জেসমিন চৌধুরী: শেষ রোজার দিন এক বাংলাদেশী সংগঠনের ইফতারের দাওয়াতে গেছি। হঠাৎ দূর থেকে আমাকে দেখে এক পরিচিত ভদ্রলোক উত্তেজিত কণ্ঠে ‘ভাবী-ই-ই..’ বলে কাছে ছুটে আসলেন। সাথের ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি আমাদের প্রিয় ভাবী, অপু ভাইয়ের বৌ’।
আমি রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলাম না, ‘আমার আবার একটা নামও আছে, জানেন?’ ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, ‘আসলে আমরা তো মেয়েদেরকে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেই, এটাই আমাদের কালচার’। আমি কখনোই এই বিষয়টা সহজভাবে নিতে পারিনি, এবারও চুপ থাকতে পারলাম না,

‘কালচারটা কি বদলানো যায়?’
‘কেন, অপু ভাইয়ের মত মানুষের বৌ হিসেবে পরিচিত হতে তো আপনার লজ্জা হবার কথা নয়’।
‘অবশ্যই না, পারসোনালি আয়াম প্রাউড টু বি ইন্ট্রোডিউসড অ্যাজ হিজ ওয়াইফ, বাট নট ফ্রম এ কালাচারাল পয়েন্ট অব ভিউ’।
তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেখে আরও কিছু বলতে উৎসাহিত হলাম, ‘দিস কালচার নিডস টু চেইঞ্জ, কারণ সারাক্ষণ আরেকজনের নামে পরিচিত হওয়াটা আমার জন্য খুব একটা সম্মানজনক নয়। আমার নিজের একটা নাম আছে, সেটা মাঝে মাঝে লোকের মুখে শুনতে ভাল লাগে’।
ভদ্রলোক খুব সহজেই আমার বক্তব্য মেনে নিয়ে একটু হেসে বললেন, ‘খুব বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর ভাবী, স্বীকার না করে পারছি না’।
মনে পড়ে গেল পঁচিশ বছর আগের একটা ঘটনা। কয়েক মাস হলো ইউকে’তে এসেছি, লন্ডন শহরে থাকি। বাংলাদেশে তখন এক সর্বগ্রাসী বন্যা চলছে, মন আনচান করছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে, কিন্তু নিজেরই তখন দিন আনি দিন খাই অবস্থা, কী করবো বুঝতে পারছি না। তদুপরি কিছুদিন পরেই প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছি, শরীরের অবস্থাও বেশী ভাল নয়।
এমন সময় শুনলাম বাংলাদেশী এক সংগঠন বন্যার্তদের সাহায্য করার জন্য একটা ফান্ড রেইজিং ইভেন্ট করছে। নিজে কিছু করার এই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না, আমার সাড়ে সাত মাসের বিশাল পেট নিয়েও একটা একক কৌতুকাভিনয় করলাম। আমার অভিনয় গুণ অথবা ‘অস্বাভাবিক’ শারীরিক অবস্থা, যেটার কারণেই হোক, দর্শক হেসে কুটিপাটি হলো। স্টেজ থেকে নেমে আসতেই কমিউনিটির নামকরা এক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন,
‘তুমি খুব ভাল অভিনয় করো, কিন্তু তোমাকে তো আগে দেখিনি। তুমি কার বৌ?’
তখন বয়স কম, মাথা গরম। সাথে সাথে রেগে লাল হয়ে গেলাম,
‘আমাকে কি কারো বৌ হতেই হবে?’
পৃথিবী জুড়ে যখন প্রতিনিয়তই নারীর অধিকার আদায়ের জন্য বড় বড় যুদ্ধ হচ্ছে, তখন নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে আজও প্রায়ই এসব ছোটখাটো যুদ্ধও লড়তে হয়। একটা মেয়ে তার জীবনে যত উল্লেখযোগ্য কাজই করুক না কেন, বাইরের পৃথিবীতে যত পরিচিতিই লাভ করুক না কেন, তার চারপাশের পৃথিবী তাকে কোনো পুরুষের মেয়ে, বোন, বা বৌ হিসেবে দেখতেই স্বস্তিবোধ করে, যদি সেই পুরুষের যোগ্যতা তার জীবনের নারীটির থেকে কম হয়ে থাকে, তবুও।
যাই হোক, সেদিনের ইফতার সন্ধ্যায় আবারও এক ক্ষুদ্র যুদ্ধে বিজয়ের আনন্দের সাথে সাথে এই সুবুদ্ধিসম্পন্ন ভদ্রলোকের উপর মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। আলোচিত সুপরিচিত স্বামীটি পাশের টেবিলে ইফতার উপভোগ করছিলেন বিধায় এই ভদ্রলোকের সাথে কালচার বিষয়ক আলাপচারিতায় ইফতার সন্ধ্যা মন্দ কাটলো না।
তারপর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই একটা ঘটনা ঘটলো, যা থেকে নারীর নিজের নামে পরিচিত না হবার ব্যবহারিক বিড়ম্বনা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। ঈদের দিন সকালে খবর এলো, আমাদের পরচিতি এক নারী সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেংগে হসপিটালে আছেন।
বিদেশ বিভূঁইয়ে সবাই আপনজন, তার উপর এই ভদ্রমহিলা আমাদের বাসায় কয়েকবার বেড়াতে এসেছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার সাথে দেখা সাক্ষাত হয়, তার স্বামী আমার দেবরের সাথে চাকুরী করেন, সব মিলিয়ে মনে হলো তাকে দেখতে যাওয়া উচিৎ।
ঠিকানা মিলিয়ে সরকারী হাসপাতালের সঠিক বিভাগে, সঠিক ওয়ার্ডে ঢুকে ত্যাব্দা খেয়ে গেলাম। বিশাল ওয়ার্ডটি কয়েক ভাগে বিভক্ত, প্রতিটি ভাগের আলাদা আলাদা দরজা। ভদ্রমহিলা কোনটায় আছেন আমাদের জানা নেই, আর তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম, আমরা ওই নারীর নাম জানি না, তাকে ‘ভাবী’ বলেই ডেকে এসেছি সবসময়। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আধুনিক এবং প্রগতিশীল একজন নারী হিসেবে অন্য একজন পরিচিত নারীর নাম জানি না বলে আমি নিজের কাছে লজ্জিত হয়ে উঠলাম। কী বলে ওই নারীর পরিচয় দেবো নার্সকে, ‘হার নিক নেইম ইজ ভাবী’?
আমার স্বামী ততক্ষণে কর্তব্যরত নার্সকে রোগীর পরিচয় বুঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘শী ইজ এশিয়ান, গট এ ব্রোকেন আর্ম’।
বিস্ময়ে নার্সের চোখ উলটে আসার উপক্রম, ‘ইজ দ্যাট অল ইউ ক্যান সে এবাউট আ ফ্রেন্ড ইউ আর ভিজিটিং?’
আর হবেই বা না কেন? দুই গাধা বাঙালি একজন নারীকে হাসপাতালে দেখতে এসেছে, কিন্তু তার নাম জানে না! আমরা আসলেই জাতি হিসেবে খুব অদ্ভুত। দেবরের সহকর্মীর অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে দেখতে যেতে আমরাই পারি, আর তার নাম না জানার গাধামীও আমাদের দ্বারাই সম্ভব। মায়া মমতার অভাব নেই আমাদের মধ্যে, কিন্তু মানুষের মর্যাদার বিষয়টা আমরা ঠিক বুঝি না।
যাই হোক, শেষপর্যন্ত ভদ্রমহিলাকে খুঁজে পাওয়া গেল। আমাদেরকে দেখে কী যে খুশী হলেন, ঈদের দিনে বেড়ানো ফেলে তাকে দেখতে যাওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। এতো ব্যথার মধ্যেও সারাক্ষণই মিষ্টি করে হাসছিলেন তিনি, বারবার ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন। অনেক গল্পও হলো।
বললেন, উনার হাজবেন্ড খুব ভাল ইংরেজি পারেন, তবু ডাক্তাররা ঊনার জন্য বার বার ইন্টারপ্রিটার ডেকে আনছে কেন বুঝতে পারছেন না। আমি নিজে দোভাষীর কাজ করি তাই বুঝিয়ে বললাম, ‘স্বামীর কাছ থেকে কোনো কথা আপনি গোপন রাখতে চাইতে পারেন বলেই তাকে ইন্টারপ্রিটিং করতে দেয়ার নিয়ম নেই’।
শুনে অবাক হয়ে গেলেন তিনি, ‘কী বলেন ভাবী? এরা এইরকম করে ভাবতে পারে? এটা তো জীবনেও আমার মাথায় আসতো না’।
আমি হেসে বললাম, ‘এদের কাছে আপনি আর আমি মানুষ। বাপ-ভাই-স্বামী ছাড়াও আমাদের নিজেদের যে অস্তিত্ব আছে তাকে সম্মান করে এরা’। পৃথিবীর কোনো কোনো কালচারে যে আমরা শুধু ভাবীই না বরং মানুষও, এই আনন্দে মুখরিত হয়ে আমরা দুই নারী পরস্পরকে আর ‘ভাবী’ না ডাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ভাল লেগেছে………।।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক কখনও চাইবে না। নারীর অধিকার নারীকেই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আপনার লেখা পড়ে নারীরা ভাবুক। নিজের অধিকার নিজেই প্রতিষ্ঠা করুক।
আপনাকে ধন্যবাদ।
লেখাতো অবশ্যই ভালো, কিন্তু শৈল্পিক বিচারে এই লেখার শিরোনামের গভীরতার জন্য জেসমিন চৌধুরীর একটা এওয়ার্ড পাওয়া উচিত।
আপনার এই ঘোষণাকেই এওয়ার্ড হিসেবে ধরে নিচ্ছি। কেউ একজন এটা ভেবেছে সেটাই বিরাট ব্যাপার।
প্রাতিটি মানুষের চাওয়া যে তার নামটি আশে পাশর মানুষেরা সুন্দর করে ডাকবে আর সে শুনতে পাবে মধুর করে ।। আপনার লেখাটা অনেক সুন্দর হয়েছে ।। আমরা অন্যার ভুল গুলো সুন্দর করে দেখিয়ে দিতে পছন্দ করী কিন্তু নিজেও ভুলের উরদে না ।। তাই আপনাকে ধন্যবাদ ।।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
Cant thank u more for such a good writing…
অনেক ধন্যবাদ।
Ideas & expressions are great, Vabi
শেষ প্যারাতেই সুন্দরভাবে মূল কথাটি ফুটে উঠেছে। লেখককে ধন্যবাদ এরকম একটি আপাতদৃষ্টিতে-জানা-কিন্তু-সচেতনভাবে-উপেক্ষিত বিষয় নিয়ে সহজ ভাষায় আলোকপাত করার জন্য।
অনেক ধন্যবাদ।
আপনার জীবনচেতনা এবং আত্ম সচেতনতা, যা অতি স্বাভাবিক একজন শিক্ষিত নারীর পক্ষে, তার অনেকখানিই হয়তো প্রকাশ এবং প্রসার পেয়েছে আপনার দেশজ অবস্থান থেকে। আপনার যেখানে জন্মভূমি, সেই বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীই কি আংশিকভাবেও স্বকীয় স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারেন, এখনো ?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আরো অনেক দূর হাঁটতে হবে আমাদের।