রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা: কন্যা, জায়া, জননী এই নিয়ে একজন নারী। মেয়ে বা জায়া সত্ত্বা নিয়ে তবুও তো আমরা কথা বলতে চেষ্টা করি। কিন্তু একজন মাও যে মানুষ, সে যে অতিমানবী নয়, তারও যে চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, এইটা নিয়ে কি কখনও ভাবি?
টেবিলে বসে আমি যদি খাবার পরিবেশন করি, তবে প্রথমেই মেয়েকে দিয়ে শুরু করি। একদিন খেতে বসে হঠাৎ করেই মেয়ে আমাকে বললো, আমি কিন্তু মা তোমার মতো এইরকম ব্যাকডেটেড ‘মা’ হবো না।
আমি তো অবাক। জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা কী রকম?
বললো, তুমিও কিন্তু একজনের মেয়ে এটা ভুলে গেছো। এখানে না হয় তুমি আমার মা। কিন্ত সবার আগে তো তুমি কারোর মেয়ে। আসলে মা’দেরকে অতি মানবী সাজিয়ে যেসব রূপকথার গল্প সাজানো হয়, তা মূলত: মা’দেরকে ঠকানোর জন্যই করা হয়ে থাকে। এবং এই গল্পগুলো বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ছেলেরাই সাজিয়ে থাকে মোটিভেটেড করে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করে নেয়ার জন্য। আর তোমরা মায়েরা অতিমানবী হয়ে মোটিভেটেড হয়ে নিজের আপন সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে দিনের পর দিন ঠকতেই থাকো।
১২/১৩ বছরের বুদ্ধিতে ওর মতো ও বলে গেলো। কিন্তু আমার মাথাতে ভাবনাটা রয়ে গেলো। আসলেই তো, মায়েরা না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ায়, শত কষ্ট হলেও সন্তানকে তা বুঝতে দিতে চাই না, যতো অসুস্থই থাকুক না কেন, শুয়ে না থেকে সংসারের কাজ মায়েরা নিজেই করে। আর এ থেকে যেসব সুবিধা আসে তার অধিকাংশই তো ছেলেরা ভোগ করে। বাইরে থেকে রাজ্য জয় করে এসে পরা কাপড়, জামা, জুতা মা গোছাবে বলে এলোমেলো করে ফেলে রাখা, মা এর ভরসায় পড়ার টেবিলটা পর্যন্ত এলোমেলো করে রাখা, টেবিলে খেতে বসে মা ভাত দাও, মা পানি দাও, মা এতো ঝাল দিছো কেন, এইটা স্বাদ হয়নি কেন- এইসব তো ছেলেরাই করে।
একদিন এক বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেছি। ঊনারা মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবার। খেতে বসেছি বাড়ির মুরুব্বি মহিলার সাথে। পুকুরের বড় মাছ খেতে খেতে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়িতে বড় মাছ রান্না হলে মাথা দিয়ে কি মুড়িঘণ্ট করেন?
-বললেন, না।
–মাথা কে খায়?
–কখনও তোমার খালু, কখনও নাতিরা আছে তারা।
–আপনার খেতে মন চায় না?
–চাইবে না কেন? কিন্তু হয়ে ওঠে না। দাদা-নাতির কাড়াকাড়ির মাঝে যেদিন সুযোগ থাকে, সেদিন ছেলেতে খায়।
তার মানে তারও কপালে জুটছে না, বাড়ির বউ এর কপালেও জুটছে না। এখানেও বঞ্চিত করছে কিন্তু সেই ছেলেরাই।
আমার হাজব্যান্ড এর মতো মা অন্ত:প্রাণ ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। বিষয়টাকে আমি খুব ভালোভাবে নিই এইজন্য যে সে একজন নারীকে খুব ভালোবাসে। আমিও নারী। আমাকেও নিশ্চয় খুব ভালোবাসে। একবার শ্বাশুড়ি বাসায় আসছে শুনে হাজব্যান্ডকে বললাম, এবার মা এলে চলো আমরা কক্সবাজারে ঊনাকে বেড়াতে নিয়ে যাই। কোনদিন তো কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তিনি বললেন, মা কী যাবে নাকি? বাড়ি আর আমাদের বাসা বাদে আর কী কোথাও যায়?
উত্তরটা শুনে বেশ চমৎকৃত হলাম। বললাম, যাবে না কেন? আব্বা বা তোমরা কোনদিন কোথাও নিয়ে যাওনি। তাই যায়নি। এখন নিয়ে যেতে চাইলে নিশ্চয় যাবে।
বললেন, যা বোঝ না, তা নিয়ে কথা বলো না।
সেদিন মেয়ের বলা কথাগুলো মনে পড়লো। বেড়াতে গেলে সময় ও টাকা পয়সা ব্যয় হবে। নানান রকমের ঝামেলা পোহাতে হবে। ওর থেকে মা’কে অতিমানবী সাজিয়ে, তাকে বাড়িবন্দি করে রেখে, তার চাওয়া-পাওয়াগুলোকে গলা টিপে মেরে ফেলে একটুখানি ভালোবাসা দিলেই যদি পার পাওয়া যায়, তাহলে অযথা ঝামেলাই যাওয়ার দরকার কী? মা তুমি অতি মানবী হয়েই থাকো না। ভোগবিলাসী, অনুভুতিসম্পন্ন মানুষ হওয়ার কোন দরকার নেই।
যারা আমাদের ঠকিয়েই আনন্দ পায়, তাদের কাছে ফরিয়াদ না জানিয়ে আসো না নারী, আমরা যারা কন্যাদের কথা বলি, জায়াদের কথা বলি, তারা জননীদের কথাও বলি। একসাথে উচ্চস্বরে বলি, মা, তোমরাও মানবী। অতিমানবী নও। তোমাদেরও চাওয়া পাওয়া, ভোগবিলাসের সম্পূর্ণ অধিকার আছে।