সাদিয়া নাসরিন: আমি বাংলাদেশ, বাংলাদেশই আমি। কতো বয়স হলো আমার? ৪৪ বছর ৭ মাস ১৫ দিন। সিনা টান করে দাঁড়ানোর বয়স এখন আমার। কিন্তু পারছি না। আমাকে দখল করে নিয়েছে এক দুরারোগ্য ক্যান্সার। আপাত: নিরীহ চেহারার “বহুদলীয় গণতন্ত্র” নামের সুঁই দিয়ে পরিকল্পিতভাবে আমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল এই জীবাণু আজ থেকে ৩৭ বছর আগে। আজ সেই জীবাণু সংক্রমিত হতে হতে ক্যান্সারে পরিণত হয়ে প্রায় পুরো শরীরটাই খেয়ে ফেলছে।
এই ক্যান্সারের নাম – ধর্মীয় মৌলবাদ।

অবশ্য আমার পুর্বসুরীদের শরীরেও এই রোগের সংক্রমণ ছিল। ধর্মীয় মৌলবাদি রাজনীতির নানা ভেল্কিবাজির এক পর্যায়ে “দ্বি-জাতিতত্ত্ব” নামে এক অদ্ভুত চিকিৎসায় পাকিস্তান নামের এক ওষুধ তৈরি করে এই রোগ নির্মূলের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। মৌলবাদি রাজনীতির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান নিজেই এক ভয়ঙ্কর ক্যান্সার হয়ে চেপে বসে।
আর তখনই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এক হয়ে মুসলমান জাতীয়তাবাদের পাকিস্তান নামক ক্যান্সারকে উপড়ে ফেলে দিয়েছিল মুক্তিকামী জনতা।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমার জন্ম হয়। জন্মের পরই আমার কানে শোনানো হলো সেই শুদ্ধ সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। লাল সবুজ পতাকা জড়িয়ে বাংলা ভাষার নামে আমার নাম রাখা হয় “বাংলাদেশ”। বিশ্ব পরিবারের সদস্য হলাম আমি “স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বাংলাদেশ”।
আমার কোনো ধর্ম নেই। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই আমার, আমি সবার। আমাকে উপহার দেয়া হলো এক অসাম্প্রদায়িক সংবিধান। যার মূল ভিত্তি ছিলো ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এরা আমার মগজ, ফুসফুস, হ্রদযন্ত্র এবং মেরুদণ্ডকে তৈরি করতে থাকে। আঁধার কেটে আলোর পথে যাত্রা শুরু হয় আমার। আমার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চার জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ , সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে সাথে নিয়ে পরম মমতা ও দুরদর্শিতায় আমার জীবন গড়ে দিতে থাকলেন। আমাকে দেখালেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত পথ। সে পথ ধরেই খুব অল্প বয়সে আমি নিজের অবস্থানও করে নিলাম আমাদের বিশ্ব পরিবারে।
কিন্তু সবকিছু এমন ঠিক থাকলো না। আমাকে ঘিরে শুরু হয়ে গেল দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। আমার বয়স যখন তিন বছর আট মাস, তখনই “বাংলাদেশ” নামের এই শিশুটির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দখল নিল চক্রান্তকারী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি। এরপর থেকে বারবার হাত বদল হতে থাকলো আমার ভাগ্য। এক সময় জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে আমার পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া হলো আইন করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়ে গেল। তার সাথে শুরু হলো আমার মগজের দখল নেয়ার এক দূরদর্শি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। ওরা জানে, আমার মগজের দখল নিতে হলে আগে আমার মূলভিত্তিগুলো ধ্বংস করতে হবে।
৬ এপ্রিল ১৯৭৯, আমার বয়স তখন সাত বছর চার মাস। জিয়াউর রহমান এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আমার সেক্যুলার পরিচয় ধ্বংস করে দিল। সংবিধানকে কেটে ছিঁড়ে ধর্মের ট্যাটু লাগিয়ে দেয়া হলো আমার কপালে। ওপেন হার্ট সার্জারি করে বাদ দেয়া হলো সমাজতন্ত্রকে। আমার বোনম্যারো রিপ্লেস করে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এর জায়গায় লাগিয়ে দিল পাকিস্তানি মৌলবাদি জাতীয়তার আদলে “বাংলাদেশী” জাতীয়তাবাদের ব্রেইনওয়াশ।
খুব সচেতনভাবে মৌলবাদি ক্যান্সারে আক্রান্ত পাকিস্তানী ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া হলো আমার শরীরে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজাম ইসলামসহ নিষিদ্ধঘোষিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে লাগলো। চালু হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক রাজনীতি। এই রাজনীতির প্রধান কুশীলব এবং সুবিধাভোগী হয়ে উঠলো জিয়াউর রহমান এবং তার গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি।
শুরু হলো ধর্মের নামে মৌলবাদি জঙ্গি রাজনীতি। এই ধারাবাহিকতায় জামায়াতে ইসলাম সরাসরি রাজনীতির মাঠে চলে এলো। ৭১ এর ঘাতক দালাল রাজাকার যুদ্ধাপরাধিরা আমার দিকে হাত বাড়াতে শুরু করলো। আমাকে পাকিস্তানি “কোলাবোরেটর” রাষ্ট্র বানানোর আন্তর্জাতিক চাক্রান্ত চলতে থাকল। বিকৃত হতে থাকলো মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। জয়বাংলা কোনঠাসা হতে হতে নিষিদ্ধই হয়ে গেল।
বিএনপি’র সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এক সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় চলে এলো জামায়াত। এরপর থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতির প্রসার ঘটতে থাকলো। প্রশাসনে, বিচার বিভাগে ঢুকিয়ে দেয়া হলো ধর্মীয় মৌলবাদের জীবাণু। আমার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে পায়ে মাড়িয়ে লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে যেতে থাকলো ঘাতক রাজাকারের ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতি। বিনিয়োগ বাড়তে থাকলো ধর্মীয় মৌলবাদি অর্থনীতিতে।
সুপরিকল্পিতভাবে ক্যান্সার সংক্রমণ সব চাইতে বেশী পরিমাণে ছড়িয়ে দিল শিক্ষা ব্যবস্থায়। স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের টার্গেট করে তাদের পেছনে বিনিয়োগ শুরু করলো। তরুণরা পথভ্রষ্ট হতে থাকলো। এভাবে তৈরি হলো একশ্রেণীর পথভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবী যারা মৌলবাদী রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকিকরণের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে থাকে।
এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়ে যেতে থাকলো এদেশে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হয় না, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে না। “পাক হানাদার” “রাজাকার” “আলবদর” এই শব্দগুলোর ইতিহাস জানানো হয়না। শিক্ষা,অর্থনীতি,সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রভাবিত হতে থাকলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অন্ধকার ছায়ায়।
৯ জুন ১৯৮৮। স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ ঘোষণা করলো “রাষ্ট্র ধর্ম” ইসলাম। ১৫ বছর ৬ মাস বয়সে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমান হলাম। অধিকাংশ স্কুলে-মাদ্রাসায় এসেম্বলি হয় না, জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে প্যারেড করে না, একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরিতে যায় না। বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা দিবসের মধ্যে প্রায়ই গোলমাল করে ফেলে। পহেলা বৈশাখসহ বাঙ্গালী সংস্কৃতির গায়ে “বিজাতীয়” তকমা লাগিয়ে দেয়া হলো সুকৌশলে। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য করে দিল।
ধীরে ধীরে এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হলো যারা শহীদ মিনারে যায় না,পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় যায় না। এরা নাটক দেখে না, ছবি আঁকে না। এরা লালন চিনে না, হাসন জানে না, আব্বাসউদ্দিন-আব্দুল আলীমের নামও শোনেনি। জারি-সারি-বাউল- ভাটিয়ালি গানের সুর এরা জানে না, চিনে না একতারা দোতারা। এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্য শ্লোগান শোনা গেল “বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান”। এভাবেই আমার বুকে ধর্মীয় মৌলবাদের চূড়ান্ত কামড় বসায় জামায়াতী রাজনীতির জারজ ফসল “ইসলামি জঙ্গিবাদ”।
সংক্রমণ ছড়াতে ছড়াতে এই ক্যান্সার আমার প্রায় পুরো শরীরটাকেই গ্রাস করে ফেললো। আর ধর্মান্ধতার নীরব বিষ আকণ্ঠ গিলে নীল হয়ে আমার সন্তান পড়ে থাকতে লাগলো লাশকাটা ঘরে বেওয়ারিশ হয়ে। আমি রক্তাক্ত হই, কিন্তু শেষ হয়ে যাই না। রক্ত নদী পেরিয়ে জন্ম কিনা, তাই ভীষণ জীবনী শক্তি আমার। এই দুঃসময়ে আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা সোনার টুকরো তারুণ্য। তারা আমার জন্মের ইতিহাসকে সবার কাছে তুলে ধরলো। আমাকে ওই ধর্মচোষাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তুলে দিল সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক দলের কাছে, সেই মানুষের হাতে, এদেশের মানুষ বাঁচার আশায় এখনো যার কাছে যায়। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি আমার হাল ধরলেন। তাঁর হাতেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি পর্যুদস্ত হতে লাগলো। জাতির জনক হত্যার বিচার হলো। তাঁর হাতেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু হলো। যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের জন্য শুরু হলো আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।
কিন্তু আমার দামাল তারুণ্য পরাভব মানে না। যুদ্ধাপরাধী আলবদর রাজাকারদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে শুরু হলো এক অভুতপূর্ব গণজাগরণ। আমার দীর্ঘদীনের পুরোনো ক্ষতে মলম লাগিয়ে এই গণজাগরণ চল্লিশ বছর ধরে বেড়ে উঠা ধর্মবেনিয়া জামাতি মহীরুহের শেকড নাড়িয়ে দিলো। চিহ্নিত করে দিল মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আর জামাতী অর্থনীতি ও রাজনীতির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠা এই তারুণ্যের জাগরণকে আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে বরাবরের মতো পেছন থেকে ছুরি মারলো ISI ও CIA এর সোল এজেন্ট জামায়াত। সাথে তাদের রাজনৈতিক এবং আদর্শিক মিত্র বিএনপি। মৌলবাদি রাজনীতির সেই পুরোনো শর্টকাট গেম শুরু করলো জামায়াত-হেফাজত। ধর্মের নামে সুড়সুড়ি, নাস্তিক-আস্তিক প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে শুরু করলো গুপ্ত হামলা।
আমি হতবিহবল হয়ে দেখলাম রাজপথে হেফাজতের তাণ্ডব আর রাতের আঁধারে জামাতী চাপাতির কোপে ছিন্ন-ভিন্ন তারুণ্যের মগজ। মুক্তিসেনাদের রক্তে ভেজা আমার এই মাটি আবার রক্তে ভিজে যেতে লাগলো আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের রক্তক্ষরণে।
তবু শেষ হয়ে যাইনি আমি। শেষ হয়নি সব এখনো। এখনো তিনি চাইলে পারবেন। আমি জানি তিনিই পারবেন আমার শরীর খুঁড়ে খুঁড়ে খাওয়া এই ক্যান্সার নির্মুল করতে। তিনি শেখ হাসিনা, তিনিই বাংলাদেশ, তাঁর হাতেই বাংলাদেশ।
তাঁর সাথে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠা আলোর তারুণ্য। এই তারুণ্যই উপড়ে ফেলবে জঙ্গিবাদ আর ধর্মান্ধতার ক্যান্সার কোষ, তা যতো বিস্তৃতই হোক না কেন। এই তারুণ্যের পথ দেখাচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধ আর বীর বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু।
ধর্মান্ধ রাজনীতির খেলা অনেক তো হলো। আর দেরি নয়। যে তারুণ্য জেগেছে তাকে জাগতে দিন। এই তারুণ্য একটি রাজনৈতিক, আদর্শিক সংগ্রাম শুরু করেছে, যার শেষ প্রান্তে আলো হাতে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক,গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। জয় বাংলার এই শক্তিকে চর্চা করার মতো একটু সুযোগ দিন। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় করে আজ যে তারুণ্য আমার বেদখল হয়ে যাওয়া মগজ পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নেমেছে, তাদের পাশে থাকুন দয়া করে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিকে ফিরিয়ে আনুন। এই পথই বাংলাদেশ। এই পথেই আঁধার কাটবে। এই পথেই আলো আসবে। আসবেই।
“ শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না –
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।।”
Very good, as my point of view story is true,
hence truth never fail, I believe country Will be back on the trak again and disease will be cure as we found new vaccines for that.
Day after night, night after day auto setup but when distruction of timing which can be fix by dump the memory.