সাদিয়া নাসরিন: একটা সময় মনে হতো ভালোবাসা খুব গোপন রাখার বিষয়। আমাদের ব্রটআপ এভাবেই হয়েছে। আমাদের এমন করে শেখানো হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রী ভালোবাসবে শুধু দরজা বন্ধ করে, অন্ধকারে, যেখানে পরস্পরের মুখও দেখা যাবে না।
বিয়ের পর বাবার বাড়ি গেলে স্বামীর সাথে এমন করে কথা বলতাম যেন সে আমার ক্লাস টিচার। পাছে কেউ বেহায়া না বলে! শ্বশুরবাড়ি গেলে শুধু বলতে হবে, তাদের ছেলে আমাকে কতো অবহেলা করে। পাছে কেউ ছেলেকে স্ত্রৈণ না মনে করে!
আজ বিয়ের পনের বছর পরেও তা-ই হয়। জামাই এর সাথে ঝগড়া করার খবর যতো স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, ঝগড়া মিটে যাওয়ার গল্পগুলো তেমন করেই সাবধানে বলতে হয়। শামীম (যাকে আমি বিয়ে করেছি) জীবনে প্রথমবারের মতো সমুদ্রে নেমেছিল আমার সাথে। সেদিন অমাবস্যার অন্ধকারেও আমরা পরস্পরের হাত ধরতে গিয়ে শঙ্কিত ছিলাম। পাছে কেউ বেহায়া না বলে। সেই শঙ্কা পনের বছরেও কাটেনি। এখনো ঘরের ভেতরে পাশাপাশি বসতেও ভয়, যদি ছেলেমেয়েরা দেখতে পায়! ঝগড়া দেখানো যাবে, ভালোবাসা নৈব: নৈব: চ।
সমুদ্র পাড়ের মেয়ে হওয়ায় প্রায়ই সমুদ্র দেখতে যাওয়া নতুন দম্পতির ভালোবাসা-বাসি দেখতাম। ওরা কী সুন্দর করে হাত ধরে পানিতে নামতো, জডিয়ে ধরে, সুযোগ পেলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে টুপ করে একটা চুমুও খেতো….. ভালোবাসার এই অপরূপ মূহুর্তগুলোকে নির্লজ্জতা আর ন্যাকামো ছাড়া কিছু ভাবতেই পারিনি কোনদিন। এখন মনে হয় এই নির্লজ্জতা (!!) দেখে কি কখনও বুকের ভেতরটা কেমন ঈর্ষান্বিত হতো না?
ভালো মেয়ে ভালোবাসে না, প্রেমে সময় নষ্ট করে না। ১২ বছর বয়সে আম্মা বলে দিয়েছিল প্রেম না করতে। প্রেম করলে নাকি সাদা কাগজে দাগ পড়ে যায়, সে দাগ অমোচনীয়। সেই কোন কিশোরী বেলায় জীবনের প্রথম প্রেমের চিঠি নিজে না পড়ে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম জীবনের পাতায় দাগ লাগাবো না বলে! সেই থেকে ভালোবাসা লুকোতে লুকোতে প্রেমেই ভয় ধরে গেছে আমার। আজ তো নিজেরই ঘেরাটোপে বন্দি আমি।
ভালবাসার পূর্ণচন্দ্র গিলে খেয়ে আগুন দিয়েছি সুখের বনে। জং ধরা অস্ত্রের মতো হারিয়েছি সোনালি অতীত; বুকের ভেতর স্বপ্নগুলো অবশ বেদনায় একা কাঁদে। আমি কেবল খুঁজে বেড়াই তারে, ব্যবধান ঘুচানোর মতো সান্নিধ্য আজ আর কোথাও নেই। বর্ষা রাতে কদম ফুটতে ফুটতে বর্ষা চলে যায়………।
আজকাল খুব মনে হয় ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। ভালোবাসা ভীষণভাবে প্রকাশের। ভালোবাসা ভীষণ সুন্দর প্রকাশে। ভালোবাসা-বাসি লুকোতে গেলে কোন ফাঁক দিয়ে যে “মন্দবাসা-বাসি” গুলো অনাহূতের মতো সামনে এসে যায়। রুটিন মাফিক দাম্পত্যের চাপে নিজেদের জন্য আর কোন স্পেস থাকে না। তারপর শুধু অসুস্থ দাম্পত্য টেনে নেয়া অথবা আপাত সুখী সুখী চেহারা নিয়ে জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া।

কোন একদিন এভাবেই অসুস্থ দাম্পত্যের জের টানতে গিয়ে “মাহফুজা” রা নিজ সন্তানকে হত্যা করে “ঝামেলা” মুক্ত হয়। কখনও “সাইদ”রা রুমানা মঞ্জুরদের উপর পরকীয়া(???)র দায় চাপিয়ে আহত করে নিজেই আত্মহত্যা করে। জীবনের কী নির্মম অপচয়!!!
আজকালকার ছেলেমেয়েরা বড়ো সুন্দর করে ভালোবাসে। ওরা প্রেমে সুন্দর, ওরা বিয়েতেও সুন্দর। বিয়ের পানচিনির দিন থেকে ওরা যে আহ্লাদগুলো করে, কী সুন্দর করে ফটোসেশন করে, কী যে মিষ্টি লাগে দেখতে!
বাসুক, ওরা মন খুলে ভালোবাসুক। আহা, কতটুকু সময়ই বা মানুষ পায় ভালোবাসার জন্য এক জীবনে।