বিথী হক: সংজ্ঞা পাল্টানোর সময় এসেছে, যুগ যুগ ধরে বন্ধ করে রাখা চোখ-কানের সদ্ব্যবহার করার সময় এসেছে। অন্ধের মত শুধুমাত্র ভাল, খারাপ দুটো শব্দে মানুষকে বিশ্লেষণ করার সময় এখন আর নেই।
“ভাল ছেলেরা নামায পড়ে, ভাল মেয়েরা মাথায় কাপড় দেয়, ভাল ছেলেরা সিগারেট খায় না, ভাল মেয়েরা সবার কথা মেনে চলে”; এই ভাল’র সংজ্ঞা নির্ধারক মানদণ্ডের প্রবক্তা কে বা কারা আমি জানি না, কত আগে তারা মানুষের মাথায় এসব সংজ্ঞা ঢুকিয়েছে তাও জানি না।
তবে এর প্রভাব যে সূদুরপ্রসারী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমি ভার্সিটিতে ওঠার পরেও সিগারেট খায় এমন ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইতাম না, স্কুল-কলেজে যেসব ছেলে-মেয়েরা নামায পড়তো না তাদেরকে আমার বখাটে মনে হতো। নামাজ, রোজা, হাদিস-কোরান পড়ার কারণে নিজেকে মনে হতো নিষ্পাপ, শতভাগ সঠিক আর বাদবাকি সবাইকে বখাটে, বাজে আর খারাপ।
তারপর যত বড় হয়েছি, বিভিন্ন রকম বই পড়েছি, মানুষের সঙ্গে মিশেছি তত ধারণা পাল্টেছে। নামায না পড়া মানুষরাও কত চমৎকার করে মানুষকে ভালবাসে। সিগারেট খাওয়া মানুষটা পথের না খেয়ে থাকা মানুষকে খাবার দোকানে এনে সামনে বসে খাওয়ায়। সবার কথা মেনে না চলা মানুষটা কত সংগ্রাম করে, কারো কথা না শুনে সবার অজান্তে পরিবারের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়। এসব যত দেখেছি তত নিজেকে ছোট মনে হয়েছে।
একটা সময় আবিষ্কার করলাম, ভাল বা খারাপ বলে যে দুটো শব্দ আছে তার নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞাই তো নেই। ইশ, এতদিন কী ভুলে ভরা পৃথিবীতে যে বেঁচেছিলাম।
তারপর ধর্মে যখন অবিশ্বাস এসে পড়লো, তখন মনে হতো, সকল ধর্ম বিশ্বাসীরা আঁতেল। পড়াশোনা না করে, কিছু না জেনে জন্মসূত্রে পাওয়া একটা বিশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। সুযোগ পেলে তার ধর্মের কল নাড়াতে থাকে। সুতরাং ধার্মিকদের থেকে দূরে দূরে থাকা শুরু করলাম। গোঁড়া ধার্মিক আর ধর্মান্ধ ভীতিতে তাদের ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে চাইতাম না।
অন্যদিকে কয়েকজন অতিমাত্রায় ধার্মিক মানুষজনের সংস্পর্শে গিয়ে আমার নিজের কাছে নিজের মাথা হেঁট হয়ে গেল। কত সুন্দর করে তারা বলে, “ধর্ম একটা অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ধর্ম বিশ্বাস করে যারা শান্তি পায়, ধর্ম শুধু তাদের জন্য; সবার মানার জন্য নিশ্চয়ই নয়! আমাদের ধর্মেই তো আছে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার উপদেশ”।
আমি অবাক হয়ে তাদের কথা শুনি, একটা মানুষ এতো কিছু জানে কী করে! এতো উদার, এতো স্বাধীনভাবে ভাবতে দেখে আমার কাছে ধর্ম আর ধার্মিক দুটোর সংজ্ঞাই পাল্টে গেল।
তাহলে আমি এতদিন ভাল-খারাপ, ধর্ম-অধর্ম সম্পর্কে যা জানতাম তার সব ভুল? এতো ভুল আমাকে কে করিয়েছে, কে শিখিয়েছে, কে ভাবিয়েছে? ধর্ম দিয়েই কি ভাল খারাপ বিচার করা যায়? ভাল-খারাপ দিয়েই কি ধর্মকে বর্ণনা করা যায়?
অনেক ধার্মিককে দেখেছি যারা নিয়মিত নামায পড়েন, পূজা-আর্চা করেন, কিন্তু মিথ্যে না বললে পেটের ভাত হজম হয় না, মানুষকে না ঠকালে নিজে শান্তি পায় না। আবার প্রচুর ধার্মিক দেখেছি যারা নাস্তিকদের সঙ্গে নিজে বোরকা-হিজাব পড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, ত্রিশ-চল্লিশ বছরের বন্ধুত্বে ধর্ম আর অধর্মের বেড়া সেখানে কোনকালেই মুখ্য ছিল না, নিজেদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কেউ কাউকে জোর করে না, মারামারি করে না।
আর এখন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে সাম্প্রদায়িকতা। কেউ কাউকে শ্রদ্ধা করে না, ভালবাসে না। একজন আরেকজনের ধর্মকে নিয়ে বেফাঁস কথা বলতে থাকে। সবাই নিজেকে অন্যের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, নিজের ধর্মকে সঠিক আর বাকিদের ধর্মকে বেঠিক ভেবে ব্যঙ্গ করে। প্রত্যেকটা ধার্মিকের মুখচর্চার নমুনা দেখে মনে মনে বলি, ধরণী দ্বিধা হও! যে ধর্মের জন্য মুখ খারাপ করে বাপ-মা তুলে গালিগালাজ করছে, সে ধর্ম কি গালাগালি শেখায়, নাকি করায়?
বরাবরের মত এখনো বলি, অমোঘ বলে কিছু নেই। অন্যের ক্ষতি না করা প্রত্যেকটা মানুষই ভাল। সে কয়টা প্রেম করে, বিড়ি-সিগারেট খায় কি না, বোরখা পরে কি না, মুখে মুখে তর্ক করে কিনা সেসব দিয়ে তামাম দুনিয়ার কী আসে যায়? সে ধর্ম মানে কি না, শুয়োরের মাংস খায় কি না তা দিয়ে কার কি আসে যায়?
এসব তো অনেক হলো। এবার অন্য কিছু শিখি, ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের অন্য কিছু শেখানো হোক। শুধু মুসলমানরা নয়, হিন্দুরা নয়, খ্রিস্টানরা নয়, বরং সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। একসঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে সবাইকে একই মতের হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়। নিজেরটা ঠিক রেখে, প্রত্যেককে প্রত্যেকের মত গ্রহণ করেও বাঁচা যায়, ভালবাসা যায়। যে যেমন তাকে তার মত থাকতে দিয়ে আসুন না সবাই সবাইকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি।
পৃথিবীতে সব মানুষ এক মতের, এক ধর্মের, এক রঙের হয়ে গেলে তো একজন আরেকজনের ছায়া হয়ে যাবে। আলাদা সত্ত্বা থাকবে না। তার চেয়ে বরং ভালো-খারাপের সংজ্ঞাটাই নাহয় পাল্টে ফেলি, আমরা মানুষ হই।