ড. ইউনূসের মশাল বহন এবং আমাদের দুর্ভাগ্য

শারমিন শামস্: আমাদের কথা আমরাই বলি। আমাদের কথা বলার আর কেউ নাই। জঙ্গি হামলা হোক, ক্রসফায়ার হোক, পদ্মা সেতুর দুর্নীতি হোক, সুন্দরবন ধ্বংস হোক, পাটকল বন্ধ হোক, একের পর এক খুন হোক, জলাভূমি ভরাট করে দালান তোলা হোক, বন্যায় ভেসে যাক সব, রিলিফের অভাবে কষ্টে মরুক মানুষ- সব কিছু নিয়ে আমরাই গলা ফাটাই।

Moonmoon-editedআমরা মানে আম জনতা বলা হয় যাদের। আমাদের একটা প্ল্যাটফর্ম আছে- ফেসবুক। সেইখানে আমরা গলা ফাটাই। অথবা ব্লগে লিখি। অথবা কোনো কোনো সাংবাদিক মুক্তমত অথবা কলাম লেখেন। এর বাইরে আমাদের চিৎকার, হাহাকার, আর্তনাদ প্রকাশ করার কেউ নেই।

আমাদের মাথার উপরে এমন কেউ নেই যিনি আমাদের কণ্ঠ হয়ে পৌঁছে যাবেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে, সে দেশে হোক বা বিদেশে। গত ছেচল্লিশ বছরে আমরা এমন একজন মানুষ পেলাম না যাকে আমরা এমন একটি স্থানে রাখতে পারি, যে রাজনীতির কলুষতা, স্বার্থসিদ্ধি আর ভণ্ডামির বাইরে থাকবেন। যাকে নিয়ে কোন বিতর্ক থাকবে না। পেলাম না। আফসোস।

যাদের আমরা পূজার আসনে রেখেছি, যাদের আমরা ভালোমানুষের প্রতিভূ বলে জানি, যাদের ইমেজ দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশে, যাদের ঝুলিতে পুরস্কারের ঝনঝনানি, অবাক হয়ে দেখি, দেশের সবচেয়ে বড় সংকট মুহূর্তগুলিতে তারা নির্বাক, তাদের মুখে রা নেই, যেন তারা ভুলে গেছেন কথা কইতে, কিংবা তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই।

শুনতে পাই গণতন্ত্রে বিরোধী দল খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। সরকার উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিলে, ভুলভাল করলে, বাড়াবাড়ি করলে বিরোধী দল তেড়ে আসবে। সরকার তখন সাবধান হবে। খুব সহজেই যা খুশি তাইয়ের রাজনীতি বিরোধী দল থাকলে চলে না। এখন আমাদের বিরোধী দল নিয়ে কথা বলা অবান্তর। আমরা সেই আশা ছেড়েও দিয়েছি। আর যখন এরকম আপত্তি তোলার মতো বিরোধী দল ছিল, তখন দেখেছি নিজেদের স্বার্থচিন্তা, আখের গোছানো আর নিজেদের ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া তাদের বিরোধিতার উদ্দেশ্য আর কিছু থাকে না।

তাইলে কারা বলে জনগণের কথা? কারা সরকারের কাছে পৌঁছে দেয় আমাদের আপত্তি, আমাদের দুশ্চিন্তা? কেউ কি আছেন?

সকালে উঠে খবরে দেখলাম, ডক্টর ইউনুস বইবেন অলিম্পিকের মশাল। ভালো কথা। গর্ব হবার কথা। হয় না কেন? যদি আমি তাকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক আর তার নানা স্ববিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা নাও তুলি, তবু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, শান্তিতে নোবেল পাওয়া, অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা এবং একসময়  রাজনীতিতে আসার ইচ্ছাপোষণকারী ড. ইউনুস গত একবছরে দেশে যে ঘটনাবহুল পরিস্থিতি, তাতে কী ভূমিকা রেখেছেন?

জঙ্গি মৌলবাদীদের ক্রমাগত হুমকি-ধমকি মৃত্যু পরোয়ানা, সরকারের ৫৭ ধারা, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, সিপি গ্যাং, অমুক-তমুক সবার গালাগালি মাথায় নিয়েও তো আমরা আম পাবলিক চিৎকার করতেই থাকি। এতো এতো মৃত্যুর পরও ব্লগার, লেখকের কলম বন্ধ হয়নি। মাথার উপর মৃত্যুর হুমকি নিয়ে চিৎকার চ্যাঁচামেচি তো চলছেই।

আমার জানতে ইচ্ছে করে, মৃত্যু হুমকির চেয়েও বড় কোনো হুমকি বা কারণ কি থাকে এইসব বড় বড় মানুষের কাছে, যার কারণে তারা চুপ করে থাকেন? যার কারণে গুলশান হামলা, জঙ্গিবাদের বিস্তার কিংবা সুন্দরবন রামপাল প্রকল্প নিয়ে তুমুল বিতর্কর পরও তারা নির্বাক থাকেন? কেন থাকেন? তারা কি আমাদের চেয়েও নাজুক পরিস্থিতিতে থাকেন? নাকি আমাদের জীবনের চেয়ে তাদের জীবন মূল্যবান বলে ‘ছোটোখাটো’ এইসব ব্যাপারে জড়াতে চান না?

আমি দুঃখিত, বন্যায় যখন ভেসে যায় পুরো দেশ তখন অলিম্পিকের মশাল হাতে নোবেল লরিয়েটের দৌড় আমার কাছে সার্কাজম ছাড়া আর কিছু নয়। এমন একটা মানুষ পেলাম না, রাজনীতি, স্বার্থচিন্তার বাইরে থেকে যিনি শুধু আমাদের কথা বলবেন, আমাদের হয়ে পাশে দাঁড়াবেন, চিৎকার করবেন, ইস্যু নিয়ে যিনি উঁকুন বাছার খেলা খেলবেন না, কোনো কোনো বিষয়ে বিস্ময়করভাবে চুপ থেকে তাকে এড়িয়ে যাবেন না!

এমন একটা মানুষ পেলাম না যিনি গায়ে-গতরে নেমে আসবেন মাঠে, কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়ানোর ইচ্ছায় নিজের সম্পদ আর জবান সাবধানে হেফাজত করবেন না! এটাই এই কপালপোড়া জাতির সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের জায়গা।

শেয়ার করুন:

আপা আপনি কি জানেন না নিজে বাচলে বাপের নাম, উনাকে এবং উনার প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে টানাহেচড়া ও টার্গেট করা হযেছে, এদেশে কতজন তার প্রতিবাদ/ প্রতিরোধ করতে পেেরছে/ এগিেয়ে গিয়েছে ?

এ বিষয়ে তিনি বলেছেন সবাই সবকিছু এড্রেস করতে পারে না। তিনি যা পারেন তা করছেন। এখন কথা হচ্ছে বন্যা, জঙ্গিবাদ, হেফাযত, বিনপি, আওয়ামীলীগ এসব নিয়ে তাঁর মাথা ঘামানো কি খুবই জরুরী? তাহলে শুধু তিনি কেন মাশরাফি, সাকিব, মুস্তাফিজ, রুনা লায়লা অন্য সব প্রফেশনের সবাইকেই দায়ী করা উচিৎ। যারা নিজ গুনে দেশের নাম উজ্জল করতে পারছে, তাদের উৎসাহ দেয়া আমাদের উচিৎ। মারামারি, কাদা ছোড়াছুড়ি করার জন্য আমরা তো আছিই, ছেড়ে দিন না তাদের যাদের কর্মকাণ্ডের জন্য এতো সমস্যাতে থেকেও বিশ্বকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি দেখ আমরাও পারি…