কামরুন নাহার রুমা: গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের সন্ত্রাসি হামলায় হালাকারিদের ছবি ও পরিচয় প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই ব্লগার রাজিব হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় আসলো জঙ্গিবাদের সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি। সেই সাথে আলোচনায় এসেছে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটিও, যদিও তা এখনও প্রমাণ সাপেক্ষ।
না বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হিসেবে আমি এখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সাফাই গাইতে যেমন বসিনি, তেমনি বসিনি নিরন্তর এর ছিদ্রান্বেষণ করতে। আবার এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও আমি লিখতে বসিনি। সেটা নিয়ে কাজ করার জন্য মোটা বেতনের কর্মকর্তা আছেন; আছেন লেখার জন্য এবং টিভিতে টকশো করে মুখে ফেনা তুলে ফেলার মত বিশেষজ্ঞগণ।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে এতোদিন আমরা জঙ্গি তৈরির কারখানা হিসেবে একতরফাভাবে দোষারোপ করে এসেছি। কিন্তু হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের সন্ত্রাসি হামলায় হামলাকারি হিসেবে যখন উঠে আসে দেশের নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাম, তখন নড়চড়ে বসতে হয় বৈকি! প্রচলিত আছে মাদ্রাসাতে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দরিদ্র মানুষকে টাকা পয়সার প্রলোভন দেখিয়ে অনেক পথেই পরিচালিত করা যায় – আর এই কথা যদি সত্যি হয় তাহলে গুলশানের সন্ত্রাসী ঘটনার হামলাকারিরা কিসের প্রলোভনে, কিসের অভাবে অথবা কাদের প্ররোচনায় এমন ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিয়েছিল! এরা সবাই হাইলি সল্ভেন্ট ফ্যামিলির সন্তান! তাহলে গ্যাপটা কোথায়?
দেশের নানান প্রান্ত থেকে এই ঢাকা শহরে পড়তে আসা ছেলেমেয়েগুলো হরেক রকম। ওদের স্বপ্ন কী, জীবন নিয়ে ওরা কী ভাবে বা কী চায়, নিজের শিক্ষাঙ্গনকে ওরা কতটুকু ভালবাসে, পড়ালেখার সাথে ওদের প্রেম কতটা গভীর বা ওরা আদৌ পড়তে ভালবাসে কিনা, ওদের বন্ধুরা কেমন, ওদের পরিবার কেমন, যেখানে তারা থাকে সেখানকার পরিবেশ কেমন, তাদের আলাদা করে কিছু চাওয়া আছে কিনা কারো কাছ থেকে, ধর্ম নিয়ে ওরা কি ভাবে বা নিজ ধর্মের মানুষের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি তাদের সহমর্মিতা কতটুকু , নিজের দেশের সংস্কৃতি নিয়ে ওদের ভাবনা কি, শিক্ষাঙ্গনের কোন বিষয় তাদেরকে কষ্ট দেয় কিনা বা ভাবায় কিনা সে বিষয়ে আমার শিক্ষকরা কতটুকু ওয়াকিবহাল?
প্রশ্ন আসতে পারে এই কাজটা আদৌ সম্ভব কিনা বা শিক্ষকদের এত দায় কিসের? উত্তরে বলবো ‘এই কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব না’ আর দায়ের প্রশ্নে ‘দায় আছে বৈকি’ !
শিক্ষার্থীরা পরিবারের পরে তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ সময়টা কাটায় শিক্ষাঙ্গনে। দিনের অধিকাংশ সময়ও একজন শিক্ষার্থীর তার প্রিয় শিক্ষাঙ্গনেই কাটে। এই বয়সটা তাদের স্বপ্ন দেখার বয়স, ভুল করার বয়স, ভুল বোঝার বয়স, বিপথে যাবার বয়স এবং যুগপৎ সিদ্ধান্ত নেবারও বয়স।
আর তাদের জীবনের এই ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ় লগ্নে’ আলোর দিশারী হতে পারেন একজন শিক্ষক ।সেই সময়টুকু একজন শিক্ষককে বের করতে হবে কারন সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত পেশার মানুষ হিসেবে শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক। আর এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে শিক্ষার্থীরা নিজেরা। তাদের সহায়ক শক্তি হবে শিক্ষক এবং অভিভাবকগণ। এখানে ছাত্র–শিক্ষক-অভিভাভক এই তিনের সমন্বয়ে একটা বলয় তৈরি করতে হবে।
সব শিক্ষার্থীদের খোঁজ আলাদাভাবে নেয়া কঠিন কিন্তু বিশেষ কোন শিক্ষার্থীর আলাদাভাবে যত্ন নেয়াই যেতে পারে । একজন শিক্ষার্থী তার যে কোন সমস্যায় শিক্ষকের দরজায় কড়া নাড়তে পারবে – সেই সুযোগটুকু একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে দেবেন এটাই কাম্য।
শিক্ষককে দেখলে শিক্ষার্থী ১০০ হাত দূর দিয়ে যাবে সেই দিন শেষ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বের সম্পর্ক। শিক্ষার্থী তার সমস্যা নিয়ে শিক্ষকের কাছে আসবে শিক্ষক একজন বন্ধু হয়ে প্রয়োজনে অভিভাবকের সাথে কথা বলে সমস্যার সমাধান দেবেন। একই সাথে একজন শিক্ষার্থীকে তার পরিবারের কাছেও সমস্ত বিষয় নিয়ে ওপেন থাকতে হবে। লুকোচুরিতে কোন সমাধান নেই।
অনেক অভিভাবক আছেন সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে এবং মাসে কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। তার সন্তান ঠিকমত ক্লাস করে কিনা, কাদের সাথে মেশে, কোথায় যায়, কী করে তার খোঁজ একেবারেই রাখেন না (অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)।
কিন্তু ওনাদের বুঝতে হবে শুধু টাকা দিয়ে যদি সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা যেতো, তাহলে সামিহ, রোহান বা নিব্রাসরা নতুন করে জন্ম নিতো না। তাদের কে সময় দিতে হবে, তাদের বন্ধু হতে হবে, তাদের অভাব অভিযোগ শুনতে হবে, তাদের বন্ধু-বান্ধবদেরও বন্ধু হতে হবে। ঘরে তাদের জন্য এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যে সেটার মায়া ছেড়ে সে বেশিক্ষণ অন্য কোথাও থাকতে পারবে না। উপার্জনের নেশায় অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের অবহেলা করলে চলবে না।
নিয়মিত তার সন্তানের সব ধরনের খোঁজ রাখা অভিভাবকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। তার ধারাবাহিকতায় সন্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিরতিতে যাওয়া, কখনও যেতে না পারলে নিদেনপক্ষে একটা ফোন দিয়ে বিভাগীয় প্রধানের সাথে কথা বলা, লেখাপড়ার খোঁজ নেয়া একজন অভিভাবককে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
আর এই সময়ের ছাত্রছাত্রীরা অনেক স্মার্ট, অনেক বুদ্ধিমান, অনেক উজ্জ্বল। ওদের বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনা অনেক বেশি। ওরা ভালমন্দের পার্থক্য করতে জানে আমার অবজারভেশন। আর সেই বিশ্বাস ও অবজারভেশন থেকেই আমার আশা আমাদের আশা তারা সঠিক বন্ধু নির্বাচন করবে, কে তাকে ভাল কাজের আর কে মন্দ কাজের জন্য ইন্ধন জোগাচ্ছে সে তা বুঝে নেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন যদি ধর্মের ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও নিয়ে আসে তাহলে দেখবে মোটা দাগে সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষ হত্যা করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ইসলাম কখনও সায় দেয় না। তাই মানুষকে ভালবাসার বদলে তাদেরকে হত্যার বাণী যারা প্রচার করবে বন্ধু হিসেবে সেইসব বন্ধু আর পরিজনকে পরিহার করতে হবে। নিজের ধর্ম পালনের পাশাপাশি অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে ।
একটা ক্লাসের ২০ জন ছাত্রের ভাবনা ২০ দিকে ছুটবে এটাই স্বাভাবিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে অন্য ধর্মের একজনের সাথে বাজে ব্যবহার করা, অন্য আর একজনের পোশাক চলাফেরা নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলাটা আর যাই হোক বন্ধুত্বের, মানবিকতার পরিচয় না।
ক্লাস নেয়া ছাড়া আমার বাদবাকী যে সময় তার অধিকাংশটুকুই কাটে শিক্ষার্থীদের সাথে চা সিঙ্গারা খেয়ে, আড্ডা দিয়ে। লেখাপড়া থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সব বিষয় নিয়েই তারা আমার সাথে কথা বলে, দিকনির্দেশনা চায়, আমি সাধ্যমত দেই। আমার ভাল লাগে এই ভেবে ওদের দুচোখ ভরা কি ভীষণ সুন্দর স্বপ্ন, কী দারুণ তাদের ভাবনাগুলো, কী ভীষণ গভীরতায় জীবনকে ওরা ভালবাসতে শিখেছে! এই ছেলেমেয়েগুলো কখনওই মানব হত্যার মত ঘৃণ্য কাজে জড়িত হতে পারে না এটা আমার বিশ্বাস ছিল, আছে এবং থাকবে!
কারণ আমি জানি গুটিকয়েক বিপথে যাওয়া মানুষের পথ কখনওই বাকিরা অনুসরণ করবে না। পরিশেষে একটা কথা প্রিয় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে – মানবতার প্রশ্নে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আজ কাঠগড়ায়, তাকে কলঙ্কমুক্ত করা তোমাদেরই দায়িত্ব – আমরা পাশেই আছি।