় মরে যাওয়া, সামাজিকভাবে মেরে ফেলা বই আর কিছু নয় !
একটি সমাজে ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে ঐ সমাজের অবক্ষয়, মানবতার অবক্ষয়, শিক্ষার ব্যর্থতা, ধর্মীয় ব্যর্থতা, পরিবারের ব্যর্থতা, জাতির লজ্জা।
রেপ একটি ক্রাইম–যে ক্রাইমকে মেয়েদের প্রভোকেটিভ পোশাক-আশাক , পেশা-নেশা, বা তেঁতুল-বেতুল দিয়ে ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই।
বিগত বছরগুলোতে রেপ ভিকটিমদের যে পদ্ধতিতে মেডিকেল করা হতো হাইকোর্ট তা বাতিল করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তিন মাসের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনা জমা দিতে বলেছে।
আমেরিকাতে রেপ ভিকটিমদের বিনামূল্যে ফরেনসিকসহ নানাবিধ সুবিধা প্রদান করা হয়। সেই সাথে নানা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাও দেয়া। রেপ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সেল থাকে যা কীনা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে, যারা বিষয়টিকে আদালতে উপস্হাপনযোগ্য হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, ডক্যুমেন্ট তৈরি করেন, এবং ভিকটিমের সর্বপ্রকার প্রশ্নের উত্তরসহ নানাদিক বিচার-বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা নিশ্চিত করে থাকেন। তারা পুলিশকেও অবগত করেন বিষয়টি সম্পর্কে।
রেপ কেসে আগে ভিকটিমের কাছে রেপের বিবরণ শুনে তার মুখ, নখ, বডি, ব্রেস্ট, রেকটাম এবং জেনিটাল এরিয়ার চেক আপ করা হয়। ভিকটিম অনুমতি দিলে শরীরের নানাবিধ চিহ্নের বিবরণসহ ছবিও তুলে রাখা হয়। তার কাপড়চোপড়ের চিহ্ন এবং অবস্হা চেকসহ, শরীরে ফরেন কোন হেয়ার, আঁচড়, কামড়, রক্ত, বা আলামত থাকলে সেগুলোর বর্ণনা এবং নমুনা সংগ্রহ করা হয় টেস্টের লক্ষ্যে। ভিকটিমেরও পিউবিক হেয়ার সংগ্রহ করা হয়।
এছাড়া কখন রেপ হয়েছে, কবে লাস্ট পিরিয়ড হয়েছে, গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা কতটুকু আছে, অথবা গর্ভাবস্থাতেই রেপ হয়েছে কিনা, সম্প্রতি কোন একটিভ সেক্সে মিলিত হয়েছিল কিনা সবকিছুই বিবেচনায় এনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেহেতু স্পার্ম পাঁচদিন পর্যন্ত একজন নারীর শরীরে বেঁচে থাকতে পারে।
রেপের মেডিকেল পরীক্ষায় নানাবিধ ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয় যেন সেগুলো অপরাধীকে শনাক্ত করতে সহায়তা করে।
যদি রেপিস্ট প্রোটেকশন নিয়ে থাকে অথবা তার ভ্যাসেকটমি হয়ে থাকে তাহলে ঐ রেপের মেডিকেল অন্যরকম হয় যেটা ঘটনা শুনে এবং বুঝে চিকিৎসক যথাযথ পরীক্ষা পদ্ধতিটি নির্ধারণ করে থাকেন।
রেপের সাথে জড়িয়ে থাকে ভিকটিমের শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক, এবং মানবিক ক্ষতি। জড়িয়ে থাকে তার ভবিষ্যত জীবন, সুস্হতা, এবং স্বাভাবিকতা ।
রেপের মাধ্যমে এইচআইভি ভাইরাসসহ নানাবিধ সেক্সচুয়াল ট্রান্সমিটেট রোগ ছড়াতে পারে। রেপ হলে গনোরিয়া, সিফিলিস, হারপিস থেকে শুরু করে হেপাটাইটিস বি পর্যন্ত সবকিছু প্রতিরোধের বিষয়টিতেও মনোযোগ দিতে হয়। তাই রেপ হওয়ার সাথে সাথেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভিকটিমের মেডিকেল করানো জরুরি।
রেপের পর তাৎক্ষণিকভাবে প্রেগনেন্সি টেস্ট করে নেগেটিভ রেজাল্ট পেলে ইমাজেন্সি কন্ট্রাসেপশনের মাধ্যমে তার অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেগনেন্সি রোধ করার ব্যবস্হা নেয়া যায়।
ওষুধ দিয়ে নানারকম সেক্সচুয়াল ট্রান্সমিটেট রোগ প্রতিরোধ করার পদক্ষেপ নেয়া যায়।
এইচআইভি ইনফেকশনের আশংঙ্কা থাকলে ৭২ ঘন্টা অতিক্রমের আগে বিশেষ কিছু ওষুধ দিয়ে ইনফেকশন ঠেকাবার চেষ্টা করা যায়। সময়ে যথাযথ পদক্ষেপটি নিতে পারলে নানারকম ভোগান্তি থেকে ভিকটিমকে রক্ষা করা যায়।
তাই রেপ ভিকটিমদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নেবার পরও ছয় সপ্তাহ, তিনমাস, এবং ছয় মাসের কিছু টেস্ট নিশ্চিতকরণ এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরি।
রেপ হলে কোনো মেয়ে কাঁদে, কোনো মেয়ে হাসে, কেউ বেশি কথা বলে, কেউ চুপ থাকে, কেউবা ক্ষণে ক্ষণে ভয় পায়। এসব দেশে বিশেষজ্ঞরা মেডিকেলের সময় এই দিকটিতেও নজর দেন।
রেপ পরবর্তী সময়টিতে অনেকে ঘুমুতে পারে না, ক্ষণে ক্ষণে আত্মহত্যার কথা ভাবে, অনেকে আইসোলেটেড হয়ে যায় এসব নানারকম সমস্যার জন্যে তাদের কাউন্সিলিংয়ের দরকার হয়।
আশা করছি বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবার নতুন প্রস্তাবনাটিতে সবদিক বিচার- বিশ্লেষণ করে পদক্ষেপ নেবেন, যা ভিকটিমকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে সক্ষম হবে।
তার সম্মান, কষ্ট, এবং সমস্যাগুলোকে উপলব্ধি করতে পারবে, তার আস্হা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
সেইসাথে তারা একটি নির্দ্দিষ্ট বয়সসীমা নির্ধারণ করবেন যে বয়স পর্যন্ত একজন মানুষ নাবালক/নাবালিকা হিসেবে গণ্য হবে– যাদের সাথে সম্মতিসূচক সেক্সকেও ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে যদি ধর্ষক পূর্ণ বয়স্ক হয়।
তারা ধর্ষণের মতো ঘটনা নারী-পুরুষ দু’জনার সাথেই হতে পারে বিবেচনায় রেখে ধর্ষণের সংজ্ঞা এবং সাজা’র বিষয়টি প্রস্তাবনা করবেন।
তারা ওষুধ বা নেশার বস্তু সেবন করিয়ে ধর্ষণ করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখবেন।
তারা ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পোশাক, নেশা, পেশা, জীবনযাপন পদ্ধতিকে ধর্ষণের সাথে জড়িয়ে না ফেলার দিকে লক্ষ্য রাখবেন।
সেইসাথে মেডিকেল অগ্রগতির সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনেরও পথটি উন্মুক্ত রাখার প্রস্তাবনা থাকবে।
একটিভ-সেক্স জীবনের একটি পার্ট হলেও ফোর্সড-সেক্স একটি ক্রাইম। ধর্ষণ একটি মেয়ের ব্যক্তিসত্ত্বার ব্যাপক ক্ষতি করে, অধিকার ক্ষুন্ন করে, জীবনকে অনিশ্চিত করে, কিন্তু ধর্ষণ তো ওই মেয়েটির লজ্জা নয়।
তবে সবারই ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায় জানা জরুরি।
ধর্ষণের আশংকা থাকলে চিৎকার করা, লোকালয়ে যাবার চেষ্টা করা,
নিশ্চিত জেতার সম্ভাবনা থাকলে রেপিস্টের চোখ, নাক, গ্রোয়েন এলাকায় তীব্র আঁচড়, চিমটি,কিল, ঘুষি, লাথি, ধাক্কা দিয়ে আঘাত হানা, অস্ত্র দেখলে চুপচাপ আত্মসমর্পণ করা, নিজের শক্তি কম অনুভূত হলে কান্না-অনুনয়-বিনয়, প্রেগনেন্সির অজুহাত, সেক্সচুয়াল ডিজিজের অজুহাত, ধর্মীয় বিধানের কথা বলা, মিথ্যে এইডসের উল্লেখ করা, বমি করা, পুপু করা, ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
এক কথায় রেপের সম্ভাবনা থাকলে লক্ষ্য হবে, যেমন করেই হোক প্রাণরক্ষা করে রেপ প্রতিরোধের ব্যবস্হা নেয়া।
informative.
Good writeup, very informative.