সুবিধা-বঞ্চিত নারীরা কি মানুষ?

জেসমিন চৌধুরী: এই লেখাটি যাদের কথা বলার জন্য লিখছি তারা ফেসবুকে নেই, অনলাইন পত্রিকা পড়ার সৌভাগ্য তাদের হয় না। তাই হয়তো খুব একটা সাড়া জাগাতে পারবো না, বরং অনেকের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবো, তবু কিছু কিছু ভাবনা না লিখলে নিজের বিবেককে পঙ্গু মনে হয়, সেজন্যই লিখতে বসা।

গতবছর একদিন হাইজ্যাকারের ভয় উপেক্ষা করে খুব ভোরে ঢাকা শহরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। সবেমাত্র দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে, রাস্তার পাশে তবু কায়িক পরিশ্রমের পেশায় নিয়োজিত লোকজনের কমতি নেই।

Women worker 4এক বহুতল বিশিষ্ট মার্কেট দালানের নিচের সিঁড়িতে বসেছিলেন কয়েকজন নারী। দূর থেকে  দেখে মনে হচ্ছিল সুখ-দুখের গল্প করছিলেন তারা, আবার হালকা তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাঁটিও হচ্ছিল। একজন কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছিলেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

আপনারা এখানে কী করেন?

‘বড়মাইনশের ঘুম ভাঙ্গার অপেক্ষা করি, গেইট খুললে কামে যামু। দেরি হইলে বেগম সাব রাগ করে’, খুব সপ্রতিভভাবে উত্তর দিলেন তাদের মধ্যকার মোড়ল গোছের একজন।

আমি বললাম, আপনাদের সাথে একটা ছবি তুলতে পারি?

মুখে যদিও বললেন, ‘আমাগো ছবি তুইলা আর কী করবেন আফা?’ তবু শাড়ির আঁচল, ওড়না মাথায় টেনে নিয়ে পোজ দিলেন সবাই, মুখে অমলিন হাসি। দাঁত মাজছিলেন যিনি তার হাসিটা হলো দেখার মতো। আমি তাদেরকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিলাম, তারপর চা-ওয়ালাকে ডেকে সবাই মিলে চা খেলাম।

‘আইচ্চা আফা, আফনে কি বিদেশি?’ জানতে চাইলেন একজন।

‘কেন বলুন তো?’

‘আফনের ভাষা আমাগো লাহান, কিন্তু ব্যবহার বিদেশি গো লাহান’

আমি হেসে ফেললাম, ‘তার মানে?’

‘এই দেশে কেউ আমাগোরে মানুষ মনে করে না। মাইনষের মতোন ব্যবহারও করে না। আফনের ব্যবহারটা খুব ভাল লাগসে আফা।‘

Women worker 1রাস্তার পাশে একজন চটের বস্তায় ভাংগা ইট ভরে ঠেলাগাড়িতে তুলছিলেন, আমি ছবি তুলছি দেখে বললেন, ‘খালি খালি ফটু খিচবেন আফা? দশটা টেকা দেন, চা-পানি খাই’।

আমি বললাম, ‘দেখেন আপনার আর আমার মধ্যে আসলে তেমন পার্থক্য নেই, আমরা দু’জনই খেটে খাই। হতে পারে আমি আপনার থেকে অনেক বেশি টাকা রোজগার করি, তবু আমার চোখে আমরা দু’জনই সমান। আপনাকে দশটা টাকা দিলে আপনার জীবন পালটে যাবে না, কিন্তু আপনি আমার থেকে ছোট হয়ে যাবেন। কেন আমার দয়া নেবেন আপনি?’

তিনি হেসে ফেললেন, ‘টেকা লাগবো না আফা। সুন্দর একটা কথা কইসেন। পেট ভইরা গেসে।‘

সেদিনই বিকেলে এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে হলো আরেক অভিজ্ঞতা। তাদের চকচকে বিল্ডিং এর লিফটে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। লিফটের উপরে নোটিশে লেখা, ‘বুয়ারা লিফটে উঠানামা করা নিষেধ।‘

আমাদের সমাজে এধরনের বৈষম্য নতুন নয়, তবু চোখ ভিজে এলো। এতোটাই নির্লজ্জ হয়ে গেছি আমরা যে এরকম একটা কথা নোটিশ ছাপিয়ে দেয়ালে লাগানো শুরু হয়ে গেছে?

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তখনই ছাপার শাড়ি পরা এক মহিলা এক হাতে ছোট একটা টিফিন ক্যারিয়ার এবং অন্য হাতে একটা ছোট কাপড়ের পুটলি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ির দিকে বলিষ্ঠ পায়ে এগিয়ে গেলেন। নির্দ্বিধায় সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া বুয়া সম্প্রদায়ের একজনের জন্য আমার বুকটা টনটন করে উঠলো।  

আমি খুব মহৎ মানুষ নই, মানুষের জন্য আমি মাদার তেরেসা অথবা মহাত্মা গান্ধীর মতো জীবন উৎসর্গ করিনি, কিন্তু মানবতার অপমান দেখলে আমার মতো সাধারণ মানুষেরও কষ্ট লাগে।

এইসব লিফট দিয়েই উঠানামা করে পিঠে স্কুলব্যাগ ঝুলানো কোমলমতি শিশুরা, যারা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। সেইসব ব্যাগের ভেতরের বইগুলোতে লিখে রাখা মানবতাবাদী কথাবার্তা মুখস্ত করে তারা বড় হবে, চাকরি-বাকরি করবে, দেশ চালাবে। আর সেইসাথে লিফটের উপর মানবতা বিরোধী নোটিশও ঝুলাবে।

এই বিষয়টা নিয়ে পরে অনেকের সাথে আলাপ করতে গিয়ে যা জানতে পারলাম তাহলো, বুয়ারা ময়লার বালতি নিয়ে যাবার সময় লিফট ময়লা করে ফেলে, তাই এই ব্যবস্থা। একজন বললেন, ‘এদেরকে চেনেন না আপনি, বাইরে থাকেন তো তাই। ভীষণ আরামপ্রিয় আর ফাঁকিবাজ এরা’।

Women worker 3এসব কথা বলার সময় তারা ভুলে যান যে, বর্তমানে বাইরে থাকলেও আমি বাংলাদেশেই বড় হয়েছি, বাংলাদেশেই থেকেছি জীবনের বেশির ভাগ সময়, আমার বাচ্চাদেরকেও বড় করেছি বাংলাদেশেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমি এক মুহুর্তের জন্যও নিজেকে এ ধরনের সংকীর্ণতা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবি না।

ইদানিং একজনের ফেসবুক পোস্টে সমগ্র বুয়াসমাজ সম্পর্কে একটা বাজে মন্তব্য দেখে আশা করেছিলাম কেউ তার প্রতিবাদ করবেন, কিন্তু কমেন্ট থ্রেডে দেখলাম একের পর এক অনেকেই এসে একচেটিয়াভাবে বুয়া আর ড্রাইভার জাতি কত খারাপ তা নিয়ে মন্তব্য করলেন।  

এসব মন্তব্যের প্রতিবাদে আমার দেওয়া একটা স্ট্যাটাসে এলো আরো নানান রকম মন্তব্য।

বুয়ারা নিয়মিত কাজে আসে না, ঝুলিয়ে রাখে, কাজে ফাঁকি দেয়, সব মিলিয়ে তাদের কাছে ধনী সমাজ আজ জিম্মি। এসব কথা শুনলে আমার ভালই লাগে। প্রতি হাজার বছরে প্রচণ্ড প্রতাপশালী ডাইনাস্টিরও পতন হয়, ক্ষমতা হাত বদলায়, আমাদের ধনী সমাজের কেন হবে না? তারা যখন বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপন করেছে, নামেমাত্র বেতনে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে অনেক বিলাসিতা করেছি আমরা। সময় না হয় এবার তাদের পক্ষেই যাক।

একবার পরিচিত একজনের বাসার কাজের মেয়ে আমাকে বলেছিল, ‘আপনাদের সাথে কি আর আমাদের তুলনা হয় খালা?’ তার কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, স্বামীর রোজগারে মেকাপ কেনা, কাজের বুয়ার উপর হম্বিতম্বি দেখানো মেমসাহেবদের চেয়ে এইসব খেটে খাওয়া মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা বেশি হওয়া উচিত।

একজন নারীবাদী হিসেবে আমি সুবিধাবঞ্চিত কর্মজীবী নারীদেরকেও আমার সমকক্ষ ভাবি। শ্রেণী বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সব নারীদের সার্বিক মুক্তির জন্য কথা বলতে চাই। আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি কাজ করে সবচেয়ে কম অর্থ রোজগার করেন যারা, যাদের জব ডেস্ক্রিপশন বলে কিছু নেই, সিক লিভ নেই, তাদের প্রতি কি আমরা আরো একটু সহনশীল, শ্রদ্ধাশীল হতে পারি না?

আমরা কেউ কি কখনো কোনো ভাল বুয়া দেখিনি? কারো ড্রাইভার কি ভাল মানুষ হয় না? আমি ছোট থেকে এসব পেশার যত মানুষের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সেবা নিয়েছি, তাদের মধ্যে সবাই ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন, তা বলবো না, কিন্তু অনেকেই তাদের দারিদ্র্য সত্ত্বেও অনেক সৎ, কর্মঠ এবং অমায়িক ছিলেন।

তাছাড়া সব পেশায়ই ভাল মন্দ আছে, তাহলে কেন এই পেশার মানুষ সম্পর্কে আমরা একচেটিয়াভাবে খারাপ মন্তব্য করবো? বিশেষ করে যেহেতু বেচারারা এসে এর প্রতিবাদও করতে পারবে না?

বড় হবার দিনগুলোতে মানুষের মধ্যকার এইসব বৈষম্য আমাকে অনেক ভাবিয়েছে, বইয়ে শেখা কথাবার্তার সাথে জীবনকে মেলাতে না পারার বিভ্রান্তি কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু বড় হবার পর সমাজের একজন মানুষ হিসেবে আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি এইসব বৈষম্যমূলক আচরণে। তারপরও কী করে যেন একটা মাঝামাঝি স্থানে আটকে গেছি। কখনো পরিচিতজনেরা আমাকে বকা দিয়েছেন কাজের মানুষকে আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তোলার জন্য, আবার কখনো আমার নিজের বাচ্চারাই তাদেরকে যথেষ্ট সম্মান দিচ্ছি না বলে আমাকে তিরষ্কার করেছে।

নিজে যথেষ্ট মানবিক হতে না পারার লজ্জাটুকু স্বীকার করে নিয়েই আশা করবো, আমরা একদিন মানুষকে তার জন্ম, অবস্থান, বা মাসিক আয় অনুযায়ী বিচার না করে শুধুই মানুষ হিসেবে দেখতে পারবো, আর সেইদিন যেন খুব বেশি দূরে না হয়।

শেয়ার করুন: