ঘোরলাগা এক রাতে পাশেই ছিল বাবা

আফরোজা ফেরদৌস: ফেইসবুক-এর নিউজফিড ভর্তি সবার বাবার ছবিতে। বেশিরভাগ ছবিই বন্ধুদের ছোটবেলার, তাদের বাবার কোলে বা ঘাড়ে চড়া। আবার বেশ কিছু একেবারে সদ্য তোলা, যেখানে বাবাকে ছুঁয়ে আছে ছেলে-মেয়েরা। আর কিছু ছবি মেয়ে বন্ধুদের, তাদের বাচ্চাদের সাথে তাদের বাবার। সবগুলো ছবিই ভীষণ সুন্দর, মন কাড়া। কারণ ছবিগুলোর দিকে তাকালেই চোখে পড়ে একজন দায়িত্বশীল সুখী বাবা আর তার পাশে আদরে হেলে পড়া ছোট্ট অথবা বড় হয়ে গ্যাছে তবুও শিশু মনের কন্যাটি।

Baba 6কন্যাটি বললাম এ কারণে যে ছেলেদের বেশিরভাগই তাদের আবেগ লুকিয়ে রাখে, ফেইসবুক-এ প্রকাশ করে না।

আমি কোনো ছবি পোস্ট করিনি। ইচ্ছে যে করেনি ঠিক তা না। আসলে আমার আর বাবার রিসেন্ট কোনো ছবি নেই। পুরনো ছবিগুলো থেকে বাছতে গিয়ে নিজের ছোটবেলার গুল্টু চেহারা দেখে নিজেই হেসে ফেলেছি।

তারপর চোখ গেল বাবার ছবির দিকে। আমার আব্বা। লম্বা, ফর্সা, কাটাকাটা চেহারার কী সুন্দর এক যুবক। বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। কোনটাতে বা সাফারি পরে সানগ্লাস চোখে, কী স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম। মনেই হয় না দুই বাচ্চার বাবা।

আমার আব্বা। চোখ আটকে গেল আমার এত রুপবান আব্বাতে। তারপর সে চোখ দিয়ে যে কখন পানি গড়াতে লাগলো বুঝিনি। আব্বার সাথে একটা রিসেন্ট ছবি তুলতে পারলে বেশ হতো। আব্বার সেই প্রিয় পোজে।

আমি আব্বার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাসছি আর আব্বা আমার মাথায় হাত দিয়ে, ক্যামেরার দিকে না বরং আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। এটা যে আব্বার কেন এতো পছন্দের পোজ ছিল জানি না

baba n meye 1আব্বা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন আমি আমেরিকাতে। আমার হাসবেন্ড পিএইচডি স্টুডেন্ট। আমি তখন ওয়ালমার্টে এ কাজ করি।  এদের পলিসি হলো পরিবারের কেউ মারা গেলে ওরা তিনদিন ছুটি দেয় ফিউনারেল এর জন্য এবং এই তিনদিনের জন্য ফুল টাইম পে করে।

তিনদিন পর আমি যখন ঘোর লাগা চোখে আমার HRO কে গিয়ে বললাম, দেখো আমার টাকা লাগবে না, আমার শুধু একটু সময় দরকার।

ভদ্রলোক জানতে চাইলো, কেন? তুমি তো তোমার বাবার ফিউনারেল-এও যাওনি, তবে কেন? আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম, আমার জন্য অপেক্ষা করলে অনেক দেরী হয়ে যেত,  আমি ফ্লাই করলেও আমার যেতেই প্রায় দুইদিন লাগবে, আর আমার বাচ্চাটাও খুব ছোট। তাছাড়াও আমাদের এক্সচেঞ্জ ভিসা। এই ভিসার নিয়ম হলো প্রতিবার গিয়ে নতুন করে ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করতে হয়।

আমার স্বামীর ডিফেনস সামনেই। তার আই টুয়েন্টির মেয়াদও শেষের পথে। ওকে ছাড়া আমরা মা -মেয়ে ভিসার জন্য দাঁড়ালে এতো অল্প সময়ের জন্য তা নাও দিতে পারে। তার মানে ওকে ছাড়াই  ৬/৭ মাস দেশে থেকে যেতে হতে পারে।

Baba 5সমস্যা হলো আমার মেয়েটা তার বাবাকে ছাড়া একেবারেই থাকতে পারে না, অনবরত কাঁদতে থাকে। ছয় মাসে ও যদি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে! আমি তো এখন গিয়ে আমার বাবাকে শেষবারের মতোও আর দেখতে পাবো না, তাহলে বাচ্চা মেয়েটাকে তার বাবার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখি কী করে! আমার কাছের বন্ধুরা এবং দেশ থেকে আপনজনেরা বোঝাতে লাগলো এসব কথা বলে। আমি চুপচাপ শুনে যেতে থাকলাম। কিন্তু আমার মন ও মস্তিস্কে প্রতিনিয়ত বইতে লাগলো প্রচণ্ড ঝড়।

এর মাঝে এক বাংলাদেশী বড় ভাবী বললেন, তুমি বরং আবার কাজ শুরু করো, আর তোমার মা’কে  সাহায্যের কথা ভাবো। আমি অবাক হলাম, বললাম, আমার আম্মুর তো অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

ঊনি আদর করে বললেন, শোনো মেয়ে, এই সময়ে খড়কুটোও ভীষণ কাজে লাগে। আব্বার জীবনের শেষ দিনগুলিতে না থাকতে পারার দুঃখ ও অপরাধ বোধকে আমি মা এর প্রতি মহান কর্তব্যে নিয়োজিত করতে লাগলাম। ভাবীও হয়তো এটাই চেয়েছিলেন, যেন আমি ব্যস্ত থাকি। আমার আর দেশে যাওয়া হলো না। শুরু হলো এক অদ্ভুত ঘোর লাগা অধ্যায়।

সাধারণত আমার কাজের সময় ছিল খুব সকাল থেকে বেলা ৩ টা পর্যন্ত। কাজ শেষে সাড়ে ৩ টায় মেয়েকে প্রি স্কুল থেকে তুলে নিয়ে বাসায় ফিরতাম।

তখন মার্চ মাস, প্রচণ্ড শীত। পুরো শহর বরফে ঢাকা। ভোর ৫টা থেকে উঠে আমার স্বামী আমাকে এক বাটি দুধ সিরিয়াল দিয়ে পার্কিং লটে গাড়ির উপর জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করে দিত। আমি যখন রওনা হতাম চারপাশ তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার| পাঁচ মাইল রাস্তায় কদাচিৎ কোনো গাড়ি চোখে পড়তো। পথের এক পাশে  ছিল ঘন  জঙ্গল আর অন্য পাশে বিস্তীর্ণ ভুট্টার ক্ষেত। আমি ফ্যালফ্যাল চোখে ড্রাইভ করতাম। আমার কিন্তু একটুও ভয় করতো না। আমার কেবলই মনে হতো ঘাড় ঘোরালেই দেখবো ব্যাক সিটে আব্বা বসে আছে। আমি মাঝে মাঝে ব্যাক ভিউ মিররে দেখার চেষ্টাও করতাম। এক অদ্ভুত পরিপূর্ণতায় আমার মন ভরে যেত।  

শীতের রাতে এক পাশে নিকষ অন্ধকার আর অন্য পাশে সাদা বরফে ঢাকা দীর্ঘ মাঠ। এই নির্জন রাস্তায় বেশির ভাগ সময়ই আগে পিছে কোনো গাড়ি থাকতো না। আমার গাড়িটা ঘন্টায় ৬০ মাইল বেগে উড়ে যেত, আর আমি ভেসে যেতাম এক অন্য রকম জগতে। পেছনের কোনো গাড়ির হেড লাইটের আলোয়  হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেতাম। মনে হতো যেন পেছনের গাড়িটা আমাকে টেনে ধরে রেখেছে পৃথিবীর স্বাভাবিক স্তরে।

Baba 2এমনই এক দিনের এক অদ্ভুত অনুভূতির কথা আজও ভাবায় আমাকে। সেদিন রাস্তায় অন্য কোনো গাড়ি নেই। আমি এক টানে জঙ্গলটা পার হওয়ার চেষ্টা করছি।  রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি যখন চলে এসেছি হঠাৎ দেখি আমার গাড়ির সামনের কাঁচটা ঝাপসা হয়ে ঢেকে গেলো। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। দ্রুত ব্রেক এ পা রেখে স্পিড কমাচ্ছি, কিন্তু মনে হলো আমার গাড়িটা যেন একটা ঘন কুয়াশার বলয় এর মাঝে ভেসে যাচ্ছে। এমন না যে ঐ মুহূর্তে হঠাৎ বরফ পড়তে শুরু করেছে, অথচ আমি যেন একটা সাদা চাদরের নিচে ঢাকা পড়ে গেলাম।

কতোক্ষণ জানি না, হয়তো কয়েক সেকেন্ড। গাড়ি পুরোপুরি থামার আগেই আবার সবকিছু আগের মতো ঝকঝকে পরিষ্কার। আমি কিন্তু তবুও ভয় পেলাম না আবার চলতে শুরু করলাম। আমার জীবনটাই হয়তো তখন একটা অটোমেটিক মোড এ চলে গিয়েছিলো। অথচ আজ যখন ঐ রাতের ঐ মুহূর্তগুলোর কথা ভাবি আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

কী হয়েছিল ঐ রাতে? কেন ঐ মুহূর্তগুলো অমন রহস্যময় হয়ে গিয়েছিলো? আমার কি কোনো ধরনের হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো? নাকি ওটা একটা সাধারণ কুয়াশাই ছিল?

আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমার পেছনের সিটে আব্বা বসেছিল চাদর মুড়ি দিয়ে। আব্বার সিটবেল্ট বাঁধা ছিল না। আব্বা শক্ত করে সিটের দুই পাশ আঁকড়ে ধরে ছিল মোশন এডজাস্ট করতে। আব্বা সত্যিই ছিল, তাই তো আমি একটুও নার্ভাস হইনি। হুইল এ আমার হাত একটুও কাঁপেনি।

কিন্তু আজ ঐ সব রাতের কথা ভেবে আমি আতংকিত হই।  আজ আমি একা বাসায় থাকতে প্রচণ্ড ভয় পাই। একা একা  ঘুমিয়ে পড়তেও ভয় পাই। ড্রাইভ করতে তো মনে হয় ভুলেই যাচ্ছি। আব্বা বোধ হয় আমার পেছনে আর বসে থাকে না।

 

শেয়ার করুন: