সাবিনা শারমিন: মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা- সমালোচনা করা যাবে না এটি একটি আবেগ নির্ভর অযৌক্তিক যুক্তি। এ ধরনের যুক্তি সন্ত্রাসের মতো মনে হয়, শুনতে অন্ধ বিশ্বাসের মতো লাগে। সত্য গোপন করার সুগভীর ষড়যন্ত্রের মতো লাগে।

নারীর নিজস্ব অনুভূতির কথা,অবমাননার কথা,অবমূল্যায়নের কথা, নিজস্ব ব্যথার কথা প্রকাশ করার অধিকার আছে। তাতে কারো সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হবার ভয়ে বিষয়টি আজীবন গোপন রেখে অভিজাত হতে হবে, এমন কথা বলাটাই একটি অন্যায় বলেই বিবেচিত হয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘মনেরে আজ কহ যে,ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে। মনিকা লিউনস্কি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের অনৈতিক ঘটনা বিশ্ববাসীর অজানা নেই। বিল ক্লিনটনকে ইম্পিচমেন্ট এ হাজার হাজার মানুষের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। কারণ চারিত্রিক অধঃপতন একজন দেশপ্রধানের ক্ষেত্রে সাধারণ জনতা কখনো মেনে নেবে না। যদি বিল ক্লিন্টনকে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে জনসাধারণের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে হয়, তাহলে অন্য কারো ব্যক্তিগত চরিত্রের স্খলন, নারী বিদ্বেষ অথবা অন্য কোন ভ্রম বছরের পর বছর ঢেকে রেখে অভিজাত তকমা ধরে রাখতে হবে, এমন নির্দেশনা দেয়ার আমরাই বা কে?
চার বছর পর সাবেক স্বামীর কিছু অবমূল্যায়নের কথা বললে সমস্যা কোথায়? বিশেষ করে ওই ব্যক্তি যদি সমাজের কোনো রোল মডেল হোন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন উন্মুক্ত করে বেশি মাত্রায় গবেষণা করা উচিৎ। কারণ তাঁরা সমাজকে খুব গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। স্বামীর পরিচয় অতিক্রম করে একজন হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী নিজ গুণে এবং মেধায় কালক্রমে একজন কবি হয়ে উঠলে অন্য কারো বাড়া ভাতে ছাই পড়ার কথা নয়। সাবেক স্বামীর শিশুকাম, প্রেমের নামে গিভ এন্ড টেক পলিসি গুলতেকিনকে হেয় করেনি, বরং এ ঘটনা তাঁকে আরো বেশী আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে।
সাবেক স্ত্রীর মন্তব্যের জবাবের জন্যে কাউকে চিরকাল বেঁচে থাকতে হবে অনেকের এমন দাবি খুবই হাস্যকর। যে অন্ধ ভক্তরা প্রতি উত্তরের কথা ভেবে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন সেটির উত্তর লেখক তাঁর অসংখ্য বইয়ের পাতায় পাতায় লিখে গেছেন।
একজন মানুষ সামাজিক নিয়ম মেনে এক বা একাধিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন সেটি যেমন খুব অস্বাভাবিক নয়, তেমনি একজন জনপ্রিয় লেখকের ব্যক্তিগত জীবনবোধের সমালোচনা করাও খুবই স্বাভাবিক। যিনি অভিযোগটি করেছেন তাঁর নিজের জীবনের জন্যে তা না করলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে এই সাক্ষাৎকারটি যেন ঢাকা পড়ে থাকা সত্যের উন্মোচন বলেই প্রতীয়মান হয়।
একজন প্রতিষ্ঠিত আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, যিনি জীবন পরিক্রমার যাত্রাপথে বেশীরভাগ পথটাই সাফল্যের সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে পৌঁছেছেন, তিনি ব্যক্তিগত জীবনাচারে হঠাৎ করেই একটি অসম বেমানান কিছু ঘটিয়ে ফেললে সে বিষয়টি তাঁর কাছে খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক মনে হলেও মানবিক বিচারে অনেকটাই তা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
বরং আলোচিত সাক্ষাৎকারটি মাটির নিচের চাঁপা পড়ে থাকা লেখকের নারী বিদ্বেষের পরিচয় যেনো এক সত্যের মুখোমুখি হওয়াকেই মনে হয়, যা ফেইস করার যোগ্যতা বা সাহস অনেকেরই নেই বলেই মনে হচ্ছে। গুলতেকিন খান একপর্যায়ে বলেছেন, তাঁর সাবেক স্বামী তাকে ‘আন্ডারএস্টিমেইট’ করতেন। কেঁদে বুক ভাসানো ভক্তকুলের কথা হচ্ছে তিনি কেন তাঁর মৃত স্বামীর মৃত্যুর পর একথা বললেন।
কেস স্টাডির উদাহরণ হিসেবে দেখলে এর উত্তরটি এমন হতে পারে যে, ভদ্রমহিলা বিখ্যাত স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়ার পরেও তিনি তাঁর স্বামীকে ভালোবাসতেন। আবার এও হতে পারে যে, ভদ্রমহিলা নিতান্তই একজন আত্মমর্যাদাশীল নারী। ব্যক্তিগত রুচিবোধ স্বামীর চেয়ে তাঁর অনেক বেশি প্রখর ছিল।
হুমায়ূন আহমেদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একজন ব্যবসা সফল লেখক। অসংখ্য গুণগ্রাহী ভক্তকুল তাঁর প্রতি আবেগাপ্লুত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পাঁচ (একজন মারা যায়) সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও অনেকবারই তিনি কন্যাসম মেয়ের প্রতি দুর্বল হয়েছেন। সে বিষয়টি বাংলাদেশের কারো কাছেই গোপনীয় ছিল না।
একত্রিশ বছর সংসার করা চার সন্তানের জননীকে যখন কন্যার বান্ধবীর সাথে নিজের স্বামীর হানিমুনের জলে ভেজা যুগল ছবি পত্রিকা খুললেই দেখতে হতো, সে বিষয়টি সহমর্মিতা দিয়ে নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে কল্পনা করে দেখুন দেখি একবার! কারো নৈতিক স্খলনকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে ঢাকবেন না প্লিজ।
গুলতেকিন প্রেরণা ছিলেন কী ছিলেন না, সেকথা আমরা বিচার করার কে? লেখকের প্রথমদিকের সৃষ্টি ‘শঙ্খনীল কারাগার’, নন্দিত নরকের মতো অসাধারণ লেখাগুলো পর্যালোচনা করলেই তো বুঝতে অসুবিধা হয় না।
যে সংস্কৃতির একটি ছোট ছেলেশিশু জন্মের পর থেকেই জেনে বড় হয় যে শুধু পুরুষ হওয়ার কারণেই সে নারীর চেয়ে উন্নত, নারীকে তৈরি করা হয়েছে পুরুষের সেবার জন্যে, সে সমাজে একজন সফল মানুষ তার সফলতার পেছনের কারণটিকে কখনোই সামনে আনতে চাইবেন না, এটি খুব স্বাভাবিক।
শুধু পুরুষরাই পুরুষতান্ত্রিক হবে তা নয়। কখনো কখনো বয়োজ্যেষ্ঠ নারীর পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা পুরুষকেও হার মানায়। তাই অনেক পরিবারেই একজন সফল মানুষের সাফল্যের পেছনের মানুষটির কথা স্বীকার করতে স্বামীর পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনদের অহং এ লাগে। পাছে তাঁর মর্যাদা খুন্ন হয়।
খুব কাছের একজন সাংবাদিক ভদ্রলোককে বিষয়টি নিয়ে তাঁর মতামত জানতে চাইলে উত্তরে তিনি জানালেন, সাবেক স্ত্রী লেখককে প্রেরণা দিতে পারেননি, যা দিতে পেরেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। মনে মনে ভাবলাম, ওয়াজকারী হুজুরদের দোষ দেই কেনো? এরপর আর কথা আগাইনি। বুঝে নিয়েছিলাম আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের মনে একজন স্ত্রীর ভূমিকা শুধু প্রেরণা এবং শান্তি দেয়া।
আরো বুঝলাম পিতৃতান্ত্রিক এই টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বহুকাল ধরে মানুষের অঙ্গহানি হয়ে আছে। যার প্রতিকার সত্যিই খুব কঠিন। লেখকের সাবেক স্ত্রীর উদারতাকে কখনই দুর্বলতা বলতে চাচ্ছি না। তাঁর উদারতা সহনশীলতা নিজের প্রতি, জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা। তিনি অত্যাচারিত এবং নিগৃহীত হয়েও হয়তো ভেবেছিলেন তাঁর স্বামী যা কিছুই করুক না কেন, অবশেষে ঘরের স্বামী ঘরে ফিরবেন।
তিনি হয়তো বিশ্বাসই করেননি যে তাঁর স্বামীর বড় হয়ে ওঠার পেছনে যে শ্রম ও আত্মত্যাগ তিনি করেছেন, কোনদিন তা পায়ে মাড়িয়ে কিশোরী প্রণয়ের দিকে ঝুঁকে পড়বেন তার স্বামী। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন তাঁর ক্ষণিকের মোহ ভাঙ্গলে নিজ সন্তানরাই তাঁর স্বামীর কাছে গুরুত্ব পাবে। তিনি স্বামীর মতো দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেননি, কারণ তাঁর কাছে জৈবিক প্রয়োজনের চেয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
গুলতেকিন আগে যা বলেননি বা বলতে পারেননি, এখন অনেক পরে হলেও তা তিনি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন। হয়তো তিনি এ সময়টিকেই বলার সঠিক সময় হিসেবেই ধরে নিয়েছেন। এমনও হতে পারে যে সন্তানের ভবিষ্যত, তাদের আর্থিক ও মানসিক দিক বিবেচনা করে তিনি ঝঞ্ঝামুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন। আবার এও হতে পারে, তিনি হয়তো প্রতিবাদী নারী নন, পরিস্থিতিও হয়তো তাঁর অনুকুলে ছিল না।
বা এমনও হতে পারে আগে বলতে পারেননি পাছে আবেগ প্রকাশ হয়ে যায় ভয়ে। এখন সময়ের সাথে সাথে সেই আবেগ অনেকখানি প্রশমিত, তাই মনখুলে কথা বলেছেন। তাঁকে আরও বলতে দিলে হুমায়ূন ভক্তদের কী অবস্থা হবে, ভেবেই অস্থির লাগছে।
অনেক পরে হলেও অত্যাচারকে তিনি প্রতিবাদে পরিণত করেছেন । সে কারণে আমার পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে অভিনন্দন । মাইলস টু গো বিফোর উই স্লিপ ।
সাবিনা শারমিন
yes