এসো পুরুষ, ফেয়ার গেইম খেলি

জেসমিন চৌধুরী: একজন শিক্ষিত মানুষ, হোক সে নারী অথবা পুরুষ, যখন সমতাবাদের  (নারীবাদ শব্দটায় অনেকের এলার্জি আছে) বিষয়টি বুঝতে চায়না তখন বিরক্ত বা  অবাক লাগলেও আমার ঠিক রাগ হয় না। যে মানুষ রাজনীতি বোঝে, অর্থনীতি বোঝে, সমাজের আর দশটা সমস্যা নিয়ে ভাবতে বা কথা বলতে পারে, সে কেন নারীর অধিকারের মত স্বাভাবিক একটা বিষয় বুঝতে পারে না?

Jesminদীর্ঘদিনের সংস্কার এবং অভ্যাস কাটিয়ে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়তো সহজ নয়, কিন্তু তাই বলে বিষয়টির যৌক্তিকতা মেনে নিতেও কেন এতো দ্বিধা? বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যেও এই ক্ষমতার অভাব আমাকে ভাবিয়ে তুলে।

সেদিন এক ড্রইং রুম আড্ডায় কয়েকজন বন্ধুর সাথে হালকা গালগল্প হচ্ছিল। একজন সচেতন নারী হিসেবে নিশ্চয়ই আমার কথাবার্তায় নিজের অজান্তেই নারীর অধিকারের বিষয়টা বারবার চলে আসে, কারণ এক ভদ্রলোক হঠাৎই বলে উঠলেন,

‘জেসমিন আপাতো সেই তখন থেকে একই সুরে কথা বলে যাচ্ছেন।‘

‘কী সুরে ভাই?’

‘কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ সুর’

যে নারীকে ছোটবেলা থেকে যুদ্ধ করতে হয়েছে প্রতিটা অধিকারের জন্য, প্রতি পদে পদে পুরুষের হিংস্র থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়েছে, অল্প বয়সে খুসি মনে বিয়ের মালা পরতে হয়েছে, নিজের শিক্ষার পেছনে নিজের টাকা খরচ করার জন্য শ্বশুর বাড়ির কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে, সাইকেল চালানো শেখার জন্য বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, প্রথম স্বামীকে ত্যাগ করতে চাওয়ার জন্য ঘরে বাইরে কারণ দর্শাতে হয়েছে সে নারীর কথাবার্তায় একটা স্থায়ী যুদ্ধের গন্ধ লেগে যাওয়ার কথা অবশ্য। তাই ভদ্রলোকের কথায় রাগ করলাম না।

‘এই যুদ্ধ তো শুধু আমাদের জন্য না, আমরা লড়ছি আপনাদের জন্যেও।‘

তিনি আমার কথায় মজা পাচ্ছেন দেখে বললাম,

‘আপনাদেরকে পুরুষ থেকে মানুষ বানানোর জন্য লড়ছি আমরা, যাতে মিলে মিশে শান্তিতে একটা সুন্দর জীবন বাঁচতে পারি। আপনারা পুরুষরাও তো পুরুষতন্ত্রের শিকার।‘

‘সেটা কী রকম?’

‘এই দেখুননা, আপনাদের মত শিক্ষিত বুদ্ধিমান সহনশীল মানুষদের জন্য নারীর অধিকাররে বিষয়টা শ্বাস প্রশ্বাস নেবার মতই স্বাভাবিক হবার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি।  পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জন্ম আর বেড়ে উঠার কারণেই এই সংকীর্ণতার দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আপনাদেরকে। এটা তো আপনাদের প্রতিও অন্যায়।‘

ভদ্রলোক প্রকৃত পক্ষেই একজন সহনশীল মানুষ তাই আমার  কথায় ক্ষেপে না গিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন। আমি যদিও উনাদের সাথে মজা করার জন্যই কথাগুলো বলেছিলাম, কিন্তু বলার সাথে সাথেই মনে হলো নিজের অজান্তে খুব সত্যি কিছু কথা বলে ফেলেছি।

তারপর থেকেই নিজের চারপাশের পুরুষদেরকে মন দিয়ে দেখছি। তাদের বেশির ভাগই স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তারা সচেতনভাবে নারীবিদ্বেষী নন, অথবা নারীকে ছোট করে দেখার কথা ভাবেন না।  আবার নারীর সম-অধিকারের বিষয়টাও ঠিক বোঝেন না। আসলে তারা নিজেরাও বয়ে বেড়াচ্ছেন এক লজ্জাকর এবং অপমানজনক উত্তরাধিকারের বোঝা, যা বংশানুক্রমে পুরুষ থেকে  পুরুষে হাত বদলাতে বদলাতে রক্তের ভেতরে ঢুকে গেছে। শিরায় শিরায় নেচে বেড়িয়ে বিবশ করে ফেলছে তাদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিকে।

ফেইসবুকে অনেককে বলতে দেখেছি, সমতাবাদ হচ্ছে নারীর সংক্ষিপ্ত কাপড় পরা আর সিগারেট ফুকার আন্দোলন। এটা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আমরা বলিনা যে সিগারেট খেতেই হবে, বা ছোট কাপড় পরতেই হবে, কিন্তু সাগর পারে গিয়ে একজন পুরুষ যখন নির্দ্বিধায় প্রায় ন্যাংটো হয়ে পানিতে নেমে পড়েন আর তার সঙ্গিনীটি সর্বাংগ ঢেকেঢুকে গোড়ালি পর্যন্ত ভিজিয়ে শুধু সেলফিই তুলেন অথবা একগাদা কাপড়ের বোঝা শরীরে নিয়ে গলা পানিতে হাবুডুবু খান তখন মনে হয়, ‘সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!’

পুরুষের কাম চিন্তাকে সামাল দিয়ে রাখতে আমার শরীর না হয় ঢেকেই রাখলাম, কিন্তু সমুদ্রে সন্তরণরত অর্ধনগ্ন এক হ্যান্ডসাম পুরুষের সুঠাম দেহ দেখে আমারও কি পাপ চিন্তা হতে পারে না? , আমারও যে কামনা বাসনা আছে, আমিও যে পাপ করতে পারি,  সেই স্বীকৃতি চাই আমি। সিগারেট ফুকা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ হিসেবে সবার জন্যই খারাপ, শুধু নারীর জন্য নয় এই বোধোদয় চাই আমি। আমার স্বাস্থ্যের ভাল মন্দের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে চাই আমি।

শুধু পুরুষ কেন, বেশির ভাগ নারীই নারীর অধিকারের বিষয়টা বুঝেননা। তাদের কাছে নারীর অধিকার মানে হচ্ছে পুরুষের কাছ থেকে ভরণ পোষণ পাওয়ার  অধিকার, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। কিন্তু যে স্বাধীনতাটুকু জন্ম থেকে পেলে এসব নিরাপত্তার প্রয়োজনই থাকেনা, সেই স্বাধীনতার অধিকারকে যেসব নারীরা বুঝেননা বা বুঝতে চাননা তাদের নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইনা আমি।

আমার সমস্ত চিন্তা পুরুষকে নিয়ে। আমার সহচর, আমার পথ চলার সাথী হিসেবে আমি সেই পুরুষকে চাই যে আমার অধিকারকে বুঝবে এবং শ্রদ্ধা করবে, সেই পুরুষ গড়ার আন্দোলনে নেমেছি আমি। আমার আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন নয়, আমি জানি আমার অধিকার কী, এবং তা আমাকে কেউ হাতে তুলে দেবার অপেক্ষা করে আমি বসে নেই।  আমার আন্দোলন অধিকারের জানান দেবার আন্দোলন, পুরুষের মধ্যে সেই অধিকারের উপলব্ধি সৃষ্টি করার আন্দোলন।

পুরুষ, তুমি আমার খেলার সাথী, তোমাকে সাথে নিয়ে স্নিগ্ধ ভোরে বনপথে হাঁটতে যেতে চাই আমি, তপ্ত দুপুরে গাছের ছায়ায় তোমাকে সাথে চাই আমি, আকাশ ভাংগা বৃষ্টিতে তোমার সাথে ভিজতে চাই আমি, নীল জোছনায় তোমার সাথে স্বপ্ন দেখতে চাই আমি। আমার বাস্তবে, কল্পনায়, কষ্টে, আনন্দে, গৌরবে তোমাকে চাই আমি।

পুরুষ, তোমার সাথে খেলতে চাই আমি, কিন্তু তোমার গায়ের জোরে বারবার তুমিই জিতে যাবে তা হয়না। তোমাকে ততটুকু অমানুষ হতে দিতে চাইনা আমি, তোমাকে ভালবাসি বলেই।

আমার লড়াই তোমার বিরুদ্ধে নয়, পুরুষতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা যে কৃত্রিম সমাজ ব্যবস্থা তোমার আর আমার মধ্যে যোজন যোজন দুরত্ব তৈরি করে রেখেছে আমার লড়াই তার বিরুদ্ধে। তোমাকে ভালবাসি বলেই বলছি, তোমার উপরে কোন রাগ নেই আমার।

তোমাকে আরো বেশি ভালবাসতে চাই বলেই বলছি, এসো একসাথে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করি।  তোমার কাঁধ যত বেশি আমার কাঁধের কাছাকাছি আসবে, আমরা তত বেশি বন্ধু হবো, তত বেশি আপন হবো, আমাদের পৃথিবী তত বেশি সুখের আর শান্তির হবে। এসো পুরুষ, ফেয়ার গেইম খেলি।  

শেয়ার করুন:

#আমরা সবাই সম অধিকার সম অধিকার বলে লাফালাফি করি। কিন্তু, আমার বুঝতে খুব কষ্ট হয় যে সম অধিকার বলতে আমরা কি বুঝাতে চাচ্ছি। আমার মনে হয় আমাদের আগে জানতে হবে আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে সম অধিকার চাচ্ছি।

ইসলাম তো কোন নারী বা পুরুষের প্রকৃতার্থে যা অধিকার আছে তা থেকে বঞ্চিত করছে বলে আমার মনে হয় না। উপরোক্ত লেখা পড়ে যতটুকু বুঝতে পারলাম, তা হল উনারা সবকিছুতেই স্বাধীনতা চাচ্ছেন । কিন্তু, এতে করে কি সমস্যার সমাধান হবে ? আর যে যাই বলুক অন্ততঃ আমি এটা বিশ্বাস করতে পারব না।

আর একটা কথা, আমরা সবকিছুতেই সম অধিকার চাই। ঠিক আছে ধরুন এক মিনিটের জন্য মেনে নিলাম। তবে সবকিছুতেই কেন চলে আসে লেডিস ফাস্ট কথাটা। কেন কোন পুরুষকে নিজের সীট ছেড়ে নারীদের বসতে দিতে হবে। আমার যুক্তি হল যদি আমরা সম অধিকার চাই তাহলে তো সব বিষয়েই সম অধিকার থাকতে হবে। নারীদের বসতে দিয়ে যদি একজন পুরুষ গাড়িতে দাড়িয়ে ভ্রমন করতে পারে তবে নারীরা কেন পারবে না ? আমার তো মনে হচ্ছে এটা ফায়দা হাসিলের একটা বাহানা মাত্র।

আসলে কথা হচ্ছে কি…..
বিচার মানি, তবে তালগাছ আমার।

আমাদের দেশে যেভাবে মেয়েদের দমিয়ে রাখা হয় সেটা থেকে উত্তরণের জন্যই “লেডিস ফার্ষ্ট” কথাটার চল হয়েছে । ধরেন বাসে একজন নারী দাড়িয়ে থাকলে আশেপাশের কয়টা পুরুষ সভ্য আচরণ করেন ? সেখানে কেউ যদি সীট ছেড়ে দেন, তাহলে কেন সেই নারী সুবিধাটুকুন নিবেন না ? ইউরোপ, আমেরিকায় কোন নারীকে কেউ সীট ছেড়ে দেন না এবং নারীরাও তা দাবী করেন না । কারণ তুলনামুলকভাবে সেই দেশের পরিবহন পরিস্থিতি আমাদের চেয়ে ভালো । হ্যা, সেখানেও নারীরা বৈষম্যের স্বীকার হন কিন্তু নারীরা সাথে সাথে প্রতিবাদও করতে পারেন । তখন কেউ ধর্ম, সমাজ, মুল্যবোধ এই শব্দগুলো টেনে আনেন না ।

নারীদের বসতে দিয়ে যদি একজন পুরুষ গাড়িতে দাড়িয়ে ভ্রমন করতে পারে তবে নারীরা কেন পারবে না ? উত্তরটি একটু নিজেই ভাবেন না আপনার পরিবারের কোন মেয়ে বাসে কোথাও জায়গা না পেয়ে দারিয়ে যাচ্ছে আর পাশে থেকে কিছু লোক শুধু শরীরে টাচ করার জন্য অযথাই নড়াচরা করছে , কেমন লাগবে তখন আপনার? আমরা এখনও আমাদের ছেলেদের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারিনি। যেদিন পারব সেইদিন মেয়েদের আলাদা ভাবে কোন সিট বাসে থাকবে না ।

আপনি নারীবাদী নন!
নারীবাদীদের কথা শুনে মনে হয়, তারা হয় কামশীতলা, এবং/অথবা সমকামী। তাদের কাছে পুরুষ কথাটিই বিছুটি-পাতার মত। তারা নিখাদ পুরুষ বিদ্বেষি। সর্বোপরি তারা অস্থির মতি এবং দায়ীত্বজ্ঞানহীণা।
ধন্যবাদ!

আমি অবশ্যই পুরুষ বিদ্বেষী নই, পুরুষের সাথে ঘাড়ে ঘাড় মিলিয়ে কাজ করা আর হাতে হাত রেখে বেঁচে থাকায় বিশ্বাস করি। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য তার মুখোমুখি হওয়াতে বিশ্বাস করি।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.