অনার কিলিং- এদেশেও সমর্থকের অভাব নেই

ইমতিয়াজ মাহমুদ: (১) মেয়েটির আসল নাম ফওজিয়া আজিম। কিন্তু ফেসবুকে, টুইটারে সে নিজের নাম রেখেছিল কান্দিল বালুচ। মেয়েটিকে ওর ভাই গত শুক্রবার গলা টিপে মেরে ফেলেছে। কেন? অনার কিলিং- পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্যে মেয়েদেরকে মেরে ফেলার যে প্রথা পাকিস্তানে চালু আছে, সেটা।

Pakistan Honour killingকোনো মেয়ে যদি এমন কোনো কাজ করে যার জন্যে ওর পরিবারের সদস্যরা মনে করে যে ওদের মান সম্মান নষ্ট হয়েছে তাইলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মেয়েটিকে মেরে ফেলতে পারে। আইনগতভাবে এইরকম হত্যাকাণ্ড অবশ্যই অনুমোদিত না। কিন্তু কে করে আইন কানুনের কেয়ার?

মেয়েদেরকে প্রতিদিনই মরতে হচ্ছে সেখানে কোনো না কোনো কারণে পরিবারের সদস্যদের হাতে। হয়তো প্রেম করেছে, পরিবারের সদস্যরা জেনেছে, ব্যাস, মেরে ফেল। কেউ হয়তো শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছে প্রিয়জনের সাথে- ব্যাস, মেরে ফেল। কী হয়তো নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছে এমন কাউকে যাকে ওর পরিবারের সদস্যরা যোগ্য মনে করছে না- ব্যাস মেরে ফেল। আর এই যে মেরে ফেলা হচ্ছে মেয়েদেরকে, সমাজের লোকজন খুব একটা কেউ সেটাকে খুব অন্যায় মনে করছে না। আর আইন? আইন কী করবে? পুলিশও তো এইধরনের কাজকে খুব গুরুতর কোনো অন্যায়ই মনে করে না।

নারীকে মেরে ফেলা- সেটাকে তো ওরা ঠিক খুন খারাবিই মনে করে না। খুন মানে তো নরহত্যা- আপনি যদি একজন পুরুষকে হত্যা করেন, সেটা একটা গুরুতর অপরাধ বটে। পুরুষ মারা মানে তো মানুষ মারা। নারীকে হত্যা করা তো আর ঠিক মানুষ হত্যা হলো না। নারী কি মানুষ? মানুষ না তো। নারী হচ্ছে মেয়ে মানুষ- মানুষের চেয়ে একটু কম- ঊনমানুষ। সুতরাং নারীকে মারলে মানুষ মারার সমান অপরাধ কেন হবে?

এই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি। এটা যে কেবল পাকিস্তানেই আছে সেরকম ভাবার কোন কারণ নাই। ভারতেও অনার কিলিংএর চল আছে। মুসলমানদের মধ্যে তো আছেই, হিন্দুদের মধ্যেও আছে। নারীকে নিচু দেখার ক্ষেত্রে কোন ধর্মই কোনটার চেয়ে কম যায় না।

(২) কী করেছিল ফওজিয়া? কী এমন করেছিল যাতে করে ওর পরিবারের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে গেল? কী এমন করেছিল যে ওকে খুন না করে ওর ভাই থাকতে পারলো না?

Pakistan killingফওজিয়া দেখতে শুনতে বেশ ভাল। কিছু মডেলিংও নাকি করেছে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স। কান্দিল বালুচ নামে ওর রয়েছে একটা ফেসবুক পেইজ আর টুইটার একাউন্ট আর ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি। এইসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ওর নিজের ফটো পোস্ট করতো। আমি কয়েকটা ফটো দেখেছি। সেজেগুজে পশ্চিমা ধরনের কাপড়-চোপড় পরে নিজের ছবি নিজে তুলে পোস্ট করতো। কড়া করে লিপস্টিক মেখে বুলবুলির ইয়ের মতো ঠোঁট করে ছবি তোলা, এই-ই তো। আর ভিডিও পোস্ট করতো। আর নিজের কথা বলতো।

একটা কাগজে পড়লাম সে নাকি পাকিস্তানের কিম কারডাশিয়ান নামে পরিচিত ছিল। কিম কারডাশিয়ানটা কে আমি জানতাম না। খোঁজ করে জানতে পারলাম এই অদ্ভুত প্রতিভার কথা। নিজের কথা বলে বলে আর নিজের ফটো দেখিয়ে দেখিয়েই নাকি সুপার সেলিব্রিটি হয়ে গেছেন এই আমেরিকান ভদ্রমহিলা।  ফওজিয়াও অনেকটা সেরকমই বটে। ওর অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে গিয়ে দেখি পৌনে আট লাখের বেশি ওর ফলোয়ার। এই মেয়ে আবার আনাড়ি ধরনের হলেও একটু গানও করে। খানিকটা প্রতিবাদী ধরনের কথাও পোস্ট করতো এই মেয়ে। সমাজের গোঁড়ামি ভাঙতে চাই ইত্যাদি।

একটা ফটো দেখলাম বেশ ইন্টারেস্টিং। এক মৌলানা সাহেবের সাথে তোলা একটা ফটো পোস্ট করেছে সে। ফটোতে দেখা যাচ্ছে মৌলানা সাহেব মোবাইল ফোনে কথা বলছে আর মৌলানার জিন্না টুপিটা নিজের মাথায় পরে লাস্যময় ভঙ্গিতে পাউট বানিয়ে সেলফি তুলছে। এই মৌলানা নাকি আবার পাকিস্তানের এক বিশিষ্ট আলেম। আলেমদের কী কী সব কমিটি ইত্যাদির নেতা।

(৩) এইসব ছবি আর ভিডিও পছন্দ করেনি ওর ভাই। এইসব ফটো আর ভিডিও এইগুলির কারণে নাকি ওদের পরিবারের মান সম্মান উড়ে গেছে। ব্যাস। শুক্রবার রাতে বোনের ঘরে ঢুকে গলা টিপে বোনকে মেরে ফেলেছে। শনিবার যখন ওকে পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছে, গুণধর ভাইটি বেশ বুক ফুলিয়েই বলেছে, হ্যাঁ, আমিই মেরেছি, বেশ করেছি।

Pakistan Killing 2আর ফওজিয়ার মৃত্যুতে পাকিস্তানে মানুষের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে জানেন? একটা বড় অংশের মানুষ বলছে, না, ওকে মেরে ফেলেছে বেশ করেছে। মেয়ে মানুষ হয়ে কেন এইসব করতে গেছে। আর কিছু মানুষ বলছে যে, না, হত্যা করা তো অন্যায় মানি, কিন্তু ভাইটার কি দোষ, দোষ তো ঐ মেয়েরই ইত্যাদি। অল্প সংখ্যক মানুষ অবশ্য আছেন, খুবই অল্প সংখ্যক, নারী অধিকার কর্মী, নারীবাদী বা লিবারেল এরা, এরা কেবল মুক্তকণ্ঠে প্রতিবাদ করছে।

এইখানেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভণ্ডামি। লাখে লাখে মানুষ লাইন ধরে এই মেয়েটির ফেসবুক পেইজে লাইক মেরেছে। ওর সব ছবি চেটেপুটে দেখেছে। সেইসব ঠিক আছে। কিন্তু সব দোষ কিনা এই মেয়েটিরই। ঐ যে মৌলানা সাহেবের কথা বলেছি, মুফতি আবদুল কাভি ওর নাম, মেয়েটির মৃত্যুর পর ওর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, বেশ হয়েছে, এইটা নাকি ওর প্রাপ্য ছিল। ভণ্ডামি কাকে বলে দেখেন।

দেখেন এই যে এরা মেয়েদেরকে এইভাবে পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্যে মেরে ফেলে- এটা তো ফৌজদারি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সে তো আছেই। এর জন্যে তো মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই অপরাধকেও অকাতরে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

(৪) কেন ভাই। একটা মেয়ে যদি তাঁর নিজের শর্তে জীবনযাপন করতে চায়, তাইলে তোমাদের কি? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কিভাবে তাঁর নিজের জীবনযাপন করবে সেটা কি তার পরিবার তাকে নির্ধারণ করে দিবে? কেন? নারী বলে? নারী বলেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটা মেয়েকে তার ভাইয়ের পছন্দমত জীবনই তাকে যাপন করতে হবে? কেন? আরে সে তার নিজের মতো করে তার নিজের জীবন-যাপন করবে। তোর যদি পছন্দ না হয়, তুই তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন কর। তোর পছন্দ কেন আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিবি? কী অধিকারে?

women torture 1ভাইয়ের জীবন যাপনের ধরনের উপর কি তার বোনের মতামতকে গ্রাহ্য করা হয়? ভাই যদি ব্যক্তিগত জীবনে অনাচার করে তার জন্যে কি একজন বোন তাকে হত্যা করতে পারবে? সেটা তো আবার তোরা করতে দিবি না। যে কাজ করলে বোনটিকে মেরে ফেলছিস তোরা, একই কাজ যদি একটা ছেলে করে তাইলে সেই ছেলেটিকেও কি মেরে ফেলবি? সেটা তো করছিস না। কেন? না, মেয়ে তো ছেলের সমান না। মেয়ে তো ছেলের চেয়ে মর্যাদায় ছোট।

ভণ্ডামি দেখেন। এমনিতে দেখবেন এরা বলে কন্যা সন্তান দিয়ে নাকি বংশ রক্ষা হয় না। মূর্খগুলি বলে কন্যা নাকি বংশের কেউ না। এই অছিলায় কন্যাকে সম্পত্তির অধিকারও পুরাপুরি দেওয়া হয় না। পুত্র সন্তান না হলে একটার পর একটা সন্তান নিতে থাকে। বউকে নিন্দামন্দ গালাগালি দোষারোপ এইসব করে। পুত্রের জন্য কাঁদে। পুত্র নাকি রক্তের ধারা রক্ষা করে? আরে বদমাইশের দল, কন্যা যদি তোর বংশই না হবে তাইলে সে কি করলো না করলো তাতে তোর বংশের মর্যাদা চলে যায় কিভাবে। ভণ্ডামিরও তো একটা মাত্রা থাকে, নাকি?

এইসব কিছু না। আসল কথা হচ্ছে নারীকে সম্পূর্ণ মানুষ বিবেচনা না করা। আসল কথা হচ্ছে নারীকে ভোগের পণ্য আর সন্তান বানানোর মেশিন বিবেচনা করা। আসল কথা হচ্ছে নারীকে ক্রীতদাসের সমান একটা কিছু বিবেচনা করা। নারী কেন তার নিজের ইচ্ছায় জীবনযাপন করবে? এদের দৃষ্টিতে বাপের ঘরে নারী থাকবে চাষির ঘরে সুস্বাদু ফলটির মত, বা সুগন্ধি ফুলটির মতো আনকোরা অনাঘ্রাতা। বাপ-মার দায়িত্ব হচ্ছে এই রসালো ফলটি স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া। ফলের আবার ইচ্ছা কী, আর অনিচ্ছাই কি? নারী কেন তার ইচ্ছামত জীবন যাপনের স্পর্ধা দেখাবে? দাসী যদি ইচ্ছামত চলতে চায় তাইলে তাতে গৃহস্থের অমর্যাদা হয় না?

(৫) এইটা তো গেল পাকিস্তানের কথা। অনার কিলিং এর কথা। পাকিস্তানে তো এরকম হচ্ছে। ইন্ডিয়াতেও হচ্ছে। আজকে এই মেয়েটির মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি- কিন্তু আমরা খবর পাইনা এরকম অনার কিলিং প্রতিনিয়তই সেসব দেশে হচ্ছে।

আর আমাদের দেশে?

nariনা আমাদের দেশে অনার কিলিং হয় না সেরকম। মানে মেয়েদেরকে ওদের পরিবারের সদস্যরা এইরকম প্রাণে হয়তো মেরে ফেলে না। কিন্তু ঐটুকুই- প্রাণে মেরে ফেলাটাই বাকি রাখে। কিন্তু অপমান আর হেনস্থা করার ব্যাপারে আমরা পাকিস্তান বা ভারতের চেয়ে কি খুব একটা অগ্রসর? নিজের চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখেন তো!

নিজের পছন্দমতো জীবনযাপন করতে চেয়েছে বলে নারীকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে এরকম ঘটনা কি আপনি কম দেখেছেন? স্বাধীনভাবে কথা বলার অপরাধে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এরকম নারী কি আপনি দেখেননি? একান্তই যে নিজের শরীর, সেই শরীরটার উপরও কি নারী তার নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে? নারীর বিষয়ে পাকিস্তানের চেয়ে আমরা অগ্রসর এই কথা ভেবে কি আমাদের ঢেকুর তোলার সুযোগ আছে? ভেবেছেন?

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার যেটা- আপনি কি জানেন বাংলাদেশের কতজন মানুষ এইরকম অনার কিলিং সমর্থন করে?      

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.