কিশোয়ার লায়লা: আমি হিন্দি চলচ্চিত্র বেশি দেখি। সেখানে দেখি একজন মানুষের জঙ্গি হয়ে ওঠার গল্প, কীভাবে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তারা, কীভাবে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয় তাও পরিস্কারভাবে দেখানো হয়। চলচ্চিত্রের শেষে অবাক করে দিয়ে উঠে আসে কঠিন সত্য- যেখানে দেখানো হয় সমাজের পরিচিত কিছু মুখই পরিকল্পনাকারী আর নির্দেশকারীর আসনে। আর তাদের নিধনে যুদ্ধ করেন একজন বীরযোদ্ধা- যাকে বলি ‘নায়ক’। পর্দা নেমে যায়। আরেকদিন বসি অন্য কোনো গল্প নিয়ে।

সবসময় জেনে এসেছি চলচ্চিত্র সমাজেরই দর্পণ। সমাজের খুঁটিনাটি বাস্তবতাকেই তুলে ধরা হয় ফ্রেমে। শুধু একটি সত্যই কোনভাবে বাস্তব থেকে নেয়া যায় না। খুঁজে পাওয়া যায় না প্রকৃত পরিকল্পনাকারী আর নির্দেশকারীদের। আর থাকে না কোন বীরযোদ্ধা- যে কিনা মূহুর্তেই দুষ্টুদের নির্মূল করে ফেলে। বাস্তবে নায়কের অভাব থেকেই যায়।
গত কয়েকদিন যা ঘটে গেলো আর এখন ফেইসবুক আর গণমাধ্যমে যা উঠে আসছে তা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভাল হতো। বিপথে যাওয়া বাচ্চাগুলোর চেহারা বিশ্বাস করতে পারছি না। এরা? আরে, এরা তো এখনো জীবনের কঠিন কোন বাস্তবতাতেই নামতে শেখেনি! লেখাপড়া শেষ করে ভাল চাকরি, একটু প্রেম করা, মাসের প্রথম উপার্জন দিয়ে বাবা-মা’কে কোন রেস্টেুরেন্টে খেতে নিয়ে যাওয়া, আদরের ছোট বোনটিকে একটা নতুন মোবাইল সেট বা একটা নতুন জামা কিনে দেয়া। কিছুই তো করার বয়স হয়নি এদের? আর এরা কীনা কোনো এক অন্ধ বিশ্বাসে জীবন উৎসর্গ করে দিল?
আমি বিশ্বাস করতে চাই না এমন আরো ‘বাচ্চা’ হয়তো অন্ধ বিশ্বাস মনে লালন করে ধীরে ধীরে হিংস্র হয়ে উঠছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই, এটাই শেষ। এই ভুল পথে আর একটি শিশুও পা বাড়াবে না।
বাচ্চাদের বলছি, তোমাদের কেউ মগজ ধোলাই করছে? তোমরা কেন তাদের কথা শুনছো? তোমরা পড়াশোনা করছো। তোমাদের বাবা-মা আর কাছের মানুষরা তো জন্মের পর থেকে তোমাদের ভাল ভাল কথা শিখিয়েছে। তাহলে তাদের কথা কেন মগজ থেকে ধুয়ে অন্য কারো-যাদের তোমরা কখনোই চেনো না তাদের কথা মনে গেঁথে নিচ্ছ? নিজেদের বিচার বিবেচনাতেও কী এতোটুকু বুঝতে পারছো না ওরা তোমাদের ব্যবহার করছে? নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ছুটে যাচ্ছ মৃত্যুকূপে?
জানলাম যে, হলি আর্টিজানে হামলাকারীর দু’একজন নাকি বেশ কিছুদিন ধরে নিখোঁজ ছিল। কেউ মার্চ থেকে, কেউ এপ্রিল থেকে। তার মানে বোঝা গেলো চূড়ান্ত মগজধোলাই শেষে বেশি সময় নেয়া হয় না। কাজে নামিয়ে দেয়া হয়। মগজে ঢুকিয়ে দেয়া নতুন মাল-মশলা যেনো মুছে না যায় তাই তাজা থাকতেই কাজ আদায় করে নেয়া হয়। এদের ক্ষেত্রেও মনে হলো তাই হয়েছে।
সবার মধ্যে একটি প্রশ্ন, অতি সচ্ছল, সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের সন্তান কী করে এই পথ বেছে নিল? বাবা-মা’কে সবাই দোষারোপ করছি। অভিভাবক কতটা দায়ী তা নিয়ে বিচারে না বসে আমাদের এখন নিজেদেরই নড়েচড়ে বসতে হবে।
সন্তানের ঘরের দরজাটা দিয়ে উঁকি মেরে দেখুন, বাচ্চাটা ঠিক আছে তো? চোখে পড়ার মতো কোন পরিবর্তন এসেছে? বা নতুন কোন বন্ধু? একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন পাশের বাসার ছেলেটা যে কিনা কিছুদিন ধরে নিখোঁজ- ও ফিরেছে বাসায়? আমাদের চারপাশের দিকে আমরা নিজেরাই একটু চোখ বুলাই?
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ আমরা করতে পারবো না। খুঁজে পাবো না মূল পরিকল্পনাকারী আর নির্দেশকারীদের। কিন্তু এতোটুকু আমরা করতে পারবো নিশ্চই। আমরাই ফিরিয়ে আনতে পারবো আমাদের সন্তানদের।
এভাবেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে পারবো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। সিনেমার একমাত্র ‘নায়ক’ নয়, আমরা সবাই হতে পারবো একজন আলাদা ‘নায়ক’।
সাংবাদিক, টরন্টো