জেসমিন চৌধুরী:
এই সময়ের সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন, কেন ছেলেপুলে নাশকতার পথে পা বাড়াচ্ছে? আমাকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কেন পনেরো বছর বয়সে আমার পারিবারিক শিক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে লুকিয়ে জামায়াতে ইসলামীর অংগ সংগঠন ছাত্রী সংস্থায় যোগ দিয়েছিলাম, আমি আপনাকে ঠিক ঠিক বলে দেব।
আমার প্রাইভেট শিক্ষকের উৎসাহে আমি এই সংগঠনে যোগ দেই। কিন্তু কেন তিনি সক্ষম হয়েছিলেন সেই অল্প বয়সে মা-বাবার কাছে লুকিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে?
তিনিই ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি আমাকে বলেছিলেন আমি বুদ্ধিমতি। আমার লেখা কবিতাগুলো তিনি মন দিয়ে পড়তেন, বানান ঠিক করে দিতেন এবং কিভাবে আরো ভালো লিখতে পারবো, সে বিষয়ে উপদেশ দিতেন। তিনিই আমার প্রথম কবিতা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তার কাছাকাছি নিজেকে খুব সক্ষম আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো, কারণ তিনি সমালোচনা থেকে প্রশংসাই বেশি করতেন। তাই তিনি যখন আমাকে জামাতের একটি সম্মেলনে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে কাউকে না বলতে বললেন, আমার কাছে মোটেই খারাপ লাগেনি। তিনি ছিলেন আমার হিরো, তার কথামতো আগুনে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত ছিলাম আমি।
যা’ই হোক, আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো অল্প বয়সে কৌতুহলের পাশাপাশি থাকে মনোযোগ আর অনুমোদনের আকাঙ্ক্ষা এবং এই দু’টোই যদি পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে পূর্ণ হতে পারে তাহলে হয়তো নাশকতার পথে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। সেইসাথে প্রয়োজন বেড়ে উঠার সময়টিতে একজন ভাল রোল মডেল।
মৌলবাদ আর নাশকতার দীক্ষা নিয়ে অন্যান্য অনেক দেশের মত ইউকে তে অনেক দিন ধরেই রিসার্চ হচ্ছে, এর কারণ এবং প্রতিকারের দিক নির্দেশনা খোঁজা হচ্ছে। যখন দলে দলে ছেলেমেয়েরা এবং অনেকে পরিবারসুদ্ধ জেহাদ করতে সিরিয়ায় যেতে শুরু করলো, তখন হৈচৈ পড়ে গেলো চারদিকে। রাতারাতি স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা হলো, পলিসি বানানো হলো। টক শো গুলোতে এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা বিতর্ক চলতে থাকলো।
আর এইসব আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মৌলবাদে দীক্ষার উত্থানের কারণ নির্ধারণ এবং সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা। কারণগুলো কী শুধুই ধর্মীয়, না সামাজিক ও?
র্যাডিকালাইজেশন হচ্ছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটা মানুষ মানসিকভাবে এক অবস্থান থেকে ধাপে ধাপে অন্য অবস্থানে উন্নীত হয়। এটা রাতারাতি ঘটে না। এই প্রক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ আছে- প্রথমত একটি বিশেষ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস ধারণ, তারপর সেই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়ার চিন্তা এবং ইচ্ছা, আর সবশেষে সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন।
অনেক লম্বা এই প্রক্রিয়াটি চলাকালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা টেরও পান না ছেলেটির বা মেয়েটির মনের জগতে বা জীবনে ঠিক কি ঘটে যাচ্ছে।
অল্পবয়সী ছেলেপুলেদের সাথে কাজ করেন এরকম অবস্থানের সকলকে এদেশে ‘প্রিভেন্ট রেডিকালাইজেশন’ নামে একটা কোর্স করতে হয়। তরুণদের পড়াই বিধায় আমাকেও এই কোর্সটি করতে হয়েছে।
আমি আশা করি বাংলাদেশেও এরকম কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে। আজ দেখলাম সরকারের পক্ষ থেকে একটি সচেতনতামূলক ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে, দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে একটি কিশোর বা তরুণের আচার আচরণ এবং চলাফেরার মধ্যে নাশকতার পথে পা বাড়ানোর চিহ্নগুলো তারা সময় থাকতে ধরতে পারেন।
একটি শিশু, কিশোর, বা তরুণ নাশকতার পথে যাচ্ছে কি’না তা বুঝবার জন্য কোন সহজ পথ নেই, তবে বিভিন্ন রিসার্চ এবং কেইস স্টাডি থেকে যা দেখা গেছে তার ভিত্তিতেই এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এই কোর্সে বাস্তব জীবন থেকে নেয়া কিছু উদাহরণ ছিল যা আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল কেন অল্পবয়েসী ছেলেপুলেরা এই ধ্বংসের পথে যেতে পারে। বয়োসন্ধির সময়ের একাকিত্ব, জীবনের প্রকৃত অর্থ সন্ধানের প্রচেষ্টা, কোন একটা বিশেষ দলের ক্ষপ্পরে পড়ে যাওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিবাদের শিকার হওয়া, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচারের সমাধান করতে চাওয়া বা নেহায়েৎই গুরুত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে নাশকতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে তারা।
আমাদেরকে বলা হয়েছিল একটি তরুণ বা তরুণী ধর্মের দিকে ঝুঁকলেই বা হিজাব পরলেই তারা নাশকতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে বলে মনে করাটা ভুল। বরং যখন তারা হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যাবে, একা বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় কাটাবে, কোন বিশেষ ধর্ম বা দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে তীব্র মনোভাব প্রকাশ করবে, তখন তাদের কাজকর্ম তলিয়ে দেখার দরকার।
ইদানিং নাশকতামূলক কাজে গ্রেপ্তার হওয়া এক ছেলের মা বাবা এবং শিক্ষক শিক্ষিকারা বলছিলেন সে কত শান্ত ছিল, মাথা নিচু করে চলাফেরা করতো, নামাজ পড়তো। বুঝবার উপায় ছিল না যে সে এমন একটা কাজে জড়িত হতে পারে।
আরে, এই ছেলের আচার আচরণে রেডিকালিজেশনের চিহ্নতো একবারেই স্পষ্ট! কেন এই বয়সের একটা ছেলে চোখ তুলে তাকাবে না? নিশ্চয়ই সে কিছু গোপন করছিল। হয়তোবা মা-বাবার কাছে সে তীব্র ধর্মীয় অনুভূতি প্রকাশ করেনি, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে কী মনোভাব প্রকাশ করছিল, তার খবর হয়তো মা-বাবা জানতেনই না।
অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে গুলশানের ঘটনার জঙ্গিরা মাদ্রাসার ছাত্র নয়, বরং নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্ট। এবিষয়ে একটি গবেষণামূলক রচনায় পড়লাম, নাশকতাবাদিতায় নিয়োগ মসজিদে যত না হয়, তার চেয়ে বেশি হয় বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।
এই বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিতে ছেলেমেয়েরা যত না এগিয়ে আছে, মা বাবা ততই পিছিয়ে আছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে কত কি যে ঘটে যেতে পারে, অনেক মা-বাবা তা জানেন ও না। তারা যদি না’ই জানেন ছেলেমেয়ে কার সাথে মেলামেশা করছে, তাহলে এই নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা বেখবর থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক।
গতকাল আমি নাশকতাবাদিতায় নিয়োগে কোরানের আয়াত ব্যবহার সম্পর্কে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছি। আপনারা যারা কোরান পড়েছেন তারা সকলেই এই আয়াতগুলি সম্পর্কে অবহিত আছেন, কোটেশন দিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাই না। আমি যখনই এই আয়াতগুলির প্রসংগ তুলি, তখনই কেউ না কেউ বলেন, ‘আমি নিজে ঠিক পড়ে দেখিনি, তবে আমি নিশ্চিত আয়াতগুলোকে ভুল অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে’।
যদি তা’ই হয়ে থাকে আমি বলবো, কেন পড়ছেন না? মন দিয়ে পড়ুন এবং বুঝুন, বাসায় আরো বেশি করে ধর্ম আলোচনা করুন, এবং বাচ্চাদেরকে এই আয়াতগুলোর সঠিক অর্থ শেখান, যে অর্থ তাদেরকে শান্তির পথ দেখাবে বলে আপনি মনে করেন, যাতে পরবর্তিতে এই আয়াতগুলো ব্যবহার করে জঙ্গিরা তাদের দলে ভেড়াতে না পারে। বেতনভূক মিয়াসাবের হাতে ধর্মীয় শিক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে বসে থাকার ফল খুব একটা ভাল হওয়ার কথা নয়।
বিষয়টা পরস্পরকে আক্রমণের বা তর্ক জয়ের নয়, বরং জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করার। এবং এক্ষেত্রে আমাদের সকলকে, বিশ্বাসী অথবা অবিশ্বাসী হিন্দু অথবা মুসলিম, এক হয়ে কাজ করতে হবে।
হয়তো অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু আমাকে মৌলবাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল আমার কবিতা পড়ার অভ্যাস। দিনের বেলা ছাত্রীসংস্থার সভায় বক্তৃতা শুনে সন্ধ্যায় যখন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ বা ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক’ জাতীয় কবিতা পড়তাম, তখন হিসাব মেলাতে পারতাম না। শেষ পর্যন্ত হিসাবের খাতায় মানবতার পাল্লাই ভারি হলো আর আমি বেঁচে গেলাম। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সাথে ছোটবেলা থেকেই ঘনিষ্ট পরিচিতি ঘটলে মনের দরজা জানালা খুলে যাবে, নাশকতাবাদী হওয়া কঠিন হবে।
আমার এক সহকর্মী সেদিন বলছিল, তুমি কেন সব লেখায় শিশু বিকাশের বিষয়টা টেনে আনো?
আমি মনে করি শিশুর যথাযথ বিকাশের মধ্যে বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান নিহিত আছে। একদম ছোট থেকে বাচ্চাদের সাথে অনেক বেশি সময় কাটাতে হবে, গল্প করতে হবে, তাদেরকে হাত ধরে ফুল পাতা প্রজাপতি চেনাতে হবে। তাদের সাথে সাথে বিস্ময়কর এই পৃথিবী দেখে নতুন করে বিস্মিত হতে হবে, চারপাশের পরিবর্তনশীল পৃথিবীকে তাদের সাথে নতুন করে চিনতে এবং বুঝতে শিখতে হবে। তাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। সমালোচনা থেকে প্রশংসা বেশি করতে হবে, শাস্তি থেকে পুরষ্কার বেশি দিতে হবে। শুধু ভাত কাপড় আর দুই গালে চুমার আদর নয়, তাদের ব্যক্তিসত্তার কদর করতে হবে।
আমি নাশকতাবাদিতায় পাশ করা ডাক্তার নই, তাই হয়তো প্রেসক্রিপশন লেখা আমার সাজে না, তবু যাপিত জীবনের উপর ভিত্তি করে বলবো, মা বাবা যে ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু সেই ছেলে মেয়ে কখনোই নাশকতার পথে যেতে পারে না।
Amar kintu khub valo legache apnar article. Wait for another one. Thanks.
সম্পূর্ণ পড়লাম ভালো লাগলো,তবে আমার মনে হয় আর একটু যোগ করা যেত। যেমন একটি শিশু মা বাবার মুখ থেকে এবং আচার ব্যবহারে জানে পারে সে কোন ধর্মের অনুগত।যদি সেই দিন থেকে আধুনিকতার সাথে সাথে নিজ নিজ ধর্মের কর্যবীধি ও গুনাগুন সেখানো যায়।তাহলে মনে হয়না কোন বাচ্ছা বড় হলে তার ব্রেন আর কেও ওয়াস করতে পরবে। আজ পৃথিবীতে প্রত্যেকটা ধর্মে উগ্রপন্থীর জন্ম হয়েছে কেন,কারন তাদের বাবা মা নিজে কখনো সন্তানকে ধর্ম শিক্ষা দেয়নি।যদি দিত তবে অন্যের কাছ থেকে সু এর সাথে কুশিক্ষা টা নেওয়া লাগতো না। আজ যত গুলো সন্তান সন্ত্রাসী হয়েছে তার জন্য দায়ী বাবা মা, সমাজ,ও বর্তমান আধুনিকতার নামে আপসংঙ্ককৃতি।ভাই যে যাই ভাই বলুন শিক্ষার জনক হচ্ছে প্রথমে পরিবার এরপর সমাজ শেষ হচ্ছে বিদ্যালয়, তাই বারবার বিদ্যালয়কে দোষ না দিয়ে নিজেকে শুধরে নেয়, সেই সাথে সন্তানদের সময় দেয়, তবে দেখবেন সব বদলে গেছে শুধু তাদের অধিকার টুকু নিশ্চিত করুন আর কিছু লাগবে না।ধন্যবাদ
Khub bhalo laglo. Charity begins at home ebong humanity also begins at home. Apnar prescription amader shobar kale lagbe. Bhalo thakun
পড়ার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন 🙂
A wonderful article!
It’s amazing that we now find hundreds of young folks missing. Apparently some of the parents had reported this to the police without any consequences. Hopefully, this will be a wake-up call for the parents, the educators and the society in general.
আপনার সন্তানকে আপনার নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
Khub valo likhechen,thnk yu so much fr so kindly sharing
ধন্যবাদ পড়ার জন্য। ভাল থাকবেন। 🙂
I like it
ধন্যবাদ 🙂
khub valo likhachan, valo thaken.
আপনিও ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
বোন, আমিও।ঠিক এসব কথাগুলাই বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারছিলাম না। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার মনের কথাগুলা লেখার জন্য। আপনি আপনার পরিবারসহ দীর্ঘজীবী হউন এই প্রত্যাশা করি। ভালো থাকবেন…
আপনাকেও ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। আশা করি সাথে থাকবেন। 🙂
khub pasonghik lekha.juktisilota,progotir sapekkhe
সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সাথে আছি, সাথে থাকবেন। 🙂
অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। সাথে আছি, সাথে থাকবেন। 🙂