সন্তান জন্মদানের জন্যই বিয়ে নয় শুধু

শিল্পী জলি: একবার বান্ধবী বিয়ে ঠিক করেছিল–বললাম, ‘ছেলে দেখি আমার সমান লম্বা, বাচ্চা যে খাটো হবে ?’ বলে, ‘দূর মিঞা, আগে নিজে বাঁচো তো– তারপর বাচ্চার কথা ভেবো।’ আমি হাসি আর আমতা আমতা করে বলি, বাচ্চার জন্যে বিয়ে করবো তাও যদি ওমন বিয়ে করি কেমন কথা?

2তাছাড়া বিয়ে তো আর এমন নয় যে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে দিলাম আর হয়ে গেল, পাশেও যে শুতে হবে– যদি ১০% ও পছন্দ না হয় তখন কেমনে কী? না, না অসম্ভব– এ আমার দ্বারা হবে না। কমপক্ষে ৫০% ভালো লাগা থাকতে হবে নইলে বিয়ে না হলেও বিয়ে করবো না।

আজও একজন বললেন, বিয়ে নাকি হয় শুধু বাচ্চার জন্যেই–তা হলোই না হয় বাচ্চা পেতেই বিয়ে, তারপরও বাচ্চা হতে হলেও তো মাকে বাবার সাথে কিছুটা অন্তরঙ্গ হতেই হয়। অতটুকু অন্তরঙ্গ হতে হলেও তো একটু শ্রদ্ধা, একটু ভালোলাগা, একটু ভালোবাসা থাকা জরুরি– একটু ঘোরও লাগে।

নইলে জন্মদান টেকনিকটিও যে একেবারে রেপের পর্যায়েই চলে যায়। তদুপরি বাচ্চা পেতে হলে যেমন- তেমন মিলনও বার বার করতে হয়, কিন্তু সহজে সাকসেস আসে না। ডাক্তাররা পরামর্শ দেন, ‘মিলনে যাবে বিভোর হতে, বাচ্চা পেতে নয়। ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে যাও, আকাশ-বাতাস-সাগর দেখো, চাঁদ ডুবুক, জোনাকি বাতি জ্বালাক… তারপর –তখন মিলনও হবে, বাচ্চাও।’

নারী-পুরুষের টেনশনমুক্ত মিলনেও মাত্র ২৫% সম্ভাবনা থাকে কনসিভ করার। তারপরও বয়স কম থাকলে কয়েকবারের চেষ্টায় রেপ জাতীয় আত্মমর্যাদাহীন দুটো শরীরের সন্ধি-স্থাপন- মিলনেও দুটো বাচ্চার জন্ম হওয়া অসম্ভব নয়। তবে যে সংসার গড়া এবং ধরে রাখা হয় শুধুমাত্র একটি বাচ্চা পেতে এবং তাকে বড় করতে, সেই বাচ্চাটি হয়তো তেমনই একটি মানুষ হয় যে ভালোবাসতে শেখে না, ভালোবাসার মাধুর্য জানে না, সেক্স তো ইয়া মাবুদ–ছি:!

বৈধ সেক্সকেও সে ঘৃণা এবং পাপ মনে করে। আমাদের সমাজ ব্যবস্হা হয়ত অনেকটা তেমনই।

3এখনও বাংলাদেশে মেয়েদের সেক্সের ‘স’ বলা মানেই লুচ্চার লুচ্চা–বিবাহিতা হলেও ছি: কী খারাপ মেয়েরে– সেক্স শব্দ জানে ছি:…ছি:…ছি:!  ওই ছি: এর এক টানেই যেন থুথুর বন্যা বয়ে যাবে চারিদিকে।

তাহলে দেশে কোটি কোটি বাচ্চা আসে কোথা থেকে? যে কাজের নাম শুনলেও পাপ, সে ঘটনা ঘটে কি করে? কেনই বা সেই অঘটন? সেক্স জীবনেরই একটি চাহিদা–ধর্ম এবং রাষ্ট্রও সেই স্বীকৃতি দিয়েছে। সেইসাথে নিরাপদ কিছু প্রথা এবং ব্যবস্হারও বিধান করেছে যেন শান্তি থাকে, STD কম হয়…।

রাষ্ট্র বা ধর্ম কখনও বলেনি মিলন শুধু বাচ্চা পেতে, এবং বাচ্চা হলেই মিলন নিষ্প্রয়োজন।

শুধু কোনো কোনো সমাজ ব্যবস্হা এখনও মেয়েদের জন্যে সেক্সকে জরুরি মনে করতে চায় না। এমন ভিত্তিহীন কথার মারপ্যাঁচে লজ্জায় ফেলে মেয়েদেরকে কন্ট্রোলে রাখতে চায়– একটি স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে, একটি স্বাভাবিক জীবনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা থেকে দূরে রাখতে পাঁয়তারা করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ণ বয়স্ক মানুষের নিয়মিত সেক্সে ( সপ্তাহে দু’বার) তার ইমিউন সিস্টেম ভালো থাকে, স্ট্রেস কমে, ঘুম ভালো হয়, প্রেশার কমে, মেয়েদের ইউরিনেশন কন্ট্রোলে থাকে, নিয়মিত এক্সসারসাইজ হয়, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে (prostate cancer), হার্ট এটাকের সম্ভাবনা কমে, দেহে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি তৈরি হয়, আরও অনেক কিছু জানতে রিসার্চ করা যেতে পারে।

শরীর যেমন ছেলেদের, তেমনি মেয়েদের সিস্টেমও কাছাকাছিই। পার্থক্য হয়ত বিশ-পঁচিশের। এতো সবকিছু বুঝেও আমরা সহজে বুঝতে চাই না আরেকজন মানুষের একটি স্বাভাবিক জীবনের প্রয়োজনকে। অথচ বিষয়টি নিজের হলে আপনা-আপনিই সাড়ে-ষোল আনা বুঝি। কেননা কেউ আরেকজনের জুতো পরে হাঁটি না।

অপি করিম বৈধভাবে আগে আরও দু’টো বিয়ে করেছিলেন–একটি বাবা-মায়ের ইচ্ছেয়, মানুষটিকে না জেনেই। দ্বিতীয়টি নিজের পছন্দে। আমাদের সমাজে অপি করিমই হোক, বা অন্য যে কেউ হোক কতটুকু জেনেবুঝে বিয়ে করার সৌভাগ্য হয়?

সাধারণত মেয়েদের প্রথমবার বিয়ে হয় বাবা-মায়ের সম্পত্তি, পতিপত্তি, দাপট, শিক্ষা-দীক্ষা, রূপ, বয়স, এবং যৌতুকের দহরম টহরমের উপর ভিত্তি করে। নইলে ‘I LOVE YOU’ বলে একটি বা দু’টি KISS দিয়েও ৫০% ছেলেই ভেগে যায় বিয়ে না করে। আর KISS এর সংখ্যা বেশি গড়ালে তো ছেলে কেন, ছেলের বাপও বিয়ে করতে আসে না।

Shilpi Jolley 2
শিল্পী জলি

আর মেয়েদের দ্বিতীয়বার বিয়ে তো হতেই চায় না–অযথা ভার্জিনিটির লাইসেন্স হারিয়ে যায় বলে দাদা-পরদাদা এসেও লাইনে দাঁড়িয়ে যায় মরার আগে শেষ কবুলটা পড়তে। যত ভালো মেয়েই হোক না কেন ঐ মেয়ের নম্বর থেকে আগেই ৫০% কেটে রাখা হয় ভার্জিনিটি লসজনিত ঝামেলা থাকায়।

অথচ ছেলেদের সেই সমস্যা নেই। যুগের পর যুগ ধরে দলবদ্ধ থেকে তারা তাদের পথটি ঠিকই চওড়া রেখেছেন। তাই যত ডিভোর্সই হোক না কেন, একটি ছেলের জীবনে আরও একটি কম বয়সী সুন্দরী রমনীর আগমনের সম্ভাবনা বাড়ে।

কিন্তু মেয়েদের অবস্হা কাহিল–তারা বিয়ের ‘ব’ বললেও ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়ে একই সাথে ঝাঁপিয়ে পরে তাদের উপর– ফেল করে আবার বিয়ের নাম, এত বড় স্পর্ধা তোর?

সূর্য কোনদিকে উঠছে আজকাল?

সামাজিক চাপে পড়ে মেয়েরা ভীত হয়ে যায়– বিয়ের নামটিও আর মুখে আনে না, নিজের পাওনাটাও বোঝে না, জীবনের কোন সুখ আর খোঁজে না।

ওখানেই ছেলেদের গেইন।

তারা জানে মেয়েদের ডিভোর্স হলে সে একাই থাকবে আগাছা-পরগাছা হয়ে কখনও বাপের ঘরে, কখনও ভাইয়ের ঘরে, আর বৃদ্ধ বয়সে একা।

খুব বেশিকিছু করার সুযোগ নেই তার, ঐ বিয়ের ব্যর্থতা নিয়েই হাঁটতে হয় জীবনের বাকি পথটুকু।

অথচ ছেলেটি ঠিকই একটি স্বাভাবিক জীবন খোঁজে, আরেকটি সংসার গড়ে, সন্তানের জন্ম দেয়, সুখে-দুঃখে পাশে একটি মানুষ পায়। এতে কারও দ্বিমত থাকে না। বরং মাস না হতেই পাত্রীর খোঁজে নেমে যায় পরিবার, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মিবৃন্দ– ছেলে তো একেবারেই ফেরেশতা, বউটিই যতো…।

কারিশমা কাপুরের দু’টো সন্তান নিয়ে ডিভোর্স হয়েছে। সম্প্রতি তিনি একজন বয়ফ্রেন্ডের সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন খেতে। তার এক্স-হাজবেন্ড সেই দেখে লোকের সামনেই চড়াও হয় তার ওপর, ‘কেন বয়ফ্রেন্ড থাকবে তার?’ তখন অতি কষ্টে বন্ধুরা তাকে থামায় এই বলে যে, ‘এখন এই বিজনেস তোমার নয়?’ যদিও তিনি নিজের বিয়ের ব্যবস্হা ঠিক করেই ডিভোর্সে গিয়েছিলেন, তারপরও তিনি কারিশমা কেন বিয়ে খুঁজবে তা সহ্য করতে পারেননি।

তিনি ভুলে গিয়েছেন যে কারিশমার জন্যে এখন তিনি আউটসাইডার।

ছেলেরা ডিভোর্স দিতে চায়, কিন্তু অধিকার ছাড়তে চায় না– মাঝে মাঝে ঘুড্ডিতে টান দিতে চায়। ভুলে যায় যে সেই কবে ঘুড্ডি ভোম হয়ে গিয়েছে, তারই খাতিরে।

কারিশমার কথা বাদ দেই। আমার এক বান্ধবীর কথা বলি। তার বিয়ে হয়েছে এমন একজনের সাথে যার প্রেম অন্যখানে। বান্ধবী রান্নাবান্না করে, বর খায়-দায় আর কিছুদিন পর পর প্রেমিকার সাথে রঙতামাশায় মাতে। বান্ধবীর দিকে ফিরেও তাকায় না, আবার ডিভোর্সও দেয় না। অসন্তোষ প্রকাশ করলে মার আর গালিবর্ষণ ঘটে– কখনও তিন চারহাত দূরে ছুঁড়ে মারে, কখনও বা রাতে ঘর থেকেই বের করে দেয়। অত:পর তাদের ডিভোর্স হয়েছে। কয়েক বছর পর মেয়েটি বিয়ের খোঁজ করছে। প্রাক্তন বরটি তার বর খোঁজার বিষয়টি জেনে ফোন করে বলে, ‘বড় দুঃখ পেলাম তুমি আবার বিয়ের খোঁজ করছো জেনে?’

অথচ সেই ঝামেলা করছিল যেন মেয়েটি আপনা থেকেই চলে যায়, তেমন কোনো টাকাপয়সা দিতে না হয়, আর তিনি সহজে ঘর বাঁধতে পারেন তার প্রেমিকার সাথে।

দিনের পর দিন তার প্রেমিকাটি টাকা নিয়েছে- প্রেম দিয়েছে, ডিভোর্স করিয়েছে, অতঃপর নিজে আর আসেনি। জনাবের মাথায় হাত– বউও গেল, প্রেমিকাও হাতছাড়া। ছুটে যায় বলদ বউকে নিয়েই আরেকটিবার ঘর করতে, বাচ্চা জন্ম দেবার প্রতিশ্রুতি দিতে, কিন্তু বলদ মেয়েটিও না বলে বসে। যাক, সে দেরিতে হলেও নিজের বোকামিটা বুঝতে পেরেছে।

বিয়ে শুধুমাত্র সন্তান জন্ম দিতেই নয়– একটি সুস্হ পরিবার এবং একটি সুস্হ বন্ধন গড়ে তুলতেও।

পরিবেশই যদি সুস্হ না হয়, কোন ভালোবাসা যদি না থাকে পরিবারে, স্বামী-স্ত্রী দু’জন দুজনকে শ্রদ্ধা না করে, দিনরাত ঝগড়া-ঝাটি লেগে থাকে, তাহলে সন্তানের মুখ চেয়ে সেই বিয়ে টিকিয়ে রাখলেও সন্তানের তেমন কোন উপকার হয় না। তাই সে মানুষ হিসেবেও খুব সুবিধাজনক হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। কেননা মানুষ পরিবার থেকেও অনেক কিছু শেখে।

সংসারে কে একটু বেশি কাজ করলো, বা কে একটু কম কাজ করলো, কার আয় কত, কার পদবী কেমন, কে বেশি শিক্ষিত– এসব কোন বড় কথা বা বড় হিসেব নয়।

হিসেব আসে তখনই, যখন সেখানে শ্রদ্ধা থাকে না।

অশ্রদ্ধা নিয়েও যারা দিনের পর দিন সংসার ধরে রাখে অথচ একটু পরিবর্তন আনতে পারে না, আবার ছাড়তেও পারে না তারাই বিয়েকে আর শ্রদ্ধা করতে পারে না।

বিয়ে মানে দাসত্ব নয়, শুধুই সেক্স নয়, শুধুই সন্তান উৎপাদন নয়, শুধুই হিসেব-নিকেষ নয়।

বিয়ে মানে প্রতিশ্রুতি, নির্ভরতা, সমঝোতা, সঙ্গ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রাপ্তি, উৎসাহ, সাহস, স্বপ্ন দেখা, এগিয়ে চলা…।

বিয়ে মানে একটি জীবন্ত মানুষকে নিজের বলে পাশে পাওয়া– যে প্রকৃত অর্থেই মানুষ, সজারু নয়– খোঁচাতে!

যদিও এমন বিয়ে সহজ নয়, তারপরও বিয়ে এমনই হওয়া উচিত–

পরিবর্তন ধীরে ধীরেই আসে। আশা ছেড়ে দিলে কিছুই হয় না।

আজ যারা শিশু তারা যদি দায়িত্ববান হয়ে গড়ে ওঠে, পরিশ্রমী হয়, যুক্তি মানে, মাকে শ্রদ্ধা করে, মাকে ভালোবাসে, মায়ের কদর করে, তাহলে সে যখন বড় হবে তখন অবশ্যই অন্য মেয়ের কদরও বুঝবে। তাই সন্তানকে প্রকৃত মানুষ এবং মানবিক করে গড়ে তুললেই ভবিষ্যতে আপনাআপনিই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবার কথা। সংখ্যা কম হলেও এখনও অনেক ভালো বিয়ে আছে, অনেক ভালো বর আছে– আমাদের চারপাশেই।

শেয়ার করুন:

লেখাটা ভালো লাগলো৤ বিয়ের নতুন সামাজিক সংজ্ঞা টা ভালো লাগলো৤ প্রতিশ্রুতি, নির্ভরতা, সমঝোতা, শ্রদ্ধা, ভালবাসা মিশ্রিত অারও কিছু৤

আমি যখন আইন পড়ি তখন ‘বিবাহ’ একটা চ্যাপ্টার ছিল৤ আ্ইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম আইনে বিয়েকে একটা চুক্তি বলা হয়েছে৤ এটার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে সম্ভোগ আর সন্তান এর বৈধতা৤৤ আইনগতভাবে যেটাই হউক না কেন সম্পর্ক টিকে থাকে সমঝোতা, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায়৤ধন্যবাদ লেখিকাকে৤