কন্যারা সব আলোর মশাল জ্বালো

মলি জেনান: “আমি ভীষণ খুশি এই ভেবে যে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে হাঁটতে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে যাবো, ও আমার হাত ধরে বাকি পথটা নিয়ে যাবে। ওর বংশের প্রদীপ জ্বালাবার কোন দায় নেই, ও মানবিকতার মশাল জ্বালবে যে মশালের আলোতে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর হবে…… ।”

With daughterকিছুদিন আগেই কথাগুলো লিখেছিলাম। হ্যাঁ, আমি তাই চেয়েছিলাম, আমি ভীষণভাবে চেয়েছিলাম আমার/আমাদের সমস্ত সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে ও একদিন বাতিঘর হয়ে উঠবে। যে হাতে আমি মানবিকতার মশাল তুলে দিতে চেয়েছিলাম, সেই হাত আমায় ছেড়ে গেছে আজ এক মাস হলো।

নিজের দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হই, ওকে ছাড়া আমি দিব্যি বেঁচে আছি! আমার জীবনের সমস্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলমান!! এক মূহুর্ত যে আমায় ছাড়া থাকতে পারতো না, সেও দিব্যি একা একেবারে একলা ছোট্ট মাটির ঘরে ঘুমাচ্ছে! যে ঘুমের মধ্যেও আমাকে হাতড়ে ফিরতো, সে কী করে এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন একা বিজন ঘরে ঘুমায়? তিল তিল করে যাকে আমি আমার মধ্যে ধারণ করেছি, সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে যাকে পৃথিবীতে এনেছি, একটু একটু করে যাকে বসতে, দাঁড়াতে, হামাগুড়ি দিতে, কথা বলতে ও হাঁটতে শিখিয়েছি, সে কী করে একা একলা চলে যায়, যেতে পারে! প্রতি মূহুর্তে যার গন্ধ, স্পর্শ ও কথা শুনতে পাই, সে কী করে দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকে!!

Meye 2 চোখের কোনে জল এলে আমি স্পষ্ট অনুভব করি আমার কন্যা দুই হাতে আমার মুখ ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে “মা-মনি তুমি কান্না কলো না, কান্না কলো না, আমাল কষ্ত হয়”। ঘুমোবার সময় আমি দিব্যি শুনতে পাই “মা-মনি সোজা হয়ে শোও আমি তোমাল বকুল তলায় (বুকে) ঘুম কলব। মা-মনি মিয়াও এলো গল্প বলো, ফ্যান এলো গল্প বলো, মুশি’ল (মুশি হলো খুশি) গল্প বলো, কাঠবিড়ালী’ল কবিতা বলো, লিচু চোল(র) বলো”।

আমি ওর সব কথা শুনতে পাই। কিন্তু গত এক মাসের একটি দিনেও আমি ওকে ডাকতে পারিনি, আদর দিতে পারিনি, বকা দিতে পারিনি, কোন গল্প-কবিতা-গান বলতে পারিনি। এই না পারা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সমস্ত গল্প-কবিতা-গান আমার বুকে পাথরের মতো জমে আছে, এই পাথর আমি কী করে সরাবো?

ওর ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র, বই-খাতা-খেলনা সব গুছিয়ে আলমারিতে তুলে রেখেছি, ওগুলো দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকলে নাকি আমার নিজেকে সামলানো সহজ হবে! বেচেঁই যেহেতু থাকতে হবে, তাই যন্ত্রণা সহজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি; কিন্তু সময়- এই যে দিনের প্রতিটা মূহুর্ত, ২৪ ঘন্টা ও আমায় সময় দিতো, আমার অভিন্ন সত্ত্বা হয়ে ছিল, এটাকে কোথায় তুলে রাখবো? কোন আলমারিতে? কোন বক্সে? আহ্ যদি এক মূহুর্তের জন্যও এটা কোথাও তুলে রাখতে পারতাম, কিন্তু এটা কোথাও তুলে রাখবার নয় এটা আজীবন আমাকে লালন করেই এগিয়ে যেতে হবে…..।

জীবনে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গিয়ে বহুবার আমাকে একা হতে হয়েছে, জীবনের নিষ্ঠুর রুপ আমি বহুবার দেখেছি, কিন্তু হার মানিনি, আগামীর নতুন সূর্যের প্রত্যাশায় মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

Meyeআমি আধো আধো স্বরে আমার কন্যার গান শুনতে পাই-

“একদিন সূর্যের ভোর

এক ‍দিন সূর্যের ভোর

এক দিন সূর্যের ভোর আসবেই—

বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়

এক দিন সূর্যের ভোর আসবেই—– ”

আমি সেই সূর্যের ভোরের প্রত্যাশায় থাকি আমার চোখে আমার কন্যা সেই ভোর দেখবে। আমি গভীর প্রত্যয়ে বুক বাঁধি, এ দু:সময় আমি/আমরা কাটিয়ে উঠবোই। আমার এক বাতিঘর হারিয়ে গেছে, কিন্তু পৃথিবীর সকল কন্যারা এক-একটি বাতিঘর হয়ে উঠো। চরম দু:সময়ে ভেঙ্গে পড়ো না, ঘুরে দাঁড়াও, নিজেকে একা অসহায় ভেবো না কখনো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো আমি আছি। আমার কন্যা আমাকে একা একলা করে দিয়ে সবার করে দিয়ে গেছে…..।

শেয়ার করুন: