সাদিয়া নাসরিন: পাঁচ-দশ-বিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকায় দেনমোহরের নিলামে উঠে যখন তুমি মাথা নিচু করে স্বাক্ষর করো চলতি বাজার দরে খোরপোষের নীল চুক্তিতে, নারী, তখনও কি তুমি বুঝতে পারো না তুমি আসলে দাসখত লিখছো নিজের জীবনেরই? ওই কথার অঙ্কের টাকা আর ভাত-কাপড়ের চুক্তিতে বেচা হয়ে গেছে তোমার জীবন। তুমি তখন কেবলই বিকিকিনির হাটে উঠা মুলো-মাছ, আর মানুষ হলে খুব জোর অর্ধাঙ্গিনী বই কিছু নও তো!
পণ্য বললে তোমার গায়ে লাগে? ওই টাকার বিনিময়েই তো নারী তুমি “হালাল” হয়েছো পুরুষের কাছে। পুরুষ দাম দিয়ে কিনে নিয়েছে তোমার শরীরের উপর তার নিরঙ্কুশ অধিকার। শরীর, মন, সেবা…চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য তুমি যা যখন চায়। ভেবে দেখেছো কখনও লাখ টাকার মোহর আর চলতি বাজারদরে খোরপোশের বিনিময়ে বেচে দেয়া জীবন আসলে কতটুকু সম্মানের আর কতটুকু সম্পর্কের দায়?
নিজের মুখোমুখি দাঁড়াও নারী। সম্মানের কথা যদি বলো, তবে বুঝে নাও সে সম্মান দুজনেরই সমান সমান। বিয়ে তো নারী-পুরুষ দুই পক্ষের চুক্তি। তবে কাবিনের ১৩ নং কলামে যখন চুক্তির একপক্ষ দেনমোহরের ঘরে তোমার মূল্য লিখে, তখন অন্যপক্ষ তুমি কী লিখো?
এই একপক্ষীয় দেনমোহর বা মূল্য পরিশোধের চুক্তির প্রতিদান তোমার জীবন নয় তো? আমি জানি তুমি এই প্রশ্নের উত্তর জানো না। কারণ সারাজীবন শেখানো হয়েছে, এই দেনমোহর তোমার অধিকার। তুমি জেনেছো, দেনমোহর তোমাকে সম্মান দিয়েছে, তোমার আর্থিক নিরাপত্তা দিয়েছে!
দেনমোহরের চুক্তি তোমাকে আসলে কতটুকু সম্মানিত করেছে তা বুঝতে হলে তোমাকে বুঝতে হবে ওই নীল কাগজের প্রতিটি কলামে ছড়িয়ে থাকা বৈষম্য আর পুরুষতন্ত্রের চোরাগলি। তোমাকে জানতে হবে “চুক্তি”, “বিয়ে” এবং “দেনমোহর” আসলে কী!
চুক্তি আইন অনুযায়ী একজন সুস্থ মস্তিস্ক ,আইনের দৃষ্টিতে সাবালক ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন বস্তু বা অর্থের বিনিময়ে লিখিত অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াকে চুক্তি বলে। প্রত্যেক চুক্তিতে একপক্ষ প্রস্তাব করে এবং অন্যপক্ষ প্রস্তাব গ্রহণ করে কোনকিছু প্রতিদান করে। প্রতিদান ব্যতিত কোনো চুক্তিই কার্যকর হয় না।
আর মুসলিম পারিবারিক আইনে বিয়ে একটি দেওয়ানি চুক্তি। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও সন্তান জন্মদানের অধিকার পায়। একটি পূর্ণাঙ্গ বিয়ের চুক্তির জন্য যে সব শর্ত পূরণ করতে হয় তাহলো, বয়স, সম্মতি, দেনমোহর, সাক্ষী, এবং নিবন্ধন”।
এবার খেয়াল করো, এখানে বয়স, সম্মতি, সাক্ষী এবং নিবন্ধন এই শর্তগুলো নারী-পুরুষ উভয় পক্ষকেই পালন করতে হয়। শুধুমাত্র “দেনমোহর”ই একমাত্র শর্ত যা শুধু পুরুষকে পালন করতে হয়। চুক্তি আইন অনুযায়ী, প্রতিদান ব্যতিত কোন চুক্তি কার্যকর হয় না। এখানে আমি যদি ধরে নিই, দেনমোহর হলো সেই প্রতিদান, তাহলে তা কিসের বিনিময়ে?
এই চুক্তির ফলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অধিকার তো নারী-পুরুষ দু’জনেই পায়, তবে মূল্য কেন পরিশোধ করতে হয় একজনকে? কেন দেওয়ার অধিকার বা ক্ষমতা শুধু পুরুষের? এই দাতা ভূমিকার সাথে পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতাচর্চার কোন যোগসূত্র পাও?
ওই নীল কাবিনে নীল হতে হতে একবার ভাবো তো মোহরের বিনিময়ে করা ওই চুক্তি তোমাদের দুজন মানুষকে আসলেই সমতার মর্যাদা দিয়েছে কিনা? দাতা গ্রহিতার চুক্তিতে আদৌ কি সমতা আসে? সম্পর্কের ভিত্তি আসলে কী? ভালোবাসা, পারস্পরিক সমতা, নাকি দেনমোহরের টাকা পরিশোধের ভয়?
লক্ষ টাকার মোহরের বিনিময়ে যে সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে হয়, সে সম্পর্কে আদৌ পরস্পরের আস্থা আর কমিটমেন্ট থাকে কিনা?
দেনমোহর তোমাকে এমন সম্মানই দিল যে, তুমি বাসর রাতেই ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে “ভালো বউ” হয়ে গেলে স্বামীর দেনমোহরের আজাব “মাফ” করে দিয়ে। তারপর নিজের ভাত-কাপড়ের দায় আরেকজনের উপর তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে সুখ সুখ খেলা করো। পুরুষ এই খেলা বেশ উপভোগ করে। আবার ঘটনা খারাপ হয়ে দুজনের পথ দু’দিকে বেঁকে গেলে সেই “মাফ” করে দেয়া দেনমোহরের জন্য আর বাজার দরের ভরণপোষণের জন্য উকিল বাড়ি আর কোর্ট বিল্ডিং এর বারান্দায় দৌড়াও। পুরুষ ও সেই “সম্মান” না দেয়ার জন্য যা করা দরকার তার সবই করে।
নারী, তুমি নিজে কি জানো তুমি আসলে কী চাও? তুমি সমান অধিকার চাও। সমতার মর্যাদা চাও। কিন্তু অধিকারের সমতা চাইতে গেলে যখন দায়িত্বের সমতার প্রশ্ন আসে তখন তুমি নিরব হয়ে যাও। তুমি বিশাল অঙ্কের দেনমোহরের মুল্যে তোমার ইজ্জত (??) বিক্রি করে সোসাইটিতে গ্রীবা উঁচু করে বেড়াও। একবার ও ভাবলে না, পুরুষ দেনমোহর দিয়ে তোমাকে সম্মানিত করলো, তুমি পুরুষকে কী দিয়ে সম্মান করলে? পুরুষ চলতি বাজার মূল্যে তোমাকে ভরণপোষন দিল, তুমি পুরুষ কে কী দিলে? বিক্রি হওয়ার দায় কি কেবল তোমার, বন্ধু?
নিজের প্রতি জাজমেন্টাল হও। ভাবো, দাতা আর গ্রহীতার অবস্থান এক কিনা! যে ইজ্জতের মূল্য গ্রহণ করে তুমি পুরুষের ঘর (??) করতে এসেছো, জেনে রাখো সে ঘর কোনদিনও তোমার হবে না। নিজের শরীরটাকে পণ্য বানিয়ে “ইজ্জতের” দাম আদায় করার সময় তুমি যদিও ভুলে গিয়েছিলে সে কথা, আজ মেনে নাও তোমার ইজ্জত পুরুষ কোনদিন দিবে না। নিজের সম্মান বেচে দিয়ে অন্যের কাছে সম্মান আশা করা যায় না।
যদি সাহস থাকে, যদি আসলেই সম মর্যাদা চাও তবে দেনমোহরের ঘরে লিখে দাও “সমতা”। এটাই হোক তোমার সমতার প্রথম লড়াই। সংসারের সব দায়িত্বে তুমিও হও সমান অংশিদার। একজন টাকা দিবে, আরেকজন কামলা দিবে, এই সূত্র সমতার নয়।
আরেকজনের পকেটে জীবন ঢুকিয়ে রেখে নিজের সমতার জন্য লড়াই করা যায় না। তোমাকে লড়াই করতে হবে সবার আগে তোমার নিজের সাথে। নিরাপদ আরামের লোভ থেকে বের হয়ে আসো। ঐ নীল কাগজের বায়বীয় সম্মানের আশায় বসে না থেকে নিজের জীবনটা নিজের হাতে নাও।
মনে রেখো শর্টকাট চোরাপথ দিয়ে মুক্তি আসে না। এটা সমুখ সমর। “মুক্তি” নিরাপদ আরামে স্নান করার চৌবাচ্চা নয়। সে এক অপার সমুদ্র। আছে হাঙ্গর, কুমির আর উত্তাল ঢেউ। তবুও জীবন চাইলে তোমাকে মুক্তির সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। সমতার লড়াই করে যেতেই হবে।
সুতরাং হাইহিল খুলে মাটির উপর শক্ত করে পা রেখে দাঁড়াও। মাটির দিকে তাকিয়ে না থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াও। ঘাড়টা তেরচা করে পৃথিবীর দিকে তাকাও।
তোতা পাখির মতো মগজে ঢুকিয়ে দেয়া মাইন্ডসেটকে চ্যালেঞ্জ করে সত্যিকারের সম-মর্যাদার আলোয় এসে দাঁড়াও। এই আলো জমাট অন্ধকারের বুক ফেটে বেরিয়ে এসে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। এই আলো মুক্তির, এই আলো সমতার।
অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসরিত আলো, সে তোমারই আলো……সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভাল, সে তোমারই আলো……
Dear Writer, I think your parents doesn’t give you proper education. Alas! your children’s are also didn’t get right education. They do worship of evil.
আপু,লিখে যান,,,,
সাথে আছি সবসময়,,,
সময়োপযোগী এবং বস্তুনিষ্ঠ লেখা। দেনমোহর এবং মুসলিম বিবাহ চুক্তির বৈষম্য গুলো আলোচনায় আসা দরকার। একটা অদ্ভুত বিষয়, যে দেনমোহরকে ইদানিং পুরুষ রা পুঁজি বিহীন ব্যবসা বলছে, সেই দেনমোহরের বিপক্ষে কথা বললে পুরুষরা ই আবার প্রতিবাদ করছে!!! দেনমোহরের এই চোরাগলি থেকে মেয়েরা বের হতে চায় কি না সেটা ও একটা প্রশ্ন। খুবই ভ্যালিড একটা কথা বলেছেন আপনি । যদি সমতা চাও, যদি সাহস থাকে, তবে দেনমোহরের ঘরে লিখে দাও “ সমতা ” । সাবাস।
সম্মান বাড়ে ২দিনের পরিচয়ে সেক্স করলে।
সম্মান বাড়ে থাকা খাওয়া, শপিংয়ের বিনিময়ে লিভ টুগেদার করলে।
সম্মান বাড়ে যখন তখন বেড পার্টনার চেঞ্জ অপশনে…
J AIVABE ঘাড়টা তেরচা করে পৃথিবীর দিকে তাকাও BOLE – DEFINITELY SHE IS ANTI MUSLIM – TAKE CARE ALL. COZ SHE NEVER UNDERSTOOD THE MEANING OF “SURAH FATIHA”
সুরা ফাতিহা টা ভাল করে তরজমা করে দিলে ভাল হত,জনাব ahmed
ভাল লিখেছেন সাদিয়া। কিন্তু এর থেকে বেরোবার উপায় কি ।
এরকম security money একজনের কাছ থেকে নিয়ে, তার আকার ইংগিতের উপর নির্রভর করে থাকাটা এই যুগে এসে একেবারেই বেমানান, সুন্দর লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
দেন মোহরের বিনিময়ে নিজেকে নারী এই বৈবাহিক দেওয়ানী চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যা একটি অসম এবং অসন্মানজনক চুক্তি – এটা এই লেখার একটি মূল বিষয়। এ ব্যাপারে দ্বিমত করার অবকাশ নাই। তবে-
পুরুষ যে স্ত্রীকে সারা জীবন ভদ্রজনোচিত খোরপোষ দিবে – এটা হয়ত আন এমপ্লয়েড নারীর জন্য সুরক্ষা দেয় কিন্তু এমপ্লয়েড নারীর ক্ষেত্রে এটা তার স্বামীর জন্য একটা দ্বন্দ্ব ছাড়া কিছু নয়। কেননা মুসলিম বিবাহ রীতি অনুযায়ী নারীর উপার্জন নারীর একার। নারীকে তার পিতা সম্প্রদান করে দেওয়ার পর এবং তথাকথিত দেনমোহর পরিশোধের পর নিজের সময়ের উপরেই তো নারীর কোন দাবী ও কতৃত্ব থাকার কথা নয়। কাজেই সেই সময় ব্যবহার করে উপার্জিত অর্থ নারীর একার হয় কি করে?
এই কনফিউশন আরো জটিল হয় যখন স্বামীর উপার্জন স্ত্রীর থেকে কম হয়। স্বামী সংসার চালাতে যে প্রোফাইল মেইনটেইন করতে চায় স্ত্রীর উপার্জন বেশী বিধায় সে উচ্চতর প্রোফাইলের জন্য স্বামীকে অস্থির করে তুলতে পারে কিন্তু স্বামী যে মাসিক খরচে দায়বদ্ধ স্ত্রীর সে দায় না থাকায় দাম্পত্য দ্বন্দ্ব নিত্য ঘটনা।
বিবাহ নামক এই দেওয়ানী চুক্তির অর্থনৈতিক ও লৈঙ্গিক অসমতা নিয়ে কাজ হওয়া দরকার।