উপমা মাহবুব: নব্বইয়ের দশকে বিপ্লব-সংক্রান্ত লেখা উপন্যাস ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। এসব বই পড়ে আমরা সদ্য টিনএজ পেরুনো তরুণরা কল্পনা করতাম বিপ্লবী দলে যোগ দিয়ে গোপন মিশন চালাচ্ছি। রুশ সাহিত্যের কাল্পনিক নায়কেরা প্রতি মূহুর্তে সাম্যবাদী, ধনী-গরিবের বিভেদহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব করার ডাক দিত।

সে সময় ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি রাজাকারদের শাস্তি দাবি করে যে প্রবল আন্দোলন শুরু করেছিল তরুণরাই ছিল সেই আন্দোলনের প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়ে মনে হতো বুকে বোমা বেঁধে একদিন এক রাজাকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো। আত্মঘাতি হবো। স্বৈরাচারী সরকারের আমলে সরাসরি আন্দোলন করার বয়স অনেকেরই ছিল না। জনতার মঞ্চে কোরাস গাওয়ার জন্য বড়রা যখন অনুশীলন করতো, তখন আমরা গলা মেলাতাম ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন/ জ্বলে দ্বিগুণ যেন – দারুণ প্রতিবাদে/ আনে মুক্তি আরো আনে/ আনে শক্তি শতপ্রাণে’।
২০১৬ সালে সদ্য কৈশোর পেরোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া তরুণ একটি ছেলেও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে চায়। কিন্তু তার স্বপ্নের সেই সমাজে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জায়গা হবে না। সে বিপ্লব করতে চায়। কিন্তু সেই বিপ্লবে মানুষের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন থাকবে না, বরং সেটি সমাজে ভয় ছড়াবে, ত্রাস সৃষ্টি করবে। ছেলেটি বিদ্রোহী হতে চায়। তার বিদ্রোহ হবে রক্তাক্ত। আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজনে সে নিজের জীবন উৎসর্গ করবে। কিন্তু সেই উৎসর্গ তাকে নূর হোসেনের মর্যাদা দেবে না। তার জীবনদান পরিবারকে গর্বিত করবে না।
সেসব জেনেও সেই ছেলেটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে বলে বোমা মারার, ভারী অস্ত্র, চাপাতি ব্যবহারের ট্রেনিং নিল। তার আদর্শের পরিপন্থিদের শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে আদর্শিক বন্ধুদের সাথে পরিকল্পিতভাবে অন্য দেশের, অন্য ধর্মের, ভিন্ন মতাদর্শের অনেকগুলো মানুষকে গলা কেটে হত্যা করলো। নিজে নিহত হয়ে, অথবা আত্মহত্যা করে তার মিশন সমাপ্ত করলো।
এই আত্মত্যাগ তাকে কোন বেহেশতে নিয়ে গেল জানি না।
কিন্তু ১ জুলাই ২০১৬ তারিখ থেকে বাংলাদেশের হাজার বছরের সংগ্রামের গর্বিত ইতিহাস কলঙ্কিত হলো। ক্ষুদিরামের ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি/ হাসি হাসি পড়ব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’ গানের সুর শূণ্যে হারিয়ে গিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে নিরীহ মানুষ হত্যার ইতিহাস রচিত হলো।
মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা প্লাটুনের সদস্যরা যে গৌরবের অধ্যায়ের সূচনা করেছিল তাদের সমবয়সী তরুণরা নিরীহ মানুষ হত্যার জঙ্গি মিশন চালিয়ে তাতে কালিমা লেপে দিল। বিশ্বের দরবারে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা নিচু হলো। বিদেশী বন্ধুদের নিরাপত্তা দিতে আমরা ব্যর্থ হলাম।
তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের ভুল পথ বেছে নেয়ার এই দায় শুধু সরকারের, পরিবারের অথবা শিক্ষা ব্যবস্থার নয়। এই দায় আমার-আপনার-সবার। নতুন প্রজন্ম নিজের দেশের গৌরবময় ইতিহাস জানে না। কিভাবে জানবে, বড়রা যে এখনো স্বাধীনতার ঘোষণাকে দিয়েছিল সেই তথ্যটিই ঠিক মতো দিতে পারে না! রাজনৈতিক দলগুলো না হয় একমত হতে পারে না।
কিন্তু ব্যক্তি আপনি কি কোনদিন সন্তানের সাথে বাংলাদেশ কিভাবে স্বাধীন হলো সেই গল্প করেছেন? স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কবে তা শিক্ষিত কিশোর-কিশোরী বলতে পারে না। এই নিয়ে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে তুলোধুনো করে ছাড়ি। সরকার স্কুল-কলেজে এই দিবসগুলো পালন করাকে বাধ্যতামূলক করেছে। সেই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বড় অংশই যায় না। কেননা ছুটির দিনের সকালে বাবা-মায়েরা ঘুমাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন চাপা পড়ে যায় ভ্যালেন্টাইনস ডে উৎযাপনের ডামাডোলে।
এ নিয়ে টিভি চ্যানেলের উপর সবাই ক্ষোভ ঝাড়ি। ব্যবসায়ী না হয় শুধু নিজের ব্যবসা বোঝে, কিন্তু আমরা যারা নব্বইয়ের দশক দেখেছি, আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, সেই আমাদের কি পরবর্তী প্রজন্মকে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে কোনই দায়িত্ব নেই?
কাউকে বই উপহার দিতে আমরা লজ্জিত বোধ করি। পরিচিত কারো সন্তান ইংরেজি মিডিয়ামে না পড়লে তার ভবিষ্যত নিয়ে আমাদের চিন্তার শেষ থাকে না। আমাদের বাড়ির সামনে খেলার জায়গা থাকে না। পাড়ায় কিশোর-কিশোরী, তরুণদের মুক্তবুদ্ধি, সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ নেই। নিজেরা ধর্মীয় বইগুলো পড়ে সেগুলোর বাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা করি না। নিজ দায়িত্বে সন্তানদেরকে ধর্মীয় মূল্যবোধ শিখাই না।
আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়েরা তাই অল্পতেই হতাশাগ্রস্থ হয়। ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্টকে তারা বড় করে দেখে। ভাঙ্গন ধরা পরিবারে বড় হওয়া, প্রেমের সম্পর্কে ভেঙ্গে যাওয়া ছেলেটির জীবনে সৃজনশীলতার, খেলাধুলা বা সাহিত্যচর্চার মাঝে ডুবে থাকার কোন সুযোগ নেই। তাই তাদেরকে ধর্মের নামে মোটিভেট করা, জিহাদের কথা বলে রক্তে শিহরণ জাগানো অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে ফেলা সহজ হয়। তাদের হতাশাগ্রস্থ মন নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে মহান হতে চায়। শহীদ হয়ে দুঃখ-কষ্ট আর বঞ্চনায় ভরা জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি বেহেশতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আর বাকিরা যারা ধর্মের রাজনীতিতে জড়ায় না, তাদের বড় অংশ অপরাধপ্রবণ, নারী-শিশু নির্যাতনকারী হিসেবে বেড়ে উঠে।
আমাদের মেধাবী তরুণ সমাজ যদি তাদের মেধাকে খেলাধুলা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকশিত করার সুযোগ না পায়, তারা যদি নিজের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে না জানে, ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ না করে, তাহলে তা আমাদের জন্য বুমেরাং হয়ে আসবে যার ফলাফল আমরা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছি। এগুলো নিশ্চিত করতে ব্যক্তি উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সবকিছুর দায় সরকার আর রাজনীতিবিদদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে, দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আসুন নিজেরাও কিছু দায়িত্ব নেই। পরিবার বা এলাকার ছেলে-মেয়েদের সৃজনশীলতা চর্চার অথবা তাদেরকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করার আপনার সামান্য একটি উদ্যোগ আগামী দিনে হয়ত এক বা অনেক তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাবে। আমাদের জাতি হিসেবে শক্তিশালী করবে।
বিশ্বের দরবারে জঙ্গি নয়, অপরাধপ্রবণ বা নারী-শিশু নির্যাতনকারী নয় বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা সবদিক দিয়ে অগ্রসর জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাব।
উপমা মাহবুব, একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত
pls see