শান্তা মারিয়া: আইসিইউ রোগীদের আত্মীয়ের জন্য অপেক্ষাকক্ষে বসে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা। বসে থাকি শংকা নিয়ে। কখন ডাক আসে। ডাক আসলে ভয় পাই। কারণ রোগীর অবস্থা খারাপ হলেই সাধারণত ডাক পড়ে। ২১টি বেড আইসিইউতে। প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব গল্প।
অপেক্ষাকক্ষকে দুরন্তপনায় ভরিয়ে রাখে তিন বছরের শিশু জুনায়েদ। ওর মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সিজারিয়ান অপারেশনের পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইনফেকশেনের কারণে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে দুটি কিডনি। ডায়ালাইসিস চলছে। দশদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে আলোচনা বৈঠক। নবজাতক শিশুটিকে দেখছে তার খালা। আর জুনায়েদকে নিয়ে তার বাবা বসে আছে অপেক্ষাকক্ষে। রেখে আসবে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য আত্মীয় নেই।
প্রথমদিন ওকে দেখে বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, হাসপাতালে বাচ্চা নিয়ে এসেছেন কেন? পরে শুনলাম ওদের গল্প। জুনায়েদের বাবার ছোট্ট একটি ভাতের হোটেল আছে। সঞ্চিত সব টাকা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা করাচ্ছেন। কারণ বললেন, আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যদি প্রশ্ন করে মাকে বাঁচানোর জন্য তুমি কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছিলে তাহলে কী জবাব দিব?’ কাল শুনলাম আইসিইউর খরচ চালাতে শেষ সম্বল ভাতের হোটেলটা বিক্রি করে দিবেন। ভদ্রলোক স্বল্পশিক্ষিত, দেখতেও সাদাসিধে। কিন্তু স্ত্রীর জন্য তার ভালোবাসা অপরিসীম।
জুনায়েদের মা শেষপর্যন্ত বাঁচতে পারেননি, ফিরতে পারেননি তাঁর সংসারে। কিন্তু আমি মনে করি তাঁর সন্তানরা বড় হয়ে যখন বাবাকে প্রশ্ন করবে, তখন তারা ঠিকই উপলব্ধি করবে যে তাদের বাবা সর্বস্ব দিয়েও প্রিয় নারীকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করেছিলেন। হাসপাতালে মৃত্যুর রাজ্যপাটের ভিতরেও জীবনের এমন গল্পগুলো এখনও আশা ও বিশ্বাস রাখতে বলে মানুষের প্রতি।

(২) অনেক বছর পর টা্ঙ্গাইলে গ্রামের বাড়িতে ফিরছেন সাধনা ভৌমিক। এটি তার বাপের বাড়ি। সেই কবে বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরও শ্বশুরের ভিটা ছাড়েননি তিনি।
বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন আইসিইউতে। একটু সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন কেবিনে। পরে আবার ফিরতে হলো আইসিইউতে। এবারে লাইফ সাপোর্ট। অনেক খরচের ব্যাপার। দুই ছেলে তাদের যথাসাধ্য দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাঁচানোর কোনো আশা নেই দেখে তারা লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত জানায় ডাক্তারকে। লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার পর মাকে নিয়ে তারা রওনা হয় নানার বাড়ির উদ্দেশ্যে। ছয় ঘন্টার মধ্যেই পরপারে চলে যান সাধনাদেবী। গ্রামের বাড়ির সবুজ প্রকৃতির মধ্যে যেন সুদূর সেই শৈশবের দিনগুলোতে ফিরে গেলেন তিনি।
সাধনাদেবীকে আমি মাত্র এক ঝলক দেখলাম। যখন আইসিইউ থেকে তাকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে অবশ্য অনেক আলাপ হয়েছে হাসপাতালের অপেক্ষা কক্ষে বসে। এক ঝলক দেখলেও তার চেহারা মনে থাকবে অনেক দিন। কোনো যন্ত্রণা নয়, প্রশান্তির এক ছাপ দেখেছিলাম তাঁর চেহারায়। মনে থাকবে সেই প্রশান্তির জন্য। যেন তিনি সব ব্যথা বেদনার ঊর্ধ্বে অমৃতলোকের খোঁজ পেয়েছেন। (চলবে)