যুক্তরাষ্ট্রে নারীর প্রতি বৈষম্য ও একজন হিলারি ক্লিনটন

যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তার লিন্ডা লিয়াও। একজন অভিজ্ঞ স্নায়ু শল্য চিকিৎসক। বয়স প্রায় ৫০। গত ২০ বছর ধরে তার নিত্য বসবাস রোগী আর অপারেশন থিয়েটারের ছুরি-কাঁচির সঙ্গে। দিনভর রোগী সামলান। কখনো কখনো টানা কয়েক ঘন্টা কাটে ওটিতে, মস্তিস্কের টিউমার অপারেশনে। কিন্তু এই কর্মব্যস্ত জীবনের পরেও তার উপলব্ধি, কর্মক্ষেত্রে গত ২০ বছরের পরিবেশ খুব একটা বদলায় নি।

Gender-inequality-in-US-03বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, সেই শুরুতে, দু দশক আগে লিন্ডাকে যেদিন শল্য চিকিৎসক হিসেবে জরুরি বিভাগে ডাকা হয়েছিল সড়ক দুর্ঘটনায় আহত এক রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য, সেদিন তার পুরুষ সহকর্মীরা তাকে চিকিৎসকের বদলে বিবেচনা করতেন সেবিকা হিসেবে। দু দশক পরে এসেও তিনি বিস্মিত হন প্রায় একই চিত্র দেখে। তার মন খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখেন রোগীরা ডাক্তার হিসেবে তার মতো নারীর চেয়ে বেশি আস্থা রাখেন পুরুষ ডাক্তারদের উপর।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য এই অভিজ্ঞতা লিন্ডার একার নয়। চাকরি কিংবা ব্যবসায় দেশটিতে নারীরা ব্যাপকভাবে এগিয়ে গেলেও নারী-পুরুষের বৈষম্যের চিত্রটা খুব বেশি বদলায় নি। বদলায় নি মানসিকতাও। এই সময়ে এসেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের কর্মক্ষেত্রে সম্মান, বেতনভাতা, ছুটি, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের অবস্থান আবিষ্কার করেন অবহেলিত, বঞ্চিত হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের গত ২৪০ বছরের ইতিহাসে একটি শূন্যস্থান চোখে পড়ার মতো। পৃথিবীর সবচেয়ে টেকসই গণতন্ত্রের দেশগুলোর একটি, যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত একজন নারী রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারলেন না।

Gender-inequality-in-US-05আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ফলাফল যাই হোক, হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের রেকর্ড হয়ে গেছেন ইতোমধ্যেই। সেটিও ২৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোন নারীর প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি থেকে প্রার্থী হওয়ার রেকর্ড। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে জয়ী হলে আরেকটি নতুন ইতিহাস তৈরি হবে। হিলারির প্রার্থীতি তাই যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা দেখছেন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে। বহু নারী তাই হিলারির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তৈরি করেছেন গ্রুপ, খুলেছেন পেজ। নিজেদের স্ব স্ব অবস্থানে বৈষম্যের অনুভূতি তাদের উদ্বুদ্ধ করছে হিলারির পক্ষে প্রচারণায় নামতে।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত স্বাধীনতা, উদারতা ও সুযোগের মধ্যে একজন নারী রাষ্ট্রপ্রধান তো হতেই পারেন। তবে এটিকে একটি বাস্তবর্জতি ধারণা বলেই এতোদিন মনে হয়েছে মার্কিন নারীদের। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার গবেষণায়ও। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে নারী-পুরুষের বৈষম্যটা এখনো এমন পর্যায়ে যে, তা দূর করতে আরো অন্তত দুই যুগ অপেক্ষা করতে হবে ।

লিন্ডা লিয়াও তাই খুশী, যুক্তরাষ্ট্র একজন নারীকে দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের জন্য প্রতিযোগী হিসবে পেয়েছে। কিন্তু এটা একই সঙ্গে তাকে ব্যথিতও করে। কারণ প্রসিডেন্ট পদে একজন নারী প্রার্থিকে খুঁজে পেতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোকে ২৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

Gender-inequality-in-US-02জোন্দি হোয়াইট বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ। ৩১ চলছে তার। কাজ করেন নির্মাণ খাতে। বর্তমান কর্মক্ষেত্রে কাজ শুরু তার বছর পাঁচেক আগে। তিনি জানান, পুরুষ সহকর্মীরা শুরু থেকেই তাকে বিভিন্ন মন্তব্যে, কাজে বুঝিয়ে দিতেন যে জোন্দি একজন নারী। আর একজন নারীর জন্য নির্মাণ খাতের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা মানানসই না। পুরুষ সহকর্মীদের বেশিরভাগই তাকে সম্বোধন করতো সুইট হার্ট বা হানি বলে। জোন্দির আপত্তি সত্ত্বেও এই সম্বোধন থেকে তাদের নিবৃত্ত করা যায়নি। গত ৫ বছরেরও তার জন্য কর্মপরিবেশটা সহজ হয়নি। হ্যাট পড়ে ওয়েল্ডিং-এর কাজে তুমুল ব্যস্ততা, কাজে আসতে বা কাজশেষে বাসার উদ্দেশে ট্রেন ধরতে দ্রুত একা ছুটে চলা মেয়েটি দিনশেষে নিজেকে কেবল একজন নারী হিসেবেই আবিস্কার করেছেন।

রয়টার্স তুলে এনেছে নির্মাণ খাতে কাজ করা আরেক নারীর গল্পকে। ওয়েল্ডার ডার্লিন থম্পসন। বয়স ৪০। এই কাজে তিনি নতুন কেউ নন। তারপরেও পুরুষ সহকর্মীদের মতো দ্রুত সামনে এগোনোটা তার জন্য কঠিনই মনে হয়। কারণ নারীর জন্য পায়ে পায়ে অপেক্ষা করে নানা বাধা। এক দশক আগে এই কাজে যোগ দেয়ার সময় তাকে স্বাভাবিক সেই প্রশ্নটিই করা হয়েছিল, সব নারীকেই যা করা হয়-নারী হয়ে কঠিন এই কাজ তিনি কেন বেছে নিচ্ছেন? তার প্রশিক্ষক তাকে  প্রসাধন বা রদ্ধন শিল্পে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে শেষ পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলসের ট্রেড টেকনিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষক হয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে থম্পসন বললেন, তিনি হিলারি ক্লিনটনকে একজন নারী প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে ভোট দেবেন না। ভোট দেবেন একজন মানুষ প্রার্থী হিসেবে।

২৮ বছর বয়সী হানাহ কুপার। ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করে এই বয়সেই বেশ ভালো আয় করছেন। লস অ্যাঞ্জেলসের মতো ব্যয়বহুল শহরে একটা বাড়ি কেনার পরিকল্পনাও আছে তার। কুপারের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভিন্ন। কুপারের মাও ছিলেন ইলেকট্রিশিয়ান। মায়ের কাছ থেকেই তার কাজ শেখা, এই কাজে আসতে উৎসাহ পাওয়া। অন্যদের তুলনায় তিনি কিছুটা ভালোই আছেন। তবুও কুপার জানালেন তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।

তিনি জানান, কাজের ক্ষেত্রে শুধু মেয়ে বলেই পুরুষ সহকর্মীরা তাকে দুর্বল ভাবতো। উঁচু ভবনের কাজে তাকে নেয়া হতো না। বিপদজনক কাজ থেকে তাকে দূরে রাখা হতো। কিন্তু তার মা শিখিয়েছিলেন, টিকতে হলে ধৈর্য্য রাখতে হবে, সহনশীল হতে হবে। মায়ের সেই শিক্ষাকে মাথার ভেতরে গেঁথে নিতে পেরেছেন বলেই কুপার নিরলস কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রমাণ করতে পারছেন নিজের যোগ্যতাও।

Hilaryআরেক নারী ইভা হো। তার কাজ প্রযুক্তি খাতে। তিনি একজন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টও। যুক্তরাষ্ট্রে এই খাতেই নারীর সংখ্যা সবচেয়ে কম। আরো বছর দশেক আগে ইভা যখন কাজ শুরু করেন, তখন তিনি এমনকি কম্পিউটারও চালাতে জানতেন না। শেখার সুযোগও পাননি। এর জন্য পুরুষ সহকর্মীদের অনেক টিটকারি ও গঞ্জনা তাকে সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিদিন যোগ্যতা প্রমাণে লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। ইভা আশাবাদী, স্বপ্ন দেখেন এই সমাজ একদিন পাল্টাবেই।

ফাইভ সিস্টার প্রোডাকশন। বার্টনসদের পাঁচ বোনের মোটামুটি বিখ্যাত একটি প্রোডাকশন হাউস। তাদের তৈরি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এই পাঁচজন বড় হয়েছেন একটি সংস্কৃতমনা পরিবারে। তাদের মা-বাবার একজন ছিলেন লেখক, অন্যজন সুরকার। বাবা মা তাদের পাঁচ কন্যাকে সর্বগুণে গুণান্বিতা করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই চেষ্টা বা ধ্যানধারণা যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ততোটা প্রবল নয়। নারী চলচ্চিত্র নির্মাতার সংখ্যা দেশটিতে এখনো হাতেগোণা কয়েকজন।

বার্টনসরা মনে করেন, একজন নারী যুক্তরাষ্ট্রের হাল ধরলে পরিস্থিতি অনেক বদলাবে। মেয়েরা এই আত্মবিশ্বাস পাবে, তারাও দেশের হাল ধরতে পারেন। এটা সামাজিক বৈষম্য কিছুটা হলেও কমাতে পারে।

(লেখাটি অনলাইন পোর্টাল নিউজ এন্ড নাম্বার্স থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.