এই দু:সময়ে আপনাদের ভীষণ মিস্ করছি মা

উপমা মাহবুব: শ্রদ্ধাভাজনেষু, অসংখ্য মানুষ আপনাকে ‌’মা’ ডাকে। আমি কেন যেন ঠিক সেভাবে ভাবতে পারি না। ‌‌‌‘জাহানার ইমাম’ নামটা আমার আত্মার সাথে মিশে আছে। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির রাজাকার বিরোধী আন্দোলন চলার সেই উত্তাল সময়ে আপনি ১০/১১ বছর বয়সী একটি মেয়েকে সম্মোহিত করেছিলেন। আপনার লেখা একাত্তরের দিনগুলি, আপনার জীবনাদর্শ আমার ভিতর সংগ্রামের বীজ বুনে দিয়েছিল, দেশদ্রোহীদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছিল। সেই রেশ আজো কাটেনি। আপনার নাম শুনলে কিশোরী বেলার মতো এখনো আমার রক্তে আগুন জ্বলে, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসতে চায়।

Moha and Jahanaraআপনার কথা আমি খুব ভাবি। কল্পনায় আপনাকে দেখতে পাই। স্লিভলেস ব্লাউজ আর শাড়ি পড়া তরুণী আপনি কোনো বাড়িতে বেড়াতে গেছেন, আশেপাশের মানুষ সুচিত্রা সেন এসেছে মনে করে সেই বাড়িতে উঁকি দিচ্ছে। আপনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যুদ্ধচলা অবস্থায় ঢাকার রাজপথে গাড়ি চালাচ্ছেন। সাদা শাড়ি পড়ে ঘোমটা টেনে আপনি মঞ্চ আলো করে বসে আছেন।

আপনার কাছে চিঠিটা লিখতে লিখতেই জানতে পারলাম চলে গেছেন আরেক ‘মা’ -হাজার চুরাশির মা মহাশ্বেতা দেবী। আচ্ছা, আপনাদের দু’জনের কি এখন দেখা হবে? কি নিয়ে আপনাদের কথোপকথন হবে? জানি আপনি মহাশ্বেতা দেবীর কাছে বাংলাদেশ, ভারত, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে জানতে চাইবেন। আপনারা হয়তো কথা বলবেন মানবতা নিয়ে, আপনাদের সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের নানাদিক নিয়ে। মহাশ্বেতা দেবী যখন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ তুলবেন, আপনার নিশ্চই ভাল লাগবে।  ধর্মীয় উন্মাদনার বিষ পান করে আপনার প্রিয় বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের একটি অংশ মানুষ হত্যার নির্মম খেলায় মেতেছে যখন সেই প্রসঙ্গ উঠবে তখন কেমন লাগবে আপনার?

মহাশ্বেতা দেবী তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন প্রান্তিক মানুষ বিশেষ করে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায়। তিনি বলেছিলেন ‘আমি নদীর মতো, বড় নদী নয়, ছোট নদী – আঁকা-বাঁকা বয়ে চলার পথে আদিবাসীদের জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়েছি। কিভাবে, কেন অথবা কখন সেটা ঘটলো তা আমি নিজেও বলতে পারবো না’। আপনি কিন্তু ভুলেও তার কাছে জানতে চাইবেন না তাঁর সেই প্রিয় আদিবাসীরা এখন কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মহান মানুষটির আত্মা কষ্ট পেতে পারে।

আপনি আপনার প্রথম সন্তান রুমীকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজের জন্য মহাশ্বেতা দেবী সংসারের মোহ ত্যাগ করেছিলেন। আমি বড় দুর্বল মানুষ।। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারি না, নেতৃত্ব দেয়ার কথা তো ভাবতেই পারি না। মাঝে মাঝে দু’এক কলাম লিখি। কোথাও অন্যায় হলে, আমার দেশপ্রেমে আঘাত লাগলে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি।

তারপরও আপনি যে দেশপ্রেমের বীজ বুনে দিয়েছিলেন তা ডালপালা মেলেছে। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোগে আমরা হাজার হাজার মোমবাতি জ্বেলে আপনাকে স্মরণ করেছিলাম, দেখেছেন নিশ্চয়ই। মহাশ্বেতা দেবীর পাহাড়ী মানুষের কান্না আমার মতো অনেক বাঙালির বুকে শেলের মতো বিঁধে।

image-8545
উপমা মাহবুব

সামনে আমাদের খুব কঠিন সময়। ধর্মের নামে ওরা হিন্দু, বোদ্ধ, দলিত,  আদিবাসী কাউকেই টিকতে দেবেনা। ওরা আবারো বাংলাকে বদ্ধভূমি বনাতে চায়, মুক্তবুদ্ধির চর্চা বন্ধ করতে চায়। ঠিক এরকম একটা সময়ে আমার ভীতু মন বাংলাদেশের  স্বাধীনতা লাভের ইতিহাস, ধর্মরনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিরসা মুন্ডা হতে চায়।

কিছুদিন ধরে তাই আপনার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মহাশ্বেতা দেবীর বই পড়ে বিদ্রোহী হবার তীব্র তাড়নায় টগবগ করা সেই দিনগুলো। আমি মুখিয়ে আছি, আপনার মুখে ‘জয় আমাদের হবেই’ শোনার জন্য। আপনি ডাক দিবেন, আমরা সবাই রাস্তায় নেমে আসবো। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আপনাদের ভীষণ মিস করছি মা।

তারপরও প্রতিদিন বেঁচে আছি, নিজের জায়গা থেকে একটু একটু করে লড়াই করে যাচ্ছি এই বিশ্বাস নিয়ে যে,  জয়-আমাদেরই হবে। নিশ্চয়ই হবে।

শেয়ার করুন: