শান্তা মারিয়া: ডকুড্রামার প্রোমো দেখে ভুল বোঝার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। তবে পুরো ডকুড্রামাটি দেখার পর মনে হয়েছে, নির্মাতারা তাদের বক্তব্য মোটামুটিভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। বলছি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এর নতুন বানানো আলোচিত ডকুড্রামাটির কথা।
ঢাকা নগরী এবং পুরো দেশই নারীর জন্য অনিরাপদ। পহেলা বৈশাখেও রেহাই নেই নারীর। রেহাই নেই কর্মক্ষেত্রে, চলতি পথে। আছে বখাটেদের যৌন হয়রানি, স্কুলে আছে পিডোফাইলাক, কারখানায় নির্যাতন।
নারীর উপর যৌন হয়রানির প্রসঙ্গ উঠলেই অনেকে বলে ওঠে হিজাব পরলে এসব ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো হিজাব তো নয়ই, কোনো বিশেষ ধরনের পোশাকই নারীকে নিরাপত্তা দিতে পারে না। নারীর নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জনপ্রতিরোধের মাধ্যমে।
হ্যাঁ এসব বক্তব্য ডকুড্রামাটিতে মোটামুটিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এসেছে জনপ্রতিনিধির বক্তব্য, তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, পুলিশের কথা। বেশকিছু তথ্যও উপস্থাপিত হয়েছে। নারীর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করায় অ্যাকশনএইডকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কারণ ঢাকা শহরটা (পুরো দেশই) সত্যিই নারীর জন্য বড় বেশি অনিরাপদ।
ডকুর শেষদিকে জনসচেতনতা এবং নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রয়াসের উপযোগিতা তুলে ধরা হয়েছে। নারীর বেশকিছু সাহসী বক্তব্যও রয়েছে। সেজন্যও ধন্যবাদ। যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধে দেশে যে আইনগুলো প্রচলিত রয়েছে সেগুলোর উপর আরও কিছু তথ্য পেলে ভালো লাগতো।
তবে ডকুড্রামার শুরুর অংশ নিয়ে প্রতিবাদ করছি এবং করবো। এই একই বক্তব্য ভিন্নভাবেও দেওয়া যেত। অর্থাৎ নারীকে টিপ্যিকাল ভূমিকায় না দেখিয়েও করা চলতো। যেমন দেখানো যেত যে নারী একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন, একজন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন, পাইলট হচ্ছেন, নাবিক বা সৈনিক হচ্ছেন, তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
অথচ এই অগ্রসর ভূমিকাতে যারা রয়েছেন তারাও কিন্তু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তার জেন্ডার পরিচয়ের কারণে। একজন সাংবাদিক নারীও শিকার হচ্ছেন সহিংসতার ও যৌন হয়রানির। সেটি শুধু পথেঘাটেই না, ঘটছে এমনকি তার কর্মক্ষেত্রেও।
একজন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী এমনকি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত নারীও নিরাপদ নয় যৌন হয়রানি ও সহিংসতা থেকে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক বা গৃহবধূ হিসেবে সমাজে নারীর অবদানকে আমি অবমূল্যায়ন করছি। তবে এই ভূমিকায় নয়, নারীকে দেখতে এবং দেখাতে চাই আরও চ্যালেঞ্জিং ভূমিকায়।
কিন্তু নির্মাতাদের প্রতি একেবারে আকুল আবেদন যে শুরুর বকবকানিটা প্লিজ প্লিজ প্লিজ পরিবর্তন করুন। ‘নারী তুমি রূপসী, নারী তুমি স্নিগ্ধ, নারী তুমি মমতাময়ী, তুমি আশ্রয়, তুমি প্রেমিকা..’ ব্যাকগ্রাউন্ডে এই মানপত্র এবং আমলনামা বদলান। বরং শুরুতে দিতে পারেন অর্থনীতিতে নারীর অবদান, শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অবস্থান, নারীর গৃহশ্রমের আর্থিক মূল্য ইত্যাদি।
নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতা কিভাবে এই অবদানকে পিছিয়ে দেয় এবং সহিংসতার ফলে অর্থনীতিও সামগ্রিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেই তথ্যটা দিন। সাজগোজ করা নারীর সামনে প্রেমিকের চুড়ি দোলানোর দৃশ্যটা প্লিজ এডিট করে বাদ দিন। কারণ সাজগোজ করা পুতুল মার্কা নারীকে অনেক পুরুষ আক্রমণ করছে আর প্রেমিক পুরুষের তাকে রক্ষা করার চেষ্টা- সেটা দেখতে বড্ড বেশি ঢালিউডি-মার্কা মনে হয়।
বরং জনতার প্রতিরোধের দৃশ্যটি ভালো লেগেছে। এই জায়গাটি প্রতীকী না করে, বরং বর্ষবরণে নারী যাচ্ছে এবং তাদের উপর অপরাধীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই ঘটনাটিই অভিনয়ের মাধ্যমে দেখানো যেত। তারপর আসতে পারতো জনপ্রতিরোধ।
ডকুড্রামার প্রথম অংশটি প্রোমো হিসেবেই কিন্তু যাবতীয় ভুল বোঝার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে ‘নারী তুমি রূপসী….ব্লা…ব্লা’ এবং নারীর লম্বা চুল ঝাড়ার দৃশ্য।
প্রোমো হিসেবে অন্যান্য অংশগুলো দেখলে এই ভুল বোঝার সৃষ্টি হতো না হয়তো। যাই হোক কিছু সাহসী বক্তব্য এবং বিশেষ করে নারীর জন্য নিরাপদ নগরী গড়ার প্রয়াসকে ধন্যবাদ জানাই।
শান্তা মারিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক