আই হ্যাভন’ট মেট ইউ ইয়েট

জেসমিন চৌধুরী: অপুকে আর আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের কেমন করে পরিচয় হয়েছিল?’ উত্তরে আমরা দু’জনেই মুচকি মুচকি হাসি। অপুর হাসির অর্থ হলো, ভদ্রোচিতভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া, কারণ ও খুবই প্রাইভেট একজন মানুষ। আর আমি যদিও মলাট ছেঁড়া বই এর মতোই খোলামেলা, তবুও আমিও হাসি, কারণ আমি জানি অপু নিজের একান্ত বিষয়গুলো নিজের কাছেই রাখতে পছন্দ করে। তবে মাঝে মধ্যে আমার ইচ্ছে হয় পৃথিবীর অগণিত মানুষের ভেতর থেকে শেষপর্যন্ত এই লোকটাকে খুঁজে বের করতে পারার আনন্দ আর গৌরব সবার সাথে শেয়ার করি, আবার ওকে বিব্রতও করতে চাই না।

Jesminএবার কাম্ব্রিয়ায় উইকেন্ড ব্রেক এ গিয়ে যখন দু’জন মিলে ওয়ালনি দ্বীপের বুক চেরা এবড়ো থেবড়ো, ছাগলের বিচী বিচী মল ছড়ানো, উঁচু নিচু শুকনো ঘাসে ঢাকা পথ ধরে, লাইট হাউসটাকে বাঁয়ে রেখে সি বীচের যেখানটায় সীল মাছেরা রোদ পোহাতে আসে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন  হঠাৎ করেই নিজের সৌভাগ্য বিশ্বাস করতে মনে হলো, সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।  

এটা কি আসলে হচ্ছে? সত্যিই হচ্ছে? আমার মতোই একটু একটু খারাপ, একটু পাগল, অথচ আমার চেয়ে অনেক অনেক ভালো একটা লোক তাহলে আমি সত্যিই পেয়ে গেছি? তখনই ভাবলাম ফিরে এসেই এই চিন্তাগুলো লিখে ফেলবো। তবে মাথার মধ্যে কথাগুলো সাজাতে গিয়ে সময়ের দিক দিয়ে বারবার অনেক পেছনে চলে যাচ্ছিলাম, অনেক অনেক পেছনে।

ছোটবেলায় আমার বড়বোনের বর মুক্তা ভাইকে দেখে ভাবতাম, আমার জীবনে কিছুটা এরকমই একটা লোক চাই, যার একটা কোক আর কৌন আইসক্রিমের দোকান থাকবে, পকেট ভর্তি টাকা থাকবে, আর আমি যা বলবো, সে তা’ই শুনবে। তারপর যখন একটু বড় হলাম, এদিক-ওদিক থেকে একটা দু’টা প্রেমপত্র আসতে শুরু করলো, প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে ইঙ্গিতপূর্ণ কবিতা পেতে শুরু করলাম, তখন সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমার আর বিশেষ কোনো ভাল লাগা থাকল না। কোন ছেলেকেই আর আমার ভাল লাগতো না।

কিন্তু ছেলেরা আমাকে পছন্দ করে, আমার মধ্যেও ভাল লাগার কিছু বিষয় আছে, সেটাই ভাল লাগতো। আব্বার কথা মতো, আমি ‘গুড ফর নাথিং’ না, অথবা মা’র কথা মতো, আমি ‘বাদো (ভাদ্র) মাইয়া ঝাড়ু’ না, সেটা ভাবতেই ভাল লাগতো।

এর মধ্যে তাল গাছের মতো লম্বা হয়ে যাওয়া পনেরো-ষোল বছরের আমার জীবনে যেন একটা ব্যক্তিগত রেনেসাঁ ঘটে গেল- সাজগোজ করি না, ফ্যাশন বুঝি না, কিন্তু বিকেল বেলা লম্বা দুই বেণী ঝুলিয়ে পেয়ারা তলায় বসে জীবনানন্দের কবিতা পড়ি, নানারকম সাংস্কৃতিক আর ক্রীড়া  প্রতিযোগিতায় রাশি রাশি পুরষ্কার পাই, ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের প্রক্সি মায়ের ভূমিকা পালন করি, নানান রকম রান্না করি, লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একক অভিনয় করি।

এর মধ্যে তিন-চারটা বাংলা খাতা আবার গল্প-উপন্যাস লিখে ভরে ফেলেছি যা কাউকে তেমন দেখাই না। কিন্তু এই সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেল রাশি রাশি বিয়ের প্রস্তাব আসার অনাবিল আনন্দ। এটা ছিল এক ধরনের সামাজিক অনুমোদন যার অর্থ ছিল, আমি আমার ফ্যাশনাবল এবং রূপবতী চাচাতো, খালাতো বা ফুফাতো বোনদের চেয়ে সামাজিকভাবে কম আকাঙ্খিত নই।

বিয়ে করতে চাই না, কিন্তু প্রস্তাব এলে ভালো লাগে, এরকম করতে করতে একসময় ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়েতে রাজীও হয়ে গেলাম। বয়স তখন মাত্র আঠারো। তারপরের কাহিনী আপাতদৃষ্টিতে একটা সামাজিক বিপর্যয় বলে মনে হলেও আমার কাছে ছিল একটা সামাজিক বিপ্লবের মতো- সংসার যাপন, সন্তান ধারণ এবং পালন, বয়স্ক শিক্ষার পূর্ণ ব্যবহার, রোজী থেকে জেসমিন হয়ে যাওয়া,  বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি।

তারপর কিছুদিন কাটলো প্রজাপতির মতো পাখায় বাতাস লাগিয়ে। সবাই বললো, আমি দেখতে অনেক সুন্দর হয়ে গেছি। আসলে এই প্রথম আমি নিজেকে ঠিকমতো অনুভব করলাম। নিজের জন্য বাঁচলাম এই প্রথম। স্বাধীনতার স্বাদ ভালমত উপভোগ করলাম এই প্রথম।

নিজের টাকা নিজে কামাই, নিজে খরচ করি; নিজের খাবার নিজে বানাই, নিজে খাই; নিজের গাড়ি নিজে চালাই, নিজে চড়ি। সিংগল মাদার শুনতে যতটা করুণ মনে হয়, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। নিজের সাথে বাস করার একটা প্রচণ্ড আনন্দ আছে। এই আনন্দের খবর অনেকেই কোনদিনও পাবে না। তবে এই আনন্দ একটা অস্থির রকমের আনন্দ, রংধনুর পেছনে ছুটে বেড়ানোর মতো আনন্দ, এবং রংধনু মিলিয়ে গেলে পাখা ভেংগে মাটিতে ফিরে আসার কষ্টটাও একান্তই নিজের। পাখা আমারো ভেংগেছিল।

আর তখনই দেখি আমি খুব একা। অসম্ভব ভাল দু’টো ছেলেমেয়ে আমার, কিন্তু একজন নারী হিসেবে আমি ভীষণ ভীষণ একা।  আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে অনেকেই। কিন্তু পুরুষের চোখে আমাকে ভাললাগার ব্যাপারটা আমাকে আর আনন্দ দেয় না। সমাজের সবগুলো চেহারা দেখা হয়ে গেছে আমার। সামাজিকভাবে আকাঙ্খিত হওয়াকেও এখন লজ্জাজনক মনে হয়।

কেউ আমার কাজের প্রশংসা করলে খুশি হই, রূপের প্রশংসা করলে ফেইসবুক থেকে তাকে ডিলিট মারি। তারপরও একা লাগে খুব। আমি খুঁজি একটা মানুষ যাকে আমার ভালো লাগবে, এতোটাই ভাল লাগবে যে তার হাত ধরে বসে থাকতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগে এমন একটা মানুষও চোখে পড়ে না। হয়তো কাউকে দূর থেকে একটু ভালো লাগে, এক দু’পা আগাই, তারপর দশ পা পিছিয়ে আগের চেয়েও দূরে চলে যাই।

কাউকেই মনে ধরে না।  কেউ বেশি কথা বলে, কেউ বা কথা বলার সময় থুথু ছড়ায়, কারো জ্ঞান অতিরিক্ত বেশি, কারো বা সেন্স অব হিউমার নেই, কারো বয়স অনেক কম, কারো বয়স অনেক বেশি, কেউ প্রথমদিনেই হাত ধরে কেমিষ্ট্রি টেস্ট নিতে চায়। মহা ঝামেলায় পড়া গেল। অথচ নিজের অনুভূতির সাথে অসৎ হওয়ার ক্ষমতা এখন হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঠিক আছি, আমার জীবনে একটা পুরুষের প্রয়োজন নেই, এই হিপোক্রিসিটুকু নিজের সাথেও আর করতে পারি না। কাজেই ‘খোঁজ, দ্য সার্চ’ চলতে থাকে।  
আমার বাচ্চা বন্ধু তারেক ফাইজলামি করে বলে, ‘জেস আপু, আমি তোমাকে ঠিক ঠিক বিয়ে করতাম, কিন্তু তোমার বয়সটা আমার চেয়ে অনেক বেশি।  তুমি আর মাত্র বিশটা বছর অপেক্ষা করো, তখন আর বয়স নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। তখন ঠিকই আমি তোমাকে বিয়ে করে ফেলবো’।

ফেইসবুক এবং এটা-সেটার কল্যাণে অনেক যুবকের এবং প্রৌঢ়’র সাথেই পরিচয় এবং/অথবা বন্ধুত্ব হলো। আমার মধ্যে মেয়েলি লাজ-লজ্জা বা জড়তা কোনদিনই ছিল না, এখন জীবনের এতোটা পথ হাঁটার পর আমি আরো অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠেছি। মেয়ে কম, মানুষ বেশি হয়ে উঠেছি। আমি সবার সাথেই মিশি, কথা বলি, পুরুষদেরকে এতো বেশি ভয় পাই না যে, তাদের থেকে সবসময় জোর করে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে রাখবো।

অনেকে হয়তো আমার এই সহজ স্বভাবের জটিল অর্থ ধরে নেয়। কাজেই এবার পেতে শুরু করি শুধু বিবাহের নয়, আরো নানা রকম প্রস্তাব। আমার এক ‘হ্যাপিলি ম্যারিড’ কলিগ, যাকে একজন প্র্যাক্টিসিং মুসলিম বলে জানতাম, একদিন একা পেয়ে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘It’s such a waste for a beautiful young woman like you to be single. We could go for a cofee sometimes if you want’। এতোদিনে কফির নানান রকম অর্থ শেখা হয়ে গেছে, তাই অত্যন্ত ভদ্র গলায় ম্যারিড ম্যানদের সাথে কফি খেতে যাওয়ার ব্যাপারে আমার এলার্জির কথা জানাই তাকে।

আরো এক এক্স কলিগের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর সে অন্তত দুইটা সপ্তাহের জন্য তার সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার অনুরোধ করে, তা না হলে নাকি আমাকে তার মগজ থেকে সরাতেই পারবে না। আরেকজনের সাথে ইন্ডিয়া বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি জানতে চান, ‘আপনার সমস্যাটা কি?’। আমি নরম গলায় বলি, ‘You are not my type’। ঊনি ততোধিক নরম গলায় বলেন, ‘At this rate, you’ll never find someone your type.’

এভাবেই একে একে বন্ধু হারাতে থাকি আর বিউটিফুল ইয়ং মেয়ে হিসেবে ওয়েস্টেড হতে থাকি। তখন আমি ব্রিট কলেজে ইংরেজি পড়াই, কলিগরা আমার জন্য ডেট ফিক্সিং এর চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেয়। এরকম সময়ে আমার অত্যন্ত ভাল বন্ধু সাকি ভাই আমাকে সুন্দর উপদেশ দিলেন, ‘Go for a man only if your body, mind, and soul dance for him together.’

একসময় আমারো মনে হতে শুরু করে হয়তো আসলেই যাকে খুঁজি  তাকে আমি পাবো না কখনো। আমার এক কলিগ একদিন আমাকে বলল, ‘তুমি মাইকেল বুবলের এই গানটা শোন, এইটা তোমার জন্য গাওয়া হয়েছে, and I’m sure your man is looking for you right now as well, he just hasn’t met you yet.’ গানটা শুনে চোখ ফেটে পানি এলো, যদিও খুবই চিজি গান, এবং তার চেয়েও চিজি আমার এই চোখে পানি আসা, কিন্তু আমার এখনো খুঁজে না পাওয়া ম্যানটাকে আমি প্রচণ্ড রকম মিস করতে শুরু করলাম।

মেয়ে ইলাকে নিয়ে ইলফোর্ড লাইব্রেরিতে যাই সস্তায় পুরোনো বই কিনতে, হাজার হাজার নানান রকম বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে আমি তাকে খুঁজি। যাকে দেখে আমার দেহ, মন , এবং আত্মা একই সাথে নেচে উঠার কথা সে অবশ্যই বইয়ের পোকা হবে। আমি লাইব্রেরির চারদিকে তাকাই- একজন সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন, কিন্তু আমার দেহ নেচে উঠে না।

বনের ভেতর যখন হাঁটতে যাই, মনে মনে তাকে খুঁজি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কর্মকাণ্ডের ভেতরে আমি তাকে খুঁজি। বন্ধুদের সাথে হাইকিং এ গেলে আমি তাকে খুঁজি। কোনো আন্দোলনের মানববন্ধনে তাকে খুঁজি। খুঁজি  আর ভাবি, সেও কি আমাকে খুঁজছে? এরকমই কোনো স্থানে সে আমাকে খোঁজার কথা, এরকমই কোনো স্থানে হয়তো আমি একদিন তাকে পেয়ে যাবো।

তারপর একদিন বন্ধু সাকি ভাইয়ের কথা সত্য করে দিয়ে আসলেই আমার সবকিছু নেচে উঠলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন সুঠাম দেহি পুরুষ- বলিষ্ঠ চেহারা, কোমল দৃষ্টি,  স্নিগ্ধ হাসি। পুরুষালী বলিষ্ঠতার সাথে কোমলতার এই দুর্লভ মিশ্রণ আমাকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করলো। আর তার চেয়েও বেশি আকৃষ্ট করলো, তার ব্যাগ থেকে উঁকি দেয়া কবিতার বই, বনের পথে হাঁটার অভ্যাস, নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার শখ, কাব্য আর নাট্যচর্চ্চা, মানুষ আর চারপাশের জগত নিয়ে তার চিন্তাভাবনা।

প্রথম পরিচয়ের দিনই আমরা গল্প করে কাটিয়ে দিলাম পুরোটা দিন, সাতটি ঘন্টা। অবশ্য আমি বললাম কম, শুনলাম বেশি। বন্ধুরা জানে আমি অনেক কথা বলি, কিন্তু সেদিন থেকে শুরু হলো আমার কথা শোনার পালা। একটা গভীর, গমগমে, অদ্ভুত রকমের বলিষ্ঠ কন্ঠের কথা।

তারপর  ম্যানচেস্টারের উইদিনশো বনের গাছগুলোর আর আমাদের জীবনে অনেকগুলো অটাম আর স্প্রিং এসে চলে গেছে। এখন প্রায়ই আপন মনে ভাবি, আমি তাহলে তাকে পেয়েছি? আবারও ভাবি, আসলেই কি পেয়েছি? একটা মানুষকে কি  আসলেই কখনো পাওয়া যায়?

 

শেয়ার করুন: