নিজে জয়ী হবে,নাকি লোক-লজ্জাকে জয়ী করবে?

ফারজানা নীলা: লজ্জা, লোকনিন্দা, ভয়, সাহসের অভাব নারীদের প্রধান শত্রু। লজ্জায় লাল হয়ে কে কী বলল এসব চিন্তাকে মেয়ে মাত্রই ব্যাপক গুরুত্ব দেয়। জীবনে অনেক কিছু করা থেকে বিরত থাকে শুধুমাত্র এসব চিন্তা করেই। নিজেই সকল অন্যায় অত্যাচার অবিচার অপমান সহ্য করবে, কিন্তু মুখ  ফুটে একটিও সাহসের কথা বলবে না।
প্রতিদিন চলতে ফিরতে কত অহরহ অপমান-নোংরা মন্তব্য-অশ্লীল ইঙ্গিত-গায়ে হাত; তবুও তারা মুখ বন্ধ করে সহ্য করে যায়। কীসের ভয়ে?

Nila“যদি কিছু বলি আশেপাশে মানুষ তো জেনে যাবে কী হয়েছে! যদি পাল্টা অপমান করতে যাই মানুষ তো জেনে যাবে কেউ গায়ে হাত দিয়েছে আমার”।
এই জেনে যাওয়ার ভয়ে তারা টুঁ শব্দও করবে না! কিন্তু একবারও ভাবে না যদি মানুষ জেনেই যায় তাতে অসুবিধা কী? মানুষ টিটকারি করবে! করুক না। তোমার প্রতিবাদে যে ছেলেটি তোমাকে অপমান করেছে তার চেহারা সবার সামনে আসবে, সেও অপমানিত হবে। কিছু মানুষ যেমন টিটকারি করবে, তেমনি আবার কিছু  মানুষ তোমার সাথে প্রতিবাদও করবে। আর যদি কেউ প্রতিবাদ নাও করে তবুও তুমি তোমার অপমানের বদলা তো নিলে।

শরীর কোনো পাবলিক প্রপার্টি না যে, কেউ এসেই তাকে ছুঁয়ে যেতে পারে, বাজে মন্তব্য করতে পারে। একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ে কেউ কুৎসিত নোংরামি  করবে, আর তুমি চুপ করে সেটি সয়ে যাবে; তবে তুমি নিজেও তো তোমার প্রতি অন্যায় করলে। যে তোমার  গায়ে হাত দিয়ে গেল সে অপরিচিত, কিন্তু তুমি তো তোমার আপন, তোমার শরীরের কিছু হলে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আগে তোমার  উপর  বর্তায়।

যেখানে তুমি অযৌক্তিক লোকলজ্জার ভয়ে পিছিয়ে যাও সেখানে অন্যরা তোমার  পক্ষে প্রতিবাদ করবে সে ভাবাও তো অন্যায়। নিজে কী  করেছ নিজের জন্য আগে সেটি ভাবো নারী!
ঠিক এমনই ভয় লজ্জা সংকোচ পেতাম একসময় আমিও। বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার বাসে একদিন বুকে কুৎসিত থাবা অনুভব করি। লজ্জা-ভয়-ঘৃণা-কান্না চেপে ধরে আমাকে। কী অপরিসীম নোংরা অনুভূতিতে মন অন্ধকার  হয়ে যায় একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে। কিন্তু রাগটাও জন্মেছিল প্রবলভাবে। সকল ভয় লজ্জাকে তুচ্ছ করে ছেলেটির কলার চেপে ধরেছিলাম।

আশেপাশের মানুষজন ব্যাপারটি জানতে পেরে আমার পক্ষেই সমর্থন দিলেন, এবং ছেলেটিকে বাস থেকে নামিয়ে দিল।
সেই ছিল আমার প্রথম প্রতিবাদ। আমি আজও জানি সেইদিন আমার ভেতরে কী অপরিসীম ভয় কাজ করছিল, কী মারাত্মকভাবে আমার বুক কাঁপছিল।

eve teasing 1“কী হবে, লোকে কিছু বলবে কিনা, নাকি আমাকেই দুটো কথা শুনিয়ে দিবে, লজ্জা দিবে আমাকে!  সকল “কী” কে আমি গলা টিপে ধরে ক্রোধটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলাম। এবং আমি জয়ী হয়েছিলাম। সেদিন কেউ আমাকে কটু কথা শোনায়নি, আমার পোশাক নিয়ে কিছু বলেনি, কেউ সেই ছেলেটির পক্ষ নেয়নি। কারণ আমি যা করেছিলাম সেটি সঠিক ছিল, ন্যায্য ছিল।
বলছি না পরিস্থিতি সবসময় আমাদের অনুকূলে থাকবে। সেদিন আমার পক্ষে সবাই ছিল বলে মানে এই নয় যে সব সময় থাকবে। এমনও ঘটেছে সাথে কাউকে পাইনি।

কিছুদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পথে সিএনজি থেকে নামতে গিয়ে এক পাশের ওড়না প্রায় পড়েই যাচ্ছিল মাটিতে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ছেলে ওড়না ধরে টান দিল, তাকে ধরতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। রাগে এতই মেজাজ বিগড়ে গেল যে তাকে গালি ছুঁড়ে দিলাম। আশেপাশে  কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ছিল, তারা বলে উঠল, এত রাতে বাইরে কী, বাসায় যাও। মানে আমার ওড়না ধরে টান দেওয়া কোনও ব্যাপারই না, আমার রাতে বাইরে থাকা ব্যাপার। অথবা আমি রাতে বাইরে বলে ওড়না ধরে টান দেওয়া বৈধ!
এই যে উলটো আমাকেই কথা শুনতে হলো, তাতে কি আমার দমে যাওয়া উচিত? নাকি আমার আর রাতে বাইরে থাকা উচিত না?
আমি থামিনি, যা আমার করার তা আমি করেছি, যেখানে যখন প্রতিবাদ করতে পেরেছি, করেছি। কখনও সফল হয়েছি, কখনও হইনি। খারাপ লেগেছে, কুৎসিত লেগেছে, ঘৃণা লেগেছে, কিন্তু লোকে কী ভাববে এই চিন্তায় নিজেকে কুঁকড়ে রাখিনি।

eve teasing 3তোমার প্রতিবাদে লোকে তোমাকে ভাল বললো, নাকি মন্দ বললো সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি গুরুত্ব দিতে যাও তবে কোনোদিন নিজেকে ঐ অশ্লীল আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমার পিছনে হয়তো অনেক কথা বলে বেড়ায়, হয়তো বাজে মন্তব্য করে, মাঝে মাঝে প্রকাশ্যেও করে, তাতে আমার কী ক্ষতি হয়? আমি তাদের কথাকে পাত্তা দিলেই বরং আমার ক্ষতি। কারণ ওইসব মন্তব্য আমাকে দুর্বল করবে ।
নিজেই যদি নিজেকে বাঁচাতে কিছু না করো তবে তোমার অপমানের ভাগি তুমি নিজেও হলে।

এগুলো এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু ব্যবস্থা এমন বলে  কুঁকড়ে থাকলে পরিবর্তন করবে কে। বাস থেকে নেমে মুখে চোখে কান্না ধরে রেখে মেয়ে তুমি নিজেই নিজের উপর অত্যাচার করছ। কেউ হাত দিয়েছে, তুমি সাথে সাথে তার প্রতিবাদ না করে পরে কান্নাকাটি করলে বা মন খারাপ করলে কি তোমার  অপমানের শোধ নেওয়া হলো?

নাকি পাল্টা আঘাত করে, প্রতিবাদ জানালে মনে শান্তি পেতে? মুখ বুঁজে সহ্য করা মানেই হচ্ছে তাদের এই আচরণকে আরও শক্তিশালী করা। প্রতিবাদ করছো না মানেই তো তুমি অক্ষম-দুর্বল-শোষিত। আর যে অক্ষম হয় তাকে জগত সংসার মিলে অত্যাচার করবে এটাই  নিয়ম। তোমার হাতে সিদ্ধান্ত, নিজেকে দুর্বল বানিয়ে অত্যাচারিত হতেই থাকবে, নাকি প্রতিবাদও করবে।

অহরহ বলে থাকি আমরা  “এই পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নাই, ঘরে বাইরে বাসে গাড়িতে রাস্তাঘাটে মেয়েরা ভীষণ অনিরাপদ”
এটি অভিযোগ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে। সবাই পরিবর্তন চায়, চাওয়াটা এমন যে কেউ এসে সমাজকে কোনও জাদুবলে পরিবর্তন করে দিবে।

ভয় লজ্জা সংকোচে জর্জরিত নারী; কেউ এসে সমাজকে পালটাতে পারবে না, যদি না তুমি নিজ থেকে পরিবর্তন করো। তোমাকে চিৎকার করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রাপ্য অধিকারের জন্য লড়তে হবে। তাতে লোকে মন্দ বললে, বলতে দাও। যারা মন্দ বলে তারা চায়ই তুমি আজীবন অধীনে থাকো। সুতরাং সিদ্ধান্ত তোমার, লড়ে নিজের সম্মান রক্ষা করতে চাও, না লোকনিন্দাকে জয়ী করতে চাও।

শেয়ার করুন: