নাদিয়া ইসলাম: পাকিস্তানী মডেল কান্দিল বালুচ (ফৌজিয়া আজিম) গতকাল তার নিজের বাড়িতে নিজ ভাইয়ের হাতে খুন হইছেন বইলা পাকিস্তানী পুলিশ জানান। পাকিস্তানে অনার কিলিং নতুন না।

ইংল্যান্ডে পাকিস্তানী দম্পতি ইফতেখার এবং ফারজানা আহমেদ তাদের ১৭ বছরের মেয়ে শাফিলিয়া আহমেদরে হত্যা কইরা আলোচিত হইছিলেন। শাফিলিয়ার দোষ ছিলো তিনি ব্রিটিশ আর দশজন মেয়ের মত জিন্স এবং টি-শার্ট পরতেন এবং ছেলে বন্ধুদের সাথে মিশতেন। পরিবারের জন্য লজ্জা নিয়া আসা, অসম্মান নিয়া আসা, পরিবারের মাথা হেঁট করা, পরিবারের মুখে চুনকালি লাগানো জিন্স পরা এই মেয়েটারে তাই নিজের বাপ মা তাদের অন্য সন্তানদের সামনে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি দেন প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়া শ্বাসবন্ধ কইরা এবং মাইরা ফেলানো সেই লাশ টুকরা টুকরা কইরা। তাদের হুমকি দেন, ‘ইসলামী নিয়মমাফিক না চললে তাদেরও একই পরিণতি হবে।’
ভাগ্য ভালো, বাংলাদেশ পাকিস্তান না। বাংলাদেশে অন্ততঃ মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সমাজে এমন ধর্মীয় ও সামাজিক স্টিগমার কারণে খুনখারাপি হয় না। তবে বাংলাদেশ ‘ইদানিং’ ‘ওয়াহাবি’ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় যেইদিকে হাঁটতেছে, তাতে আমার খুব একটা স্বস্তিও হয় না। আমার নিজের এক উচ্চবিত্ত শিক্ষিত বাংলাদেশি মুসলিম বান্ধবীরে তার বাপ মা ত্যাজ্য করছেন শুধুমাত্র তিনি প্রেম কইরা বিয়া করছেন বইলা।
মজার বিষয় হইলো, যেই ছেলেরে তিনি ‘প্রেম’ কইরা বিয়া করছেন, সেই একই ছেলের সাথে তার অজান্তেই পারিবারিকভাবে বিয়ার কথা হইতেছিলো বেশ কিছুদিন ধইরা। কিন্তু মেয়ের বাপ যখন জানতে পারলেন, তার পছন্দ করা হবু জামাইয়ের সাথে তার মেয়ের ‘কয়েক বছরের’ প্রেমের কথা, তখনই তিনি বিগড়ায়ে বসলেন! যেন প্রেম করা খুন ও ধর্ষণ করার মত সমান অপরাধ!
উপমহাদেশের পুরুষতান্ত্রিক ও নারীবিদ্বেষী সমাজে মেয়েদের ‘সম্মান’ ‘কীসে’ হয় তা আমি অনেক বছর ধইরা এইসব ‘অনার কিলিং’ নিয়া পড়ালেখা কইরাও বাইর করতে পারি নাই। পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থায় মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে মেয়েদের পড়ালেখায় উপমহাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের আর আপত্তি নাই, মেয়েদের চাকরিতেও নাই, অন্ততঃ যতক্ষণ তারা পুরুষের ছত্রছায়াতলে থাইকা এইসব করতেছেন।
তাদের অসম্মান হয়, সম্ভবতঃ মেয়েরা নিজের মত কইরা কথা বলা শুরু করলেই। অর্থাৎ, মেয়েরা ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সামাজিক এবং ধর্মীয় নিয়মরে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করলেই এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করলেই তাদের এবং তাদের পরিবারের সম্মানহানী হইতে থাকে। এই চ্যালেঞ্জ একটা মেয়ের মাথায় ঘোমটা বা হিজাব না দেওয়া থিকা শুরু কইরা ছেলেদের সাথে মিশা বা প্রেম করা বা রাত কইরা বাড়ি ফিরা, নিজ ইচ্ছায় ডিভোর্স দেওয়ার মত যেকোনো ছোট বিষয়ে হইয়া থাকতে পারে। একটা মেয়ে তার শারীরবৃত্তিয় সীমানাতে থাইকা তার সমবয়সী ছেলেবন্ধু বা ভাই বা অন্যান্য ছেলেরা যেই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা পায়ে থাকেন, তা আদায় করতে চাইলেই পুরুষতান্ত্রিক বাপ-মা-ভাইবোন আত্মীয়স্বজন পাড়া-পড়শী হায় হায় কইরা উঠেন।

এইখানে খেয়াল করা জরুরি, শাফিলিয়ারে হত্যায় তার নিজের মা’ও ছিলেন। নারী মাত্রই নারীবাদী- তা তো না। পুরুষের দাস হিসাবে নারীবিদ্বেষী এবং পুরুষতান্ত্রিক নারীর সংখ্যা কম না। তাই বাড়ির মেয়েরা মাথার কাপড় ফালায়ে দিয়া দাসপ্রথা থিকা বাইর হইতে চাইলে প্রথম বিরোধিতা আসে মায়ের কাছ থিকাই। পরিবারের পছন্দমত বিয়াতে বিরোধিতা করলে বাড়ির পুরুষতান্ত্রিক মা-খালারাই আগায়ে আসেন মেয়েরে বুঝাইতে। মেয়ের বুকের উপর ওড়না না থাকলে তার মেয়ে বন্ধুরাই সবার আগে তারে বেশ্যা ডাকেন। বিয়ে-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের দায় ছেলেটারে অর্ধেক না দিয়া মেয়েটার দিকেই সম্পূর্ণ আঙ্গুল তোলেন সমাজের বাকি মেয়েরা।
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক পুরুষদের আমি যতটা ভয় পাই এবং ঘৃণা করি, তার চাইতে বেশি ভয় পাই ও ঘৃণা করি এইসব পুরুষতান্ত্রিক মেয়েদের। এরা নিজেরা হিজাব দিয়া মাথা এবং বুদ্ধিবৃত্তিরে ঢাইকা নিজেদের পুরুষের পরীক্ষিত দাস হিসাবে প্রমাণিত কইরা স্বাধীন হইতে চাওয়া মেয়েদের পথে বাঁধা হইয়া দাঁড়ান। মেয়েদের আলাদা ভাবে সম্মান করতে হবে বা মেয়েদের ‘শরীরেই’ পরিবারের সম্মান নিহিত- এমন ধারণা আসছে ‘মেয়েদের’ নিজেদের সম্পত্তি ভাবার মত চিন্তা থিকা। উপমহাদেশের মত জায়গায় যেইখানে আইনের শাসন নাই, সেইখানেই পুরুষতান্ত্রিক দাস মেয়েরা মাথায় হিজাব লাগাইয়া নিজেদের সম্মানের দায়িত্ব পুরুষের হাতে দিয়া নিশ্চিন্ত হন। তারা মনে করেন, পুরুষ হইতেছে সম্মানের পাত্র, অবাধ্য নারী শুধু সেই সম্মান ধ্বংস করতে জন্ম নিছেন। তাই তারা পুরুষের কথায় উঠবস কইরা ‘জ্বি-হুজুর-জাঁহাপনা’ করতে করতে স্বাধীন হইতে চাওয়া বা স্বাধীনতা প্র্যাকটিস করা মেয়েদের উপর হা-রে-রে-রে কইরা ঝাঁপাইয়া পড়েন।
শরীরে কলংক কীসের? আমার শরীর আমি কতদূর ঢাকবো, কতদূর খুলবো, তা পুরুষ এবং পুরুষের ধর্ম ও সমাজ আমারে দেখাইয়া দেওয়ার কে? আমি যদি ভোগবাদী সমাজে আমার শরীর এবং বুদ্ধিরে পণ্য বানাই, আপনি চোখ রাঙ্গানোর কে? আমি ধর্ষিত হইলে আমি অপমানিত হব ক্যানো? খুন হইয়া যাওয়া মানুষ কি অপমানিত হন? ডাকাতির শিকার হওয়া একজন কি অপমানিত হন? ধর্ষণের কারণে কেউ অপমানিত হইলে সেইটা ধর্ষক হবেন। আমি না।
আমার শরীরে কারো সম্মান নাই, এমনকি আমারও না। আমার শরীরে আমার বাপের সম্মান না, আমার মায়ের সম্মান না, আমার পরিবারের সম্মানও না। আমার শরীর একজন ছেলের শরীরের মতই, শুধুমাত্রই একটা শরীর। আমার শরীর- আমার না ঢাকা চুল, আমার ক্লিভেজ বের করা জামা, আমার ভ্যাজাইনাতে একশ’ ছত্রিশ জনের পুরুষাঙ্গ- তা দিয়া আপনার মান অপমান নির্ভর করলে বুঝতে হবে আপনার মান অপমানের সংজ্ঞায় ঝামেলা আছে।
হে পুরুষ, হে পুরুষতন্ত্র, হে পুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী নারী ও পুরুষ, হে ডগম্যাটিক ধর্ম, হে মাথামোটা মৌলবাদি ধার্মিক—
আপনি চৌরাস্তার মোড়ে গিয়া আমারে পাথর মারেন, যান। আপনি আমারে ন্যাংটা কইরা গণধর্ষণ করবেন? করেন। দেখি, আপনার কত জোর! আপনার সম্মান এ্যামনেই আমি ফুঁ দিয়া উড়াবো, দেখি আপনে কী করতে পারেন!
সাহসী লেখা।
আচরণেও এমন সাহসিকতা চাই নারীদের কাছে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কোন বাক্যেই আপনার লেখার মূল্যায়ন করা যায়না। আপনার প্রতি ভালোবাসা রইল।
আর হ্যা, এরকম মানসিকতার প্রেমিকা/পার্টনার চাই আমি।
আচ্ছা, আমাদের সমাজে একধরণের নারী আছে যারা এসবরের বিপরীত করেই শান্তি পায়, তারা এমনটা কেন করে?
thanks for let me encounter such a reality