মলি জেনান: যে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়ে কোনো মেয়েকে বেঘোরে মরতে হয় কিংবা বেঁচে থাকলে সমাজ-সংসারে-পরিবারে কথায়-আচরণে-দৃষ্টিতে বারবার ধর্ষিত হতে হয়, সেই দেশ খুনি/ধর্ষকদের অভয়ারণ্য হবে এটাই স্বাভাবিক। যে দেশে ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে মাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়, প্রতিনিয়ত ধর্ষকের প্রতিপালকদের হুমকিতে কেঁচোর মত গুটিয়ে থাকতে হয় ধর্ষিতার পরিবারকে সেই দেশে ধর্ষক হওয়াটাই আপাত:দৃষ্টিতে সম্মানের মনে হচ্ছে!!
এমন দিন খুব দূরে নয় যে বাবা-মা কন্যা হয়ে ধর্ষিত হওয়ার চেয়ে পুত্র হয়ে ধর্ষক হওয়াকেই সম্মানের বলে মনে করবেন, আর কন্যাগুলোকে আতুড় ঘরেই নুন দিয়ে মেরে ফেলবেন। আর ধর্ষণের পরে নির্যাতিতাকে মেরে ফেললে তো ধর্ষকের একটা মেডেল পাওয়াই উচিত, তাই নয় কি? যে দেশে “সতীত্ব” নামক সীলমোহর ছাড়া মেয়েরা পচে যাওয়া লাউ/কুমড়ার মতোই, সেই দেশে ধর্ষণের শিকার মেয়েটি বেঁচে থাকবে কিসের জোরে??
৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তাদের বীরত্বগাঁথা আমরা মাথায় তুলে রাখি, আর যে বীরাঙ্গনারা ক্যাম্পে দু:সহ জীবন পার করে প্রতি মূহুর্তে মরতে মরতে স্বাধীন ভূ-খন্ডের জন্য নিজেদের বাচিঁয়ে রেখেছিলেন তাদের আমরা ঘৃনা ভরে প্রত্যাক্ষান করি নূন্যতম অপরাধ ছাড়াই তাঁরা হয়ে উঠেন “বারাঙ্গনা”। যাদের লজ্জা-অপমান-যন্ত্রণা আমাদের বুক দিয়ে ঢেকে দেবার কথা ছিল তাদের আমরা পায়ে দলে যাই, আমরা তো সেই উত্তরাধিকার বহন করছি!! আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হবে, আপাত:দৃষ্টিতে জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, চারদিক চকচকে ঝকঝকে হবে কিন্তু ভেতরটা থাকবে নোংরা, গন্ধময়।
কোন অপরাধ সংঘটিত হলে হোক তা খুন বা ধর্ষণ, খুব কমসংখ্যক হলেও একদল হুমকি/আঘাত সহ্য করে রাজপথে বিচার চাইছে আর আরেক দল ইনিয়ে-বিনিয়ে অপরাধকে বৈধতা দেবার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির মরার পরও রেহাই নেই শুরু হয়ে যায় তার চরিত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ, সে ঠিকমতো জামা-কাপড় পরতো কিনা, কয়জন ছেলে বন্ধু ছিল, একলা থাকতো কিনা, কয়টা প্রেম করতো, রাত করে বাড়ি ফিরতো কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি? লক্ষ্য একটাই “সতীত্ব” নামক নড়বড়ে অলীক বস্তুটিকে কোনভাবে যদি ঝেড়ে ফেলে দেয়া যায়! তবেই তো ধর্ষণ ও খুন নামক ‘সামান্য একটা মিসটেক’(!) হালাল হয়ে যায়।
আমাদের এই সমাজের নর্দমার কীটগুলোর এই বোধ কবে উদয় হবে যে ধর্ষণ এমন একটা অপরাধ যা আপাদমস্তক হিজাব ৱধারীর ক্ষেত্রে যা, একজন যৌনকর্মীর ক্ষেত্রেও তাই, এমন কি বিয়ে করে নিজের সম্পত্তি(!) মনে করা স্ত্রী‘র ক্ষেত্রেও তাই।
আমরা যদি এই নর্দমার কীটগুলোর নোংরামি বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতে চাই তবে এখনই সময়। ঘাতক/ধর্ষক কখনও কারো সন্তান/ভাই/বন্ধু হতে পারে না। আমার সন্তান ঘাতক/ধর্ষক হয়ে উঠলে তবে তার অণ্ডকোষে লাথি দিয়ে যদি কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারি, তার জঘণ্য অপরাধের সাজা দিয়ে যদি তাকে মানুষ করে তুলতে না পারি তবে এই সামাজিক অবক্ষয় কখনোই রোধ করা সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা চোখে ঠুলি পড়ে থাকলে আমার সন্তানের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। আপনজন ভেবে অপরাধীর পক্ষ নিয়ে, তাকে নিরপরাধ প্রমাণ করার কৌশল অবলম্বন করছে যারা তা পক্ষান্তরে অপরাধীর অপরাধকেই বৈধতা দিচ্ছে। তাই আমাদের অপরাধী ও তার আশ্রয় প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধেও রুখে দাড়াতে হবে।
অনেক দামে পাওয়া আমার এ দেশ।
এ দেশ কখনোই খুনি/ধর্ষকের অভয়ারণ্য হতে পারে না।
এ দেশে আমার সন্তান হোক সে ছেলে বা মেয়ে উভয়েই সমান মুক্ততা নিয়ে ঘুড়ে বেড়াবে।
তনু/আফসানার খুনিদের হাতে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হারমানতে দেব না। এই আমার প্রতিজ্ঞা।
আমার কন্যার স্বপ্নের সূর্যের ভোর আনবোই আনবো…..।