সম্পর্কের স্বীকৃতিটুকুও যখন দূরঅস্ত

কাজল দাস: ছুটির দিনের এক বিকেলে বসে আছি ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে। পাশে একজন তরুণী কথা বলছে ফোনে। বোঝা যাচ্ছে বিশেষ কারও সাথে দেখা করতেই আসছে। মাথায় সুন্দর বাহারি হিজাব। দেখতে অনেক সুন্দরীই লাগছে। মেয়েটার সাথে তাঁর এক বান্ধবীও আছে।

আমি ওর ফোনের কথা ওভারহিয়ার করলাম। সে তাঁর মাকে বলছে- ‘মা, তুমি চিন্তা করো না, আমি নামাজটা পড়েই এসেছি। বিশ্বাস রেখো, নামাজ ঠিকঠাক রেখেই আমি ঘুরছি’।

Kajal Dasফোন শেষে সাথে থাকা তাঁর বান্ধবীকে ও বলছে- ‘বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসে কত কিছু যে করতে করতে হচ্ছে, আমি আর সামলাতে পারছি না, হাঁপিয়ে উঠছি একদম’। আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ওর মায়ের কথা ভাবলাম। দেখতে হয়তো আটপৌড়ে কোনো নারী। হয়তো আমার মায়ের মতোই হবে। স্বামী হয়তো তাঁকে বার বার তাগাদা দিচ্ছে, এতোবেলা হয়ে গেলো, মেয়ে এখনও বাইরে কেনো? মেয়েটা শহরে বড় হয়েছে, পড়ছে, ঘুরছে, আড্ডা দিচ্ছে। তাঁকে নিয়ে কত ভয় আর শঙ্কা তাঁর।

চারপাশে আমরা না চাইতেই কত কিছু ঘটছে রোজ। আমি মেয়েটার কথা ভাবলাম। সে হিজাব পরছে, নামাজ পড়ছে,তবুও সে তার ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে চায়। বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটু ঘুরতে চায়। লেকের ধারে বসে একটুখানি খুনসুটি আর বাদাম চিবোতে চায়। নাও চাইতে পারে। হয়তো রেস্তোরা আর ফাস্ট ফুডেই বেশি যায়। কিন্তু সে প্রকাশ করতে চায় নিজেকে, নিজের সম্পর্কটাকেও। তাই সাথে থাকা বান্ধবীকে বলছে- ‘আমি আর সামলাতে পারছি না’।

কী এক আকুতি তাঁর, সামলাতে পারছে না সে। আচ্ছা মেয়েটা কী সামলাতে চায়? একটা ছেলেকে সে ভালবাসে, লুকিয়ে লুকিয়ে আর পারছে না। এবার কি সে প্রকাশ করতে চায় নিজেকে? নাকি সে চাইছে, সম্পর্কটা বাবা-মায়ের কাছে স্বীকৃতি পাক!  

সমাজের প্রতিটি সম্পর্কই স্বীকৃতি চায়। এই স্বীকৃতি পাওয়া না পাওয়ায় ব্যক্তিমাত্রই আহত বোধ করে। একটা দ্বন্দ্বের দিকে তাকে নিয়ে যায় ক্রমাগত। এই দ্বন্দ্ব ব্যক্তিকে ক্রমশ তোলপাড় করে অনবরত। এরকম আমি আরও একজনকে জানি, যে প্রেম করেছে, তার চেয়ে বয়সে বড় কারও সাথে। নিজেদের মধ্যে অনেক বৈপরিত্য আছে। বয়সে, পেশায়, স্ট্যাটাসে, ধর্মে, তবুও নিজেরা নিজেদের মিলিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চায়। নিজেদের তুমুল প্রেমকে নিয়ে যেতে চায় এক কল্লোলিত তরঙ্গের কাছে। এরা নিজেরা চারপাশে অনেক উদার মনের মানুষের সাথে থাকেন।

আমি দেখেছি এরা নিজেরাও তাদের এই অসম প্রেমটাকে নিয়ে নিঃসংকোচ হতে পারছেন না। তাঁরা কোথাও যেতে পারছেন না, বলতে পারছেন না। তবুও হয়তো কোথাও বসে দু কাপ কফির সাথে জীবন মিশে যাচ্ছে জীবনের নিয়মে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেলফোনে কথা বলতে বলতে-আকাশে হেলান দিয়ে তাদের পাহাড়টা ঘুমিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব প্রেম দুজনার মনে নিয়ে আকাশ ছড়ায়ে আছে তাঁদের মনের আকাশে।

তবুও তারা নিজেদের স্বীকৃতি চান, এটা নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছা। এই যে ইচ্ছা এটা প্রতিটি ব্যক্তির মনোজাগতিক এজেন্সি। এই এজেন্সিটা ব্যক্তি সবসময়েই প্রকাশ করতে চায়। গোপনীয়তা সে আসলে চায় না, কিন্তু গোপন হয়ে যায়, ফলে প্রতিটি গোপন বেদনাতেই থাকে প্রকাশিত হওয়ার এক তীব্র মর্মর ধ্বনি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.