ভালো-খারাপের দোলাচলে আমার জীবন কই?

সাদিয়া নাসরিন: ভালো মেয়ে নত হয়, ভালো মেয়ের যত ভয়। একটু ভয়, একটু লাজে ভালো মেয়ে বড় সুন্দর। ভালো মেয়ে শরীর লুকিয়ে বাঁচতে জানে। ভালো মেয়ে পা গুটিয়ে বসতে জানে, কাপড় ঠিক রেখেই শুতে জানে। ভালো মেয়ে আদব লেহাজ মেনে কথা বলে। খিস্তিখেউর ভালো মেয়েদের মানায় না। ভালো মেয়ে ভালো রাখে, ভালো মেয়ে আপোষ করে।

Sadia 4ভালো মেয়ে কথায় কথায় ফোঁস করে না। ভালো মেয়ে দেনা-পাওনার হিসেব করে না। ভালো মেয়ে আকাশ দেখে না, জীবন খুঁজে মরে না। ভালো মেয়ে নিজের জন্য বাঁচতে শিখে না। ভালো মেয়ে পুরুষের জন্য নিজেকে সাজায়, পুরুষ যেভাবে, যখন, যতটুকু চায়। ভালো মেয়ের মান-সম্মানের ভয়। ভালো মেয়ের ঘর ভাঙ্গে না। ভালো মেয়েকে নিয়ে তাই বাবা-মার দুশ্চিন্তা থাকে না

এই একটা জীবন প্রায় কাটিয়ে দিলাম উচিত ভালো-খারাপ অনুচিত, আর সওয়াব-গুনাহ’র নিক্তি পাল্লা মেপে। এই করতে করতে কতবার ভাঙলাম, একা হলাম, পেছনে পড়ে গেলাম, আবার এগুলাম …

নেপালে সবুজ নীল সুইমিং পুল দেখে একবার খুব সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু মনের চারপাশে দেয়াল তুলে চলে এসেছিলাম, যদি লোকে খারাপ বলে…..একটা লাল টিপ পরার বড় শখ, গুনাহ হবে বলে পরা হয়ে উঠেনি কখনো…..আমি গোলাপ ভালোবাসি বলে যে মানুষটা জবা ফুল ভালোবাসে সে “খারাপ” কত সহজেই না এই জাজমেন্টে এসেছি….

সেই কোন কিশোরি বেলায় জীবনের প্রথম প্রেমের চিঠি নিজে না পড়ে আম্মার হাতে তুলে দিয়েছিলাম ভালো মেয়ে হবো বলে!! আম্মা বলেছিলো, ভালো মেয়েরা প্রেম করে না। সেই থেকে প্রেমেই ভয় ধরে গেছে আমার। আকাশের নীল রঙ পছন্দ হলেও ভয় পেয়েছিমেয়েদের অত উপরের দিকে তাকাতে নেই, অত উপরের রং ভালো লাগতে নেই নীল রঙ এর শাড়িতে আজো আমার ভয়

বড় হয়ে উঠার দিনগুলোতে ঘাড় উঁচু করে সামনে তাকিয়ে পথ চলিনি, ভালো মেয়েদের মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হয় বলে। হেসে খলখল করার সেই দিনগুলোতেও আমি হাসতে পারিনি মন খুলে,  অট্টহাসিতে আজও ভয় আমার ভালো মেয়ে জানে, জোরে হাসলে নাকি অলক্ষী আসে, পরে কাঁদতে হয়….

জীবনের প্রতিটি স্টেপ, এগুনো, পেছুনো, লড়াই, হারজিত আমাকে আজ যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে সেখানে এসে আমি বুঝে গেছি “উচিত অনুচিত” মানুষকে সংশয় ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে পাপের ভয় আর পুণ্যের লোভ মানুষের জীবন বোধ ধ্বংস করে দেয়। অনুচিত বা ভুল বলে আসলে কিছু নেই। পরিস্থিতিকে রেসপন্স করাটাই “উচিত”, নিজের মনের কথা শোনাটাই “ঠিক”…..

ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে কষে থাপ্পড় মেরেছিলাম এক “ভালো” ছেলেকে ষোল বছর বয়সে পরপর দুটো মেয়ে জন্ম দেয়ার অপরাধে(??)আমার বাবাকে যৌথ পরিবারের কুটচালে নিগৃহীত হতে দেখতে দেখতে একদিন বুক টান করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম “সিস্টেম” এর মুখোমুখি বিয়ে নামের একটা “এরেঞ্জড অকারেন্স” কে চ্যালেঞ্জ করে জীবনের খোঁজে পথে নেমেছিলাম সেই ঊনিশ বছর বয়সে। তারপর?

সেই যে “খারাপ” মেয়ে হলাম আজো “ভালো” হতে পারিনি। সময় আমাকে শিখিয়েছে ভালো খারাপের দোলাচলে জীবন হারিয়ে যায়। ভয় আর লোভ দিয়ে জীবন গড়া যায়না, জীবনকে জীবন দিয়েই গড়া যায়। লক্ষী মেয়ে, মিষ্টি বোন, প্রেমময়ী প্রেমিকা, প্রিয়তমা স্ত্রী, এসব সম্মোধন আমাকে আপাতত শান্তি দিয়েছে, সম্মান নয়।

জন্ম জন্মান্তরে আমি তাই খারাপ মেয়েই হতে চাই ভালো মেয়ে হয়ে স্বর্গের পথ চেয়ে থাকা বোকা মেয়েরা শোনো, এভাবে জীবন আসে না। একটু খারাপ হও এবার। It’s about your time, dear!! সময়কে হাতছাড়া করো না। ভালবাসা…প্রেম…শাড়ী, গয়না, গোলাপ…হাব্বি…হানী…আর লাভিউ’র প্রতারণায় নিজেকে আর কত ভোলাবে? নিজের অধিকারের কথা বলো এবার ভালো মেয়ের ফাঁদ থেকে বের হয়ে জীবনের পথে এসো।

চোখ নত করে, মাথাহীন শরীর সাজিয়ে দিয়ে পুরুষের জন্য আর কতদিন নিজেকে তৈরি করবে? পুরুষ চায় বলে তুমি লেখাপড়া করো, পুরুষ চায় বলে বড় ডিগ্রীধারি বুয়া হও। তোমার কষ্টার্জিত ডিগ্রী দিয়ে তুমি পুরুষের ইমেজ তৈরি করো। পুরুষ চায় বলে সেজেগুজে পার্টি এটেন্ড করো। পুরুষ চায় বলে তুমি কেবল অমুক ভাবি” “মিসেস তমুক” হয়ে স্বামীর পদবীকে নিজের ভাবতে থাকো। পুরুষ ভোগ করবে বলে তুমি সাতপসরা সাজিয়ে নিজেকে পণ্য বানাও।

এবার একটু দম নিয়ে নিজের কথা ভাবো। ইভ এন্সলার এর কথা শোন, Stop fixing your bodies, and start fixing the world!”   

ভালো মেয়ে-খারাপ মেয়ের দোলাচল কাটিয়ে উঠো। এবার বাঁচো। নিজের আকাশ তৈরি করো। জীবন চাইলে তোমাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। তাই তোতাপাখির মতো যেসব ন্যাকামো শিখে এসেছো এতোদিন আগে তা ভুলতে হবে।অমুক ভাবি” এবং “মিসেস তমুক” থেকে বের হয়ে নিজের নাম ধরে নিজেকে পরিচিত করো। ঘাড়ের উপর মাথাটা শক্ত করে বসাও। মাটির দিকে তাকিয়ে না থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে ঘাড়টা তেরচা করে পৃথিবীর দিকে তাকাও

আর মনে রেখো, এ পথ বড়ো বন্ধুর। আধ-কাটা, খানা-খন্দ, আর খাড়া পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বহুত দম লাগবে, তেজ লাগবে। দৌড়াতে নামলে পড়ে যাবার ভয় ও থাকে । যে দৌড়াতে জানেনা, সে পড়েও না, হারেও না। জেতার আনন্দ ও সে জানেনা। জীবনের এই রেসে কখনো তুমি হেরে যাবে, হোঁচট খাবে, টালমাটাল হবে। কিন্তু উঠে দাঁডাতে হবে বারবার। এভাবেই পথ হারাতে হারাতে দুহাতে আঁধার সরিয়ে আলো খুঁজে পাবে তুমি। তীব্র যন্ত্রণার বিষকে বিষের দাহ দিয়ে পুডিয়ে যে আলো আসবে সে আলো তোমার। সে আলো জীবনের।

জুজুর ভয় কাটিয়ে উঠো। সমতার লড়াই তোমার সম্পর্কগুলো নষ্ট করবেনা, সম্মানের করবে। অন্যের দেওয়া ভাত কাপড় আর বাজর দরে খোরপোষের জীবনে সম্মান নেই, থাকেনা ,থাকতে পারেনা।

পুরুষ, তুমিও মুক্ত হও, মানুষ হও। তুমি ভুলে যাও, তুমিই নারীর অন্নদাতা, আশ্রয়দাতা, রক্ষাকর্তাতুমি শুধু নারীর সহযোদ্ধা হওতুমি নারীর আকাশে গণ্ডি এঁকে দিও না। তুমি ও নারী এক আকাশে ওড়ো সীমাহীন। মানুষ হয়ে সমতার লড়াইয়ে আসো তুমিও। নারীবাদী হও বন্ধু আমার, মানববাদী হও।  

শেয়ার করুন: