ইশরাত জাহান ঊর্মি: ইদানিং ইনবক্স ভরে থাকে মেয়েদের জরজর বেদনায়। যে বেদনায় কেউ জ্বলছে বা ভিজছে সেই একই বেদনার মধ্য দিয়ে যদি আমি না যাই তবে সব হয়তো ঠিক বুঝতেও পারবো না। পারিও না সবসময়। কাউকে কাউকে দায়সারা উত্তর দিই, পরামর্শ দিই। আবার কারো প্রতি বিরক্তও হই। ভাবি মেয়েরা কেন এখনও সবকিছুতে এতো পুতুপুতু করে! কেন বুক টান করে হাঁটে না!
ভাবি বটে, আবার হাসিও! এত যেন সোজা!
কত শত গল্প আমার নিজের আছে, আমার পরিবারের আছে, আমার বন্ধুদের আছে, কাছের মানুষদের আছে। সেসব বলতে পারি না। হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, বাঙালী কখনও আত্মজীবনী লিখতে পারবে না, কারণ সে সৎ নয়। এখন যেন একটু একটু বুঝতে পারি কথাগুলো। “সৎ নয়” এর চেয়েও বড় কথা, সত্য কথা যদি আমি বা কোন বাঙালী বলেও ফেলি, তা হজম করার মতো সমাজ কি আমাদের তৈরি হয়েছে? আমরা তাই আমাদের গল্প বলি না। গল্পগুলো চোখের জলে নানান রঙের আড়ালে লুকাই।
কান্দিল বালুচ তার ভাইয়ের হাতে “অনার কিলিং” এর শিকার হওয়ার পর থেকেই এই কথাগুলো ভাবছিলাম। এই সেদিন, ১৪ই জুলাই মেয়েটা লিখলো,
“আধুনিক যুগের একজন নারীবাদী হিসেবে আমি সাম্যে বিশ্বাস করি। নারী হিসেবে আমি কেমন হবো সেটা আমাকেই ঠিক করতে হবে। আমি কেমন হবো সেটা অন্য কেউ বলে দেয়ার অধিকার রাখে না। আমার মনে হয় না শুধু সমাজের জন্যে নারীদের চলতে হবে। আমি মুক্তচিন্তা ও মুক্তমনের একজন নারী। আমি এই আমাকেই ভালোবাসি।”
নিজেকে ভালোবাসা, বিশেষ করে নারীদের নিজেদের ভালোবাসা স্বার্থপরতা, হীনতা হিসেবে দেখা হয়েছে বহুযুগ। এখন কেউ কি বলবেন সেই যুগ আমরা পার হয়ে এসেছি? “অনার কিলিং” এর কত কত উদাহরণ যে আমার জানা। তারই কয়েকটা বলি।
খুব সেক্যুলার পরিবারের মেয়ে। ঈদের চেয়ে পূজায় এই মুসলিম পরিবারে আনন্দ বেশি হয়। মেয়েটির মা-বাবারও মুসলমানের চেয়ে হিন্দু বন্ধু-বান্ধব বেশি। একটা কালচারাল ডাইভার্সিটির মধ্য দিয়ে বড় হওয়া মেয়ে সে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে সে প্রেমে পড়ে এক হিন্দু ছেলের। ওরা আসলে বন্ধু ছিল স্কুল জীবন থেকেই। যা হয় একসাথে চলতে ফিরতে, শেয়ার আর একে অপরকে পড়াশোনায় হেল্প করতে করতে তারা পরিণত বয়সেই এসে প্রেমে পড়ে।
এতোদিন পর্যন্ত মেয়ের মা-বাবা এই ছেলেটিকে “নিজের ছেলের” মতোই দেখেছে, যখনই জানা গেল তাদের মেয়ের সাথে প্রেম, ব্যাস এক লহমায় ছেলেটি হয়ে গেল “মালাউনের বাচ্চা”। এতো সুন্দর, মেধাবী আর শার্প ছেলেমেয়ে দুটি পরিবারের জন্য নিজেদের “অনার কিলিং” এর শিকার হতে দিল।
পারিবারিকভাবে মেয়েটার বিয়ে হলো সহী মুসলমান একটা ছেলের সংগে। এবং সেই সহী মুসলমান ছেলেকেও কালচারাল ডাইভার্সিটি থাকা মেয়েটির পরিবার এখন আর ঠিকঠাক হজম করতে পারছে না। তাদের যন্ত্রণাও দারুণ দেখার মতো। মর্ষকাম মনে হলে হোক, আমি তাদের অনুতাপ উপভোগ করি। কিন্তু মেয়েটার দিকে আমি তাকাতে পারিনা।
সে বলে, আমি মরে গেছি। ধরেই নাও, আমি মরে গেছি। তাকে জীবনে ফেরানোর সব চেষ্টাই ক্রমাগত ব্যর্থ হতে থাকে। বলুন, এটা কি “অনার কিলিং” নয়?

আরেকজনকে জানি। জন্মগতভাবে হিন্দুধর্মী নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছিল মুসলমান ছেলেকে। কম বয়সে। বিয়েটা ভুলই ছিল। তা ভুল তো হতেই পারে। মানুষ যদি হয়, তার ভুলও তো হয়। কিন্তু অন্য ধর্মে আর নিজের স্বাধীনতার মূল্য তাকে দিতে হচ্ছে এখনও প্রতি পলে পলে। বিয়েটা টেকেনি যথারীতি, প্রথমে ছাড়াছাড়ি, একদিন ওই লোকটা মারাও গেল। কিন্তু মেয়েটির পরিবার এখনও যেন সেই ‘সম্মানহানি’র অবস্থা থেকে বেরুতে পারছে না। এতো বছর পরেও নিজের ছেলেমেয়ে শুদ্ধ পরিবারের কাছ থেকে নানান গঞ্জনা নিতে হচ্ছে।
“অনার কিলিং”-এর শিকার হয়ে একটা গোটা জীবন পার করে দিল এই মানুষটা।
আরেকটা গল্প জানি। ছেলেমেয়ে দুজনেই খুব আধুনিক। ধর্মটর্মের বর্ম অত মানে না। তুমুল প্রেমে সময় কাটায়। তারপর যখন বিয়ের সময় হলো, ছেলেটি মেয়েটাকে বলল, তুমি মুসলমান হয়ে যাও, তাহলেই আর কোনো সমস্যা নেই। আমার পরিবারও মেনে নেবে। এতোদিন ধরে এতো এতো সাম্য আর আধুনিকতার কথা বলা ছেলেটি যখন এই কথা বললো, মেয়েটা বজ্রাহত হলো। খুব বিপ্লবী পুরুষ বাস্তব জীবনে এসে হয়ে গেল রক্ত পরিষ্কার করা মডারেট মুসলিম! মেয়েটা এখন ঘর থেকেই বের হয় না। তাও ভালো যে সে ছেলেটার কথা শুনে পুরোটা জীবন বিসর্জন দ্যায়নি। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এইরকম আরও অন্তত: হাফ ডজন গল্প আমার মনে পড়ছে। শুধুই ধর্ম নয়, সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গভেদ এরকম কত কারণে কত নারী-পুরুষ নিজেদের ডিজায়ারকে প্রতিদিন মেরে ফেলে। এখন কথা হচ্ছে, যে ঘটনাগুলি বললাম, সেসব ক্ষেত্রে বিয়েটা ঘটলেই যে সবকিছু নিখুঁত হতো, তা-ও হয়তো নয়। কিন্তু এই যে মানুষের ইচ্ছে, কামনাকে সমাজ, পরিবার নিজেদের ঠুনকো আর বায়বীয় সম্মানের কারণে অসম্মান করে, এই মানুষগুলির বেদনা কি আমরা কখনও ছুঁয়ে দেখি?
আর সবচেয়ে বড় আশংকার কথা হলো, আমরা যারা এই সমাজে খুব আধুনিক বলে দাবি করি, আর্ট কালচার বুঝি, ধর্ম নিয়ে “বাড়াবাড়ি” করি না, আমি লিখে যাচ্ছি, মিলিয়ে নেবেন, আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটনায় মনের মধ্যে ‘অনার কিলিং’ এর বাসনা সুপ্ত হয়ে আছে।
আমার এই আশংকা মিথ্যা হোক। মিথ্যা হোক। মানুষকে আমরা মানুষ হিসেবেই দেখি। আর প্রতিটা নারী বা পুরুষ লজ্জা না পেয়ে দৃঢ়ভাবে বলি, “আমি এই আমাকেই ভালোবাসি।” কোন “অনার”-এর ধার আমি ধারি না!