সাদিয়া নাসরিন: কর্মজীবী “মা” না বলে রোজগেরে “মা” বললাম হোমবেইজড মায়েদের প্রতি সম্মান জানিয়ে। কারণ আমার মনে হয়, পৃথিবীতে এমন কোনো মা নেই যে কর্মজীবী না। রোজগার করি বা না করি, সন্তানের জন্য আমরা পৃথিবীর সমস্ত মায়েরা এক ও অভিন্ন দায়িত্ব পালন করি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছি আমি। ২০০৫ সালে পনের মাসের মেয়েকে নিয়ে জামাইর সাথে ঢাকা আসলাম চাকরি করতে। মানে রোজগার করতে। সাড়ে আট হাজার টাকা বেতনে একশন এইডের একটা প্রজেক্ট এ চাকরি শুরু করলাম। ভরসা পরমাত্মীয় “আলেয়া” আর “খালেদা”। চাকরি করতে এসে মনে হলো আইন পড়াটা দরকার। চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা শুরু করলাম। আমার মেয়েটা তখন দু’বছরের। এলএলবি পরীক্ষা দিলাম আমার বড় ছেলের মেটারনিটি লিভে। এক শুক্রুবার পরীক্ষা দিয়ে ওটি করলাম, পরের শুক্রবার আবার সিক বেডে পরের পরীক্ষা দিলাম। এলএলবি পাশ করলাম।
চাকরি করতে করতে মনে হলো এভাবে নাক মুখ বুজে ফরমেটিভ কাজ করা আমার পোষাবে না। আমি পজিশন চাই। তার জন্য নিজেকে ডেভেলপ করতে হবে। এদিকে পিঠাপিঠি দুটো ছোট বাচ্চা। স্বামী -স্ত্রী দুজনেই সকালবেলা কাজে বের হয়ে যাই। এনজিও সেক্টরে কাজ করি দুজনই। প্রায়ই ফিল্ড ভিজিট করতে হয়। দেশের বাইরে যেতে হয়। আমরা অদল-বদল করে ভিজিট প্ল্যান করি।
কিন্তু মাঝে মাঝে কোনভাবেই প্ল্যান ম্যাচ করে না। দুজনেরই ভিজিট পড়ে যায়। কখনো আম্মা এসে থাকেন, কখনো আব্বা, কখনো আমার ছোট ভাই। সারাদিন অফিস, বাসায় ফিরে রান্না, সংসার আর সবাই ঘুমিয়ে গেলে আস্তে করে ল্যাপটপ খুলে নিজের জন্য পড়াশোনা।
২০০৯ সালে আমি একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার কান্ট্রি ম্যানেজার হলাম, যাকে বলে দেশীয় প্রধান। আমার বয়স তখন ত্রিশ। আমার হাজার রাত জাগার বিনিময়ে আমার ক্যারিয়ার। শিশু পাচার প্রতিরোধ, প্রত্যাবর্তন, পুনর্বাসন নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের যৌথ কার্যক্রম “সংযোগ”। ২০১০ সালে এই কার্যক্রম সংস্থার আকারে আমার দায়িত্বে দিয়ে দিল সেন্ট্রাল মেনেজমেন্ট। মানে আমি তখন এই জাহাজের নাবিক। নতুন পথ, নতুন ইস্যু, নতুন দায়িত্ব ,নতুন চ্যালেঞ্জ।
এই সময়টাতে আমি আবার কনসিভ করলাম। একটা নতুন সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ, অন্যদিকে শরীর। কারো সাথে কথা বললেই বমি আসে। অথচ কত রকম লোকজনের সাথে যে তখন কথা বলতে হতো!! অফিস প্রচুর সময় নেয়, অনেক সুবিধাও দেয়। অফিস গাড়ি দিল। অফিসে বাচ্চাদের রাখার ব্যবস্থা করলাম। ওদের স্কুলে আনা নেয়ার সময় করে নিলাম। মিটিং এ গেলে সাথে নিতে পারি। বাচ্চারা আমার সাথে সারাদিন থাকে।
২০১১ ‘র মে মাসে সংযোগ বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন পেলো, জুন মাসে ও এলো। আমাদের ছোট ছেলে। ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে ওটিতে ঢুকেছিলাম, আর তের ঘন্টা পর বেড উঁচু করে ল্যাপটপ ওপেন করতে হয়েছিল। মেয়েটি তখন সাত বছরের, বড় ছেলে পাঁচ বছরের। বাচ্চাগুলো একা থাকবে বলে দ্বিতীয় দিনেই বাসায় ফিরতে হয়েছিল। আর চারদিনের দিন বাসায় আমার ইন্ডিয়ান টিমের সাথে মিটিং।
তিনটা বাচ্চা আমার সাথে ল্যাপটালেপটি করতে করতেই বড় হতে থাকলো। আমি অফিস করি, ওরাও করে। কাজের ফাঁকে ওদের চুমু খেতে হয়, গল্প শুনতে হয়, ওদের খাওয়াই, ঘুম পাড়াই। ওরা বড় হতে থাকে, সংযোগও বড় হতে থাকে। ফান্ড রেইজিং, ডোনার ম্যানেজমেন্ট, রিপোর্টিং , অডিটিং…..নিজের দিকে তাকানোর কোন সময় নেই। মিটিং এ গেলে সবগুলোকেই নিয়ে যাই। গাড়ি ভর্তি খাবার থাকে, খেলনা থাকে, কাঁথা-বালিশ থাকে।
আমার সংসার তখন ভ্রাম্যমান। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলেই কাছা বেঁধে কাজ করি, রান্না করি, বাচ্চাদের খাওয়াই। এতোকিছুর মাঝেও ওদের স্কুলের টিফিনে যেন বাইরের খাবার না দিতে হয় তার জন্য রাত জেগে পাউরুটি, বান, সমুচা, চিকেন ফ্রাই করে রাখি। এক সময় আমার হাইপারটেনশন দেখা দিল। সব সময়, সবকিছুতেই খালি মনে হয় দেরি হয়ে যাচ্ছে। এই রোগ এখনো আছে।
ধীরে ধীরে শুরু হলো অন্য রকম যুদ্ধ। মেয়েটা বড় হচ্ছে। এই তো তেরোয় পা দিলো, মানে স্টেপিং ইনটু টিন। মেজো জন মানে বড় ছেলে এগারোতে। টিনের কাছাকাছি। একজন প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে, আর একজন দাড়ি কখন উঠবে সেই চিন্তায় অস্থির !
এই টিন এজড আবেগের সাথে ডিলিংটা একটু কঠিন। এটার জন্য প্রস্তুতি লাগে। একজন ছেলে, একজন মেয়ে। দুজনের আবেগ , কৌতুহল সম্পূর্ণ ভিন্ন। কয়েক বছর আগে এক রাতে দুজনকে দুপাশে নিয়ে সেক্সুয়াল এবিউজ নিয়ে কথা বলছিলাম। ছেলে হঠাৎ প্রশ্ন করলো “যৌন” মানে কি? এই উত্তর দিতে আমার চিকন ঘাম বের হয়ে গিয়েছিল। এখন ওরা কথায় কথায় রাগ করে । একজনকে বেশি এটেনশন দিলে অন্যজন ডিপ্রাইভ্ড ফিল করে।
ওরা অনেক কথা বলতে চায়, সব শুনতে হয়। আর ছোটটা তো এখন পাঁচ। এক দণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারে না। ও নাকি আবার ওর বান্ধবী সামিহাকে “লাভ” করে!!! ওর আবার কিছুক্ষণ পর পর স্মল, বিগ, টাইট, লাইট, বিভিন্ন টাইপের কিসি দিতে হয় মাকে। কী মুশকিল!! এই মধুর সময়টা আমি কীভাবে হারাতে দিই?
ওরা কাঁদে, হাসে, ঝগড়া করে, সবটাতেই মাকে দরকার ওদের। কী করি !! ঠিক এইসময় জীবনের সেটআপ চেঞ্জ করলাম। বাসা নিয়ে আসলাম অফিস আর স্কুলের একদম কাছে। বাসাতেই অফিসের একটা সেট আপ করে নিয়েছি। বাসায় থেকে কাজ করি। দরকার হলে অফিসের লোক বাসায় আসে। কারণ আমি ওদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে ওদের সাথে থাকতে চাই। আমি ওদের সব কথা শুনতে চাই। ওদের কাছে থেকেই আমি আমার পেশার কাজটা করতে পারছি এই তো অনেক ভাগ্যের।
আমি রোদ দেখি না, চাঁদ দেখি না, বৃষ্টি দেখি না। শুধু বেঁচে থাকি। ওদের জন্য বাঁচি। মেয়েটা খুব ভালো গান করে, ছেলেটা ক্রিকেট খেলে। আমি পাশে না থাকলে কী হবে! যখন স্কুল থেকে বলে, আপনার বাচ্চারা খুব ডিসিপ্লিন্ড, সেল্ফ অরগানাইজড, ওয়েল ম্যানার্ড, তখন কেবল মনে হয়, পৃথিবীতে কিছুই ফেলনা নয়। এসবই তো আমার।
এতোদিন মনে হতো ওদের নিরাপদে ভালো মানুষ করে তোলাটাই আমার দায়িত্ব। কিন্তু না, আমি ইতিমধ্যেই জেনে গেছি, কেবল ওটুকু হলে চলবে না। যদি বাঁধন এক সুতোও আলগা হয়ে যায় তাহলে আমার সন্তান আমার বুক থেকে নিয়ে যাবে “ধর্মচোষা”। আমার সবচেয়ে বড়ো কাজ ওদের মাথা থেকে “ধর্ম” সরিয়ে “মানুষ” ঢুকিয়ে দেয়া। মানুষ চিনলেই ওরা ধর্ম চিনবে। ওদের মানুষ চেনাতে হবে, মানুষ বোঝাতে হবে, মানুষ বানাতে হবে। যতক্ষণ ওরা জেগে থাকে, আমি ওদের হই। ওরা ঘুমিয়ে গেলে আমি তবে আমার হই। সংযোগের হই। এভাবেই আমি “মা”। রোজগেরে “মা”।
এই রোজগেরে “মা” হতে গিয়ে কম কথা তো শুনতে হয়নি আমাকে… দজ্জাল, মদ্দা, ডমিনেটিং, সংসারি না…অনেকেই বলেন, আমি নাকি স্বামী-সন্তান-সংসার রেখে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াই শুধু টাকার জন্য…..অনেকেই প্রশ্ন করে স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলে কীভাবে আমি সারারাত ল্যাপটপে বসে থাকি……কিন্তু থেমে যাইনি তো!! শত্রুর মুখে ছাই ঢেলে ঘাড়ের রগ সোজা করে বুক টান করে হেঁটেছি।
এটা আসলে জীবনের একটা রেইস। কখনো যে হারিনি তা নয়, বরং অনেক অনেক বার ভীষণ হেরে গেছি। হোঁচট খেয়েছি, টালমাটাল হয়েছি। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েছি বারবার। আর প্রতিবার পড়ে গিয়ে কষ্ট পেলে ভেবেছি, যারা দৌড়ায় তাদেরই তো পড়ে যাবার ভয় থাকে। যে দৌড়াতেই জানে না, সে পড়েও না, হারেও না। তাই জেতার আনন্দও সে জানে না। কতবার পথ হারাতে হারাতে দুহাতে আঁধার সরিয়ে আলো খুঁজে পেয়েছি! কী তীব্র যন্ত্রণার বিষকে বিষের দাহ দিয়ে পুড়িয়েছি! সব এই এক জীবনের আলোছায়া।
ইদানীং একটা কথা খুব শুনছি। আমাদের মতো করে মেয়েরা এগিয়ে এলেই নাকি দেশ এগিয়ে যাবে। কথাটা সত্যি। কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়ার পথটাই যে এখনো কাটা হয়নি পুরোপুরি। আধ-কাটা, খানা-খন্দ, আর খাড়া পথে এগিয়ে যাওয়া যে কী জিনিষ সে তো শুধু এই “আমরা”ই জানি।
বহুত দম লাগে,তেজ লাগে, ঘুরে দাঁড়ানোর মতো জোর লাগে। ক্লান্তিতে মায়ের মতো ছায়া লাগে, বাবার মতো ঝড়ে আগলে রাখার বাহু লাগে আর??? দম পড়ে গেলে দম দেয়ার মতো নির্ভরযোগ্য সঙ্গী লাগে। আমি ভাগ্যবান আমি সব পেয়েছি।
আহারে!! চারপাশে সমুদ্র রেখে কী বিপুল তৃষ্ণাতেই না জীবনটা পার করছে ওরা। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি শুয়ে থেকেও “স্বাতন্ত্র্যের” মাজেজাই বুঝলো না। স্বামী- স্ত্রী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রান্না করছে, একজন পাতিল ধুলে আরেকজন পেঁয়াজ কাটছে, এর চেয়ে রোমাঞ্চকর প্রেম কি আর হয়? বউ রাত জেগে কাজ করছে বলে জামাই ভোরে উঠে বাচ্চাদের রেডি করে স্কুলে দিয়ে আসছে……বউ এর মিটিং ছিল, রাত হয়ে গেছে, জামাইটা এই ফাঁকে যাহোক একটা কিছু রেঁধে টেবিলে রেখে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে………এই সম্মান কি শুধু বউ টাকা রোজগার করছে বলে? নাকি স্বতন্ত্র যোগ্যতার প্রতি সম্মান?
তোমরা কোনোদিন কি বুঝবে সে সুখ? আহারে……জীবনের এত রঙ, এত স্রোত, এত প্রেম, এত সুখ, এত ফুল সব কী শুধু দুটো শরীর পাশাপাশি ঘষাঘষি করে আর মন কষাকষি করে নষ্ট করার জন্য? এ যে সোনার জীবন…কী তীব্র অযত্নেই না কাটিয়ে দিলে তোমরা……আহারে…আহারে……
“আমি অকৃতি অধম বলে কম কিছু তো মোরে দাওনি/ যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো নাওনি”।
Your Comment really motivational
দিদি,খুব ভালো লিখেছেন।রোজগেরে বউ হয়ে যদি মেয়েরা শাশুড়ির কাছ থেকে একটু সহানুভূতি পেত তাহলে হয়ত আমরা একটু স্বতি হত।
Ha,sotti, lekhata prerona dayok.kintu sobai ekvabe egiye jete parena.ei apu tar sami sontanke niye egiye cholesen,kintu amra onekei ta parina.ami amar ek sontanke niye thaki r amar husband arek meyeke niye thaken.sobai kisu na kisu theke bonchito hossi.tobu egiye cholesi.
প্রেরণাদায়ক লেখা , ধন্যবাদ
Nice write up.besh koyekbar pora hoye gelo.
ভাল লাগল লেখাটা।