বাতাসে ভেসে যায় লাল জুতোর জীবন

শাশ্বতী বিপ্লব: বেলুনের মতো বুকপেট ভর্তি বাতাস নিয়ে ঘরের দাওয়ায় পড়ে থাকে মানিক, সখিনার বুকের ধন। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিতে থাকে কাফনের কাপড়। মানিক নড়ে না, চড়ে না। এমন ছটফটে ছেলে মানিক, আজ কেমন নিথর অলস পড়ে থাকে।

বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিতে থাকে সখিনার বুকের ভিতরটাও, ঝাপসা, অচেনা লাগে সবকিছু। ফিসফিস করে কথা বলে ছেলের সাথে, “ও বাপ, আমারে মা বইলা ডাকো না ক্যান?  ক্যান চুপ কইরা পইড়া থাকো?  কেমন কইরা পারো তুমি বাজান!! কেমন কইরা পারো!!!”

Child abuse 1মানিক যেদিন সখিনার কোল জুরে আসলো, সেইদিনও আকাশ ভেঙ্গে এইরকম বৃষ্টি নেমেছিলো। সেকী বৃষ্টি আর বৃষ্টি!! মরিয়মের মা যখন মানিককে ধুয়ে-মুছে একটা কাপড়ে জড়িয়ে সখিনার কোলে দিলো, মানিকের ঠোঁটের কোনে একটুকরো হাসি লেগে ছিলো তখন। কী যে মায়া সেই মুখে!! ছোট্ট হাসি মুখখানা দেখে সখিনার চোখে পানি এসেছিলো। সুখের পানি, মায়ার পানি।

সখিনার মনে পড়ে, ওর বাপের সাথে যেদিন প্রথম কাজে গেলো মানিক, সেইদিনও বৃষ্টি নেমেছিলো। কোন জুতা ছিলো না মানিকের, বাপের হাত ধরে খালি পায়েই রওনা করেছিলো সে।

সখিনা বলেছিলো, “ও বাপ, খালি পায়ে যাইও না মানিক, আমার স্যান্ডেল জোড়া পইড়া যাও।”  মানিক বলেছিলো, “তোমার ওই ছিঁড়া স্যান্ডেল পড়লে গলির মাথায় যাওনের আগেই আমি পইড়া যামু।” তারপর সোনা মুখে হাসি দিয়ে বলেছিলো, “বেতন পাইলে নতুন জুতা কিনুম মা।”

মানিক কাজে চলে যায়, সখিনার চোখে আবার পানি আসে। হায়রে অভাবের সংসার!!! নাইলে ওইটুকুন ছেলেকে কাজে পাঠায়, এমন পাষাণ মা সে না। ওর বাপেও একই মিলে কাজ করে, তাই ভরসা করে পাঠিয়ে দেয়। গরীবের আবার বাপ…সখিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এমন বাপ থাকলেই কি, আর না থাকলেই কি!!! টাকার জোর নাই, মনের জোর নাই। নিজেই লাথ্থি গুঁতা খাইয়া মানুষ। গরীব বাপের পোলাপান আর রাস্তার কুত্তার মধ্যে তফাত নাই কোন। ইচ্ছা হইলে খাইতে দিলো, ইচ্ছা হইলে মাইরা ফালাইলো। কার বাপের কি?

প্রথম যেদিন বেতন পেলো, মানিক সেদিন কি খুশী, কি খুশী!! একজোড়া লাল জুতা হাতে নিয়ে আর পা ভর্তি কাদা নিয়ে সে ঘরে ফিরলো। সখিনা আঁচল দিয়ে মানিকের মাথা মুছতে মুছতে বললো “জুতা কিনসো বাজান, তায়লে খালি পায়ে আসলা ক্যান?” মানিক বললো “বৃষ্টিতে নতুন জুতা নষ্ট হইয়া যাইবো তো। বৃষ্টির মইধ্যে খালি পা’ই ভালো।”

মানিকের অনেক বুদ্ধি। আর মায়া ভরা দুইটা চোখ। জগতের সব মায়া যেনো চোখে এসে জমেছে ওর। হাসলে চোখ দুইটাও কেমন ঝলমল করে হেসে উঠে। সখিনা ভাবে, ইস, সুপারভাইজার যদি একবার মানিকের চোখের দিকে তাকাইতো, মাত্র একবার। তাইলে তার বুকের ধনরে এইভাবে মারতে পারতো নাকি? পারতো না, কোনদিন পারতো না।

Shaswati 5
শাশ্বতী বিপ্লব

সখিনা জানে না, সুপারভাইজারের সময় নাই মানিকের চোখের দিকে তাকানোর, প্রয়োজনও নাই। চোখ-টোখ দেখা বোরিং ব্যাপার। তারচেয়ে পায়ুপথ অনেক ইন্টারেস্টিং, বিশেষ করে গরীবের পায়ুপথ। একটা কিছু ঢুকিয়ে দিলেই হলো পায়ুপথ দিয়ে, খুবই আনন্দের আর উত্তেজনার!!

সুপারভাইজার মানিকের পায়ুপথে কমপ্রেসারের নল ভরে দিলো। খুব আনন্দও পেলো। আর সেই বিকৃত আনন্দের বিনিময়ে ছোট্ট মানিকের জীবনটা বেলুন হয়ে মিলিয়ে গেলো শূণ্যে।

মরে গেলো মানিক, সেই সাথে মরে গেলো মানিকের হাসি মাখা চোখদুটোও। সেই চোখ কেমন করে দেখবে সখিনা!! না, সে দেখবে না, কিছুতেই না।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় সখিনা, ঘরের কোন থেকে ছোঁ মেরে তুলে নেয় লাল জুতা জোড়া। বৃষ্টি মাথায় হনহন করে হাঁটতে থাকে গলি পার হয়ে পাকা রাস্তার দিকে।

মানিকের বাপ পিছু ডাকে, “কই যাও? মানিকের জুতা হাতে কইরা কই যাও সখিনা?”

সখিনা দাঁড়ায় না। তার সময় নেই, দৌঁড়াতে শুরু করে সে। পাকা রাস্তার ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দ্রুত ধেয়ে আসা বাসের চালক বৃষ্টিতে ভালো করে কিছু বোঝার আগেই থেতলে যায় সখিনা।

মানিক এসে হাত ধরে টেনে তোলে সখিনাকে। মুখে প্রশান্তির হাসি। মানিককে জড়িয়ে ধরে কপালে, চোখে পাগলের মতো চুমু খায়। আহ্, কি শান্তি! ছেলের হাত ধরে বলে, “চলো বাজান, এইবার আমরা যাই।”

রাস্তায় ছিটকে পড়া লাল জুতো জোড়ার সামনে এসে এক মুহুর্ত দাঁড়ায় মা আর ছেলে, তারপর আবার হাঁটা শুরু করে। পিছনে ফেলে যায় পেটে বাতাস নিয়ে ভিজতে থাকা মানিকের দেহ, থেতলে যাওয়া সখিনার দেহ আর ভিজতে থাকা এক জোড়া লাল জুতা। বৃষ্টির দিনে জুতা পরে না মানিক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.