কাকলী তালুকদার: আমি রাজাকারের ফাঁসি চাই সবসময়। কিন্তু যেদিনই ফাঁসি হয়েছে কোন রাজাকারের, আমি উল্লসিত হতে পারিনি। কোন মৃত্যু আমাকে আনন্দিত করতে পারে না কখনও। সেই মুহূর্তগুলোতে ব্যক্তির মুখ, তাঁর পারিবারিক জীবনের ছবিই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমার মন সেদিন খারাপ থাকে।
আমি মানুষ বলেই হয়তো আমার অনুভূতিগুলো এমন ধন্দে পড়ে যায়।
ঐশীকে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, আমি ওর পক্ষে দাঁড়াতে পারি না! কেমন করে নিজের মা-বাবাকে সে খুন করলো? আবার অনেক ভেবেও আমি তার মৃত্যুর বিপক্ষে নিজেকে নিতে পারছি না। যেমন পারছি না, দেশে প্রতিদিন চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাকারীদের পক্ষে দাঁড়াতে।
আমার দুই বিচারক ‘মন’ ও ‘বিবেক’ যমজ হলেও আমি তাদের আলাদা স্বত্বায় মূল্যায়ন করি। কারণ এই দুই বিচারক আমাকে পথ দেখায়।
ঐশী যখন খুন করে মা-বাবাকে তখন তার বোধ বিষয়টি অবচেতন ছিলো। যেকোনো মাদকই তাই করে, স্বাভাবিক বোধশক্তিকে নষ্ট করে ফেলে। ঐশী যে নেশার ঘুরে খুন করেছিল ঠিক তেমনি আর একটি নেশায় চাপাতি দিয়ে নির্দ্ধিধায় খুন চলছে আমাদের দেশে। বোধশক্তিবিহীন না হলে কেউ খুন করতে পারে না। আর সেই বোধশক্তিকে আচ্ছন্ন করার মতো অনেক রকমের নেশা আমাদের চারপাশে রয়েছে।
ঐশী যে নেশাটি গ্রহণ করতো, সেই নেশার যোগান দাতা কে বা কারা? সেই নেশা কি শুধু ঐশীই গ্রহণ করেছে? আরও গোপন ঐশী কি আমাদের সমাজে নেই? যারা ঐশীর মতোই চাপাতি চালিয়ে ব্লগার, শিক্ষক, পুরোহিত, ভিক্ষু, অন্য ধর্মালম্বীদের খুন করছে তারাও কি সুস্থ? তারা কি কোনো আসক্তি ছাড়া এই খুন ঘটাতে পারছে?
অন্যদিকে আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম! উন্নত দেশগুলোতে আমি বৃদ্ধাশ্রমকে দেখেছি একজন বৃদ্ধ মানুষ তাঁর আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে।
আর আমাদের মতো দেশে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠে অবহেলার প্রতীক হিসেবে! ঐশীর মতো আমরাও কি অপরাধ করছি না? বৃদ্ধ মা-বাবাকে তিলে তিলে মৃত্যুর কাছে কি পৌঁছে দিচ্ছি না তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে? আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমগুলোর উপর প্রতিবেদন হলে হাজার হাজার ঐশীর মতো সন্তান বেরিয়ে আসবে।
আমি অপরাধীকে সাপোর্ট দিতে চাই না। কিন্তু যে অপরাধের কারণে হাজার হাজার ‘মাদকাসক্তি নিরাময়’ নামক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার উৎস কোথায়? আমাদের প্রভাবশালী নেতার সন্তান রনির নাকি তিনটি মাদক উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে! এমন রনিদের সংখ্যা আমাদের ঠিক কতজন আছে? সেই রনিরা কি তাদের পারিবারিক সেল্টার ব্যবহার করেই ঐশীদের তৈরি করছে? যার কারণে ঐশী নিজের মা-বাবার শরীরের প্রিয় গন্ধটিও চিনতে পারেনি!
কী এমন নেশা ঐশীকে এমন বোধশক্তিহীন করে দিয়েছিল যে সেই নির্ভরতার স্থানটিকে সে নিজ হাতে নিঃস্ব করে দিলো? চাপাতি ব্যবহার করা ঐশীরাও কি একই কাজ করছে?
নিঃস্ব মা-বাবার বৃদ্ধাশ্রম তৈরিতে ঐশীরাই কি ভূমিকা রাখছে?
আমি ঐশীর ফাঁসি চাই না, যেমন চাই না ক্রসফায়ারে জঙ্গি পরিচয়ে হত্যা। চাই অপরাধের কারণ নিশ্চিত করে উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হবে আমাদের আশ্রম।
ঐশীর অপরাধকে শুধুমাত্র ঐশীকে দিয়ে বিচার করা হবে আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়। তার ফাঁসির মধ্য দিয়ে একজন অচেতন ঐশীকে হত্যা করা হবে। আমরা বোধশক্তিসম্পন্ন ঐশীর কাছে তার অনুশোচনার শাস্তিটুকু দেখতে চাইনি!
মাদকের মতো আবারও একটা ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়ে দিচ্ছি তার গলায়! হত্যার কারখানা চারদিকে আমরাই যত্ন করে তৈরি করছি! সেখানে ঐশীরা ঝুলে যাচ্ছে অথবা ক্রসফায়ারে পরে যাচ্ছে!
একটি সভ্য রাষ্ট্র কখনই ক্রসফায়ার নামক হত্যাকে বৈধতা দিতে পারে না! রাষ্ট্রের ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে বৈকি।
তবে রাষ্ট্র যদি অন্যান্য ইস্যুর মতো নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করতে চায় তবে ঐশীর ফাঁসির কোনো বিকল্প নেই।
অপরাধ বিষয়টি ক্ষমতার শেল্টার ছাড়া সম্ভব নয়। যেকোনো মাদকই ক্ষমতাবানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
তাই ঐশীদের ফাঁসির দড়ির কারখানা হবে নাকি ঐশীরা ফুল হয়ে ফুটবে বিষয়টির দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের এবং রাষ্ট্রের।
৩০ জুন ১৬