দিলশানা পারুল: না, তনু হত্যার কোনো বিচার হয়নি। আফসানার হত্যারও কোন বিচার হবে না। দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিদ্যমান, তা থেকেই এই উপসংহার টানা যায়। গত এক বছরে ধর্ষণের সংখ্যা কত দাঁড়ালো? তার আগের বছরে কত ছিলো? সংখ্যাতে কী যায় আসে?
পথে কোন মেয়ে নিরাপদ বোধ করি? হিজাব পরা আমেনা থেকে মিনি স্কার্ট পরা ক্রিস্টিনা, কে নিরাপদ? কোথায় নিরাপদ? বড়ি থেকে বের হওয়া থেকে শুরু করে কাজে বা ক্লাস রুমে যাওয়া পর্যন্ত কোথায় মেয়েটিকে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় না? পথে চলেছেন, অথচ কখনো বুকে-পিঠে হাত পড়েনি, এমন মেয়ের সংখ্যা আছে নাকি?
হয় মেয়েটি বলে না, অথবা বলতে জানে না। নারীর কোনো জাত নেই, ধনী-গরিব নেই, গ্রাম-শহর নেই, হিন্দু-মুসলিম নেই, জাত-পাত নেই। নারীর পরিচয়, তার একটি যোনি আছে, যেটি এই প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডে মানব জাতির প্রজনন রক্ষা করে চলেছে।
সমাজ যখন ব্যর্থ হয়, রাষ্ট্র তখন দায়িত্ব নেয়। রাষ্ট্র যখন দায়িত্ব নেয় না, সমাজ তখন আশ্রয় দেয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর সমাজ দুটোই নারীর জন্য কেবল বিপরীত লিঙ্গের আবাসস্থল ছাড়া আর কিছু না। তাহলে কী হবে? কেমন করে হবে?
এক সন্ধ্যার ঘটনা বলি। অফিস থেকে জাহাঙ্গীরনগরের সবচেয়ে নিরিবিলি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। পুরো রাস্তায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। হঠাৎ দেখি একা একটা মেয়ে রিকশা থামিয়ে তিন-তিনটে ছেলেকে ভীষণভাবে শাসাচ্ছ । আমি একটু উদগ্রিব হয়েই কান পাতলাম।
দেখি মেয়েটি বলছে, “ভুলে যাসনে এইটা জাহাঙ্গীরনগর, বেশি বারাবাড়ি করলে …… “ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি উদগ্রিব ছিলাম মেয়েটি কোনো সমস্যায় পড়লো কীনা তাহলে রিকশা থামাবো। কীসের কী! ছেলেগুলোর মুখ ভয়ে শুকিয়ে আছে। এবং ওই দস্যি মেয়ে যে ভাষায় ছেলেগুলোকে শাসাচ্ছিলো তাতে ওর পাশে আসলে আর কাউকেই লাগতো না।
রিক্সা ঘুরিয়ে হাসি চাপতে চাপতে চলে এলাম। এইটা হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি। এইখানে মেয়েরা স্বাধীন, যা ইচ্ছে তাই করতে পারে আমি তা বলবো না। জাবি সুলতানার রাজ্য হয়নি ঠিকই, কিন্তু এইখানে মেয়েরা অনেক শক্তিশালী। এইখানে মেয়েরা রাতবিরাতে দল বেঁধে আড্ডা দিতে পারে। একা একটা মেয়ে রাতের বেলা চলতে পারে।
তার মানে কি এই কখনও কোনো সমস্যা ফেইস করতে হয় না? হয়তো হয়, তবে পাশাপাশি এইটাও সত্যি, এরকম ঘটনা ঘটলে মেয়েরা তা চেপে যায় না, বরং পুরো ক্যাম্পাস ফুঁসে উঠে লাঞ্ছনার প্রতিবাদে। সেটা ১৯৯৮ সালে উঠেছিলো, সর্বশেষ ২০১৫ তেও শুনেছি আন্দোলন চলছে। এই যে মেয়েদের স্বাধীনতা বা চিৎকার করার সাহস এইটা কি একদিনে হয়েছে? অথবা এমনি এমনি হয়েছে?
না, অধিকার কেউ এমনি এমনি দেয় না। আপনাকে সেটা কড়ায়-গন্ডায় এই সমাজের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে। জাবিতেও কিন্তু তাই হয়েছে। দিনের পর দিন মেয়েরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাস্তায় ছিল। তাদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, কে ধর্ষিতা? প্রত্যেকে একসাথে উচ্চারণ করেছে ‘আমি ধষির্তা’।
এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল মেয়েরা, নেতৃত্বেও ছিল মেয়েরাই। আরো একটা শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, এই আন্দোলনে পুরুষের সক্রিয়-স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ। ১৯৯৮ সালে জাবিতে এই মুভমেন্ট হওয়ার আগে “ধর্ষণ” শব্দটা সারাদেশে এভাবে আমার উচ্চারণ করতাম না, যেভাবে আজ করি। মনে হতো কী লজ্জা এই শব্দ উচ্চারণে! বাবার সামনে কেমন করে বলি? জাবি ধর্ষণবিরোধী মুভমেন্ট এর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো যে, এটি এক ধাক্কায় ধর্ষণ শব্দটাকে অন্দরমহলের গোপন কুঠুরি থেকে রাস্তায় এনে নামিয়েছে।
এই সমাজে যে এই একটা ঘটনা ঘটে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ধর্ষণের লজ্জা যে ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটার নয়, বরং ধর্ষকের, তা এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছে।
কাজেই বলছিলাম কী, ধর্ষণের শিকার মেয়েদের পক্ষে দাঁড়ালে নারী আপনাকেই দাঁড়াতে হবে, লাঞ্ছিতার পক্ষে দাঁড়ালে আপনাকেই দাঁড়াতে হবে। বিচার শুধু চাইলেই বিচার পাবেন না, এই সমাজে বিচার আদায় করে নিতে হবে ।