মায়েরাও মানুষ, এটা আমরা ভুলে যাই

ফাহরিয়া ফেরদৌস: যুগ পাল্টে গেছে, মেয়েরা ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে লেখাপড়া করছে, জীবন ও সম্মান বুঝতে শিখছে আর তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আমিও পারি এটি প্রমাণের একটি সুপ্ত বাসনা মনে থেকেই যায়। আর থাকবে না-ই বা কেন!! এই প্রতিযোগিতাটি আমরাই তৈরি করে দিয়েছি।

Fahriya 2
ফাহরিয়া ফেরদৌস

যে সমস্ত মেয়েরা নিজেরা ইনকাম করেন না তাদের আমরা হরহামেশাই বলি “বাইরে তো যাও না, তাই দুনিয়াদারি বোঝো না!” “যাও একবার কামাই করে দেখ, অফিসে বসের মন যুগিয়ে চলা কত কঠিন, চেহারা দেখে তো আর পয়সা দেয় না!!” অথচ ভেবে দেখুন, প্রতিদিন একটি সংসারে একটি মেয়ের কতজনের মন যুগিয়ে চলতে হয়! কতজনের কথা ভাবতে হয়, কে কী খাবে সেটা থেকে শুরু করে শুধু স্বামী নন, অনেক ক্ষেত্রে সন্তানদের অফিসে যাবার জন্য প্রস্তুত পর্যন্ত করে দেন।

একজন ‘নারী বস’কে তো কেউ বলতে পারে না যে, আপনি বুঝবেন না। তাহলে কেন ঘরের বউকে বা মাকে আমরা নারী বলে বলি যে, আরে তোমরা মহিলারা এসব বুঝবা না!

বুঝিয়ে বললেই বুঝবে! তাকে বোঝানো আমাদের দায়িত্ব। আজ অব্দি আমরা কখনোই এই সংসার করা তথা রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, সন্তান বড় করাকে কোনদিনই মূল্যায়ন করিনি। কারণ আমাদের কাছে কোনকিছুর মূল্য হয় টাকার বিনিময়ে। তাই সেই মেয়েটি কোনদিনই মূল্যায়িত হয়নি যে কেবলমাত্র ঘরের কাজ করেন।

আমাদের দেশে এখনো ঘরের কাজের শেয়ারিং বিষয়টি আসেনি। দেখা যায় অফিসের কাজ করে এসে মেয়েটিকেই সব কাজ একাই করতে হচ্ছে। এই বাইরে কাজ করাটি যে মেয়েটির জন্য অনেক সুখকর হচ্ছে বিষয়টি তেমন নয়, বরং এটা বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে! কোনো ক্লাসে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার মা কি কিছু করেন? যদি মা গৃহিনী হন, তবে সর্বদাই বাচ্চাদের কাছ থেকে উত্তর আসে “না, আমার মা কিছু করেন না”। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় যে ঘরের কাজ আসলে কোনো কাজ নয়!!!     

8 March 3চলার পথে দেখেছি, অনেক সন্তানের অভিযোগ, পারিবারিক সচ্ছলতা থাকার পরও মা কাজ করেছেন, আমাদের তেমন সময় দেননি, আমরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছি! বাবার প্রতি এই অভিযোগটি থাকে না। কারণ আমাদের ধারণা যে, মায়েরা কেবল তখনই কাজ করবেন যখন অভাব হবে, কাজ করার প্রয়োজনীয়তার উদ্ভব হবে! মায়েরাও যে মানুষ, আলাদা সত্ত্বা ,তাদের নিজেদেরও যে স্বপ্ন আছে, এটা আমরা ভুলে যাই।

ভেবে দেখুন, আপনি আমি সবাই নিজ জীবনে, নিজ স্বপ্ন পূরণে এত ব্যস্ত যে  আমাদের সময় কোথায় নিজের মায়ের জন্য? দিনে কয়বার আমরা জিজ্ঞাসা করি, খোঁজ নেই মায়ের? সন্তান বড় হয়ে যাবার পর অধিকাংশ মা-ই যখন সন্তানকে কিছু বলে, তখন সন্তানের উত্তর হয়, ‘তুমি কিছু বুঝবা না”!

ফলে একপর্যায়ে ঊনারা একাকি হয়ে পড়েন। এই সমস্যাটি যে কেবল লেখাপড়া কম জানা মায়েরই হচ্ছে বিষয়টি তেমন নয়, বরং অনেক শিক্ষিত মাও এই ধরনের একটা সময় পার করছেন।

আবার একটা বয়স পার হয়ে গেলে পর এই মায়েদের নিজের জন্য কিছু করারও থাকে না। স্বামী ব্যস্ত নিজ কাজে, সন্তান ব্যস্ত নিজ কাজে, তখন এই ‘মা’টিই হয়ে যায় একা, সংসারে তার মতের মূল্য থাকে কম। যে যত কথাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হলো, যে মা এক সময় নিজের গহনা বিক্রি করে সন্তানকে দিয়েছে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য, সে সন্তান আজ ভালো পজিশান পেয়ে অর্থ উপার্জন করে বউ-বাচ্চা নিয়ে বিদেশে ঘুরছেন।

মা কোথায়? মায়ের জন্য তো টিকেট খরচ থাকে না!! মধ্যবিত্ত সমাজের এই মায়েদের অবস্থা এমন হয় যে, জ্বর হলে একটি ওষুধের জন্যও হাত পাততে হয় কারো কাছে। যে সন্তানকে একদিন নিজে হাতে টাকা দিয়েছেন চকলেট খাবার জন্য, সেই মায়ের হাত পাততে হয় সেই সন্তানের কাছে ওষুধের জন্য, আবার জবাব দিতে হয় প্রতি টাকার খরচের!

কাজেই প্রতিটি মায়েরই কিছু না কিছু করা উচিৎ নিজের জন্য, যেন বৃদ্ধ বয়সে অন্তত ওষুধের জন্য সন্তানের কাছে হাত পাততে না হয়। একটি নিজস্ব বন্ধু সার্কেল থাকা উচিৎ, যেন বৃদ্ধ বয়সে একাকিত্ব বোধ না করেন!  আর মা যতটুকু করেছেন সেটি আমাদের জন্যই, তাই তার বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করে নিজ দায়িত্ব পালন করা উচিত সবারই।   

আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট  

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.