প্রিয়দর্শিনী অভি: যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হলে আমরা খুশী হই। খুব অহঙ্কারের সাথে সবাইকে জানাই, আজকে আরেকটা ঝুললো। ফেসবুকে ঝড় উঠে ‘দেশপ্রেম’ নামক ভণ্ডামির। কেন? ধরেন, ১৯৭১ সালের মতো এখন আরেকটা যুদ্ধ শুরু হলো বাংলাদেশে এবং পাকিস্তান তখনকার মতোই বলতে শুরু করলো, এটা ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ, মুসলমানের যুদ্ধ। কতোজন বাংলাদেশী তখন দেশ রক্ষার তাগিদে যুদ্ধে ঝাঁপ দেবে আর কতজন মুসলমানকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে?
বাংলাদেশ জেনোসাইড আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাত কোটি মানুষের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসসহ দেশদ্রোহী বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিল। আমি হলফ করে বলতে পারি, এখন যদি দেশে কোন যুদ্ধ বাঁধে এবং তার সাথে কোনভাবে ‘মুসলমান’ নামটা জুড়ে দেয়া যায়, তবে এ সংখ্যাটা এখন আর হাজারে না কোটিতে গিয়ে ঠেকবে। হয়তো ষোল কোটির এই দেশে আট কোটি মানুষই ধর্ম রক্ষায় বেপরোয়া হয়ে যাবে! তারা হয়তো আবার নতুন কোন রাজাকার, আল-বদর বা আল-শামস নামক বাহিনীতে যোগ দিবে! হয়তো আমার এতোদিনের চেনা অসংখ্য মানুষের রূপ বদলে যাবে! হয়তো!
একটা মজার তথ্য দেই। গত রবিবার অফিসের একটা কাজে আমরা দুটো টিম ঢাকার বাইরে যাই। যদিও দুটো টিম আমরা দুটো জায়গায় যাবো, তবুও প্রায় একই সময়ে ফ্লাইট থাকার কারণে আমাদের এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে যায়।
দুটো টিমে আমরা মোট তিনজন মেয়ে ছিলাম। এবং আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পুরো এয়ারপোর্টে আমরা তিনজন ছাড়া প্রত্যেকটি মেয়েই হিজাব বা বোরকা পরা। অনেককে আবার দেখলাম, এই গরমের মধ্যে কালো বোরকার সাথে কালো নিকাব, হাত মোজা, পা মোজা পরা অবস্থায়। এতো শত হিজাবের ভীড়ে আমাদের তিনজনকে দেখতে রীতিমত ‘এলিয়েন’ লাগছিল।
এরপর গ্রামে গেলাম। বাচ্চা, কিশোরী, তরুণী কিংবা মধ্যবয়ষ্ক নারী সবার পোশাক হিজাব। স্কুলের মেয়েদের এখন আর কোন ইউনিফর্ম নেই। কেউ আর আগের মতো সালোয়ার- কামিজ পরে, বেনী দুলিয়ে স্কুলে যায় না। সবার এক এবং অভিন্ন পোশাক। আর তাহলো, হিজাব। ঘরে ঘরে ‘হিজাব’। রাস্তা- ঘাটে ‘হিজাব’। স্কুল- কলেজে ‘হিজাব’। অফিস- আদালতে ‘হিজাব’। হিজাবেই ‘দুনিয়া’। হিজাবেই ‘সম্ভ্রম’। আমি যখন স্কুলে পড়তাম আমাদের ক্লাসে ৬০ জন মেয়ের মধ্যে হাতেগোনা চার কি পাঁচজন বোরকা পরতো। সেই বোরকা পরার কারণটাও ছিল খুব অদ্ভুত। হয়তো ওদের স্কুল শেষে কারো সাথে ডেটিং থাকতো। টিচার, অভিভাবক বা পরিচিত কেউ যেন হঠাৎ করে না দেখে ফেলে বা দেখলেও যেন চিনতে না পারে সেই উদ্দেশ্যেই পরা হতো সুরক্ষাপ্রদানকারী এই বোরকা।
যতদূর মনে পড়ে, ইসলাম রক্ষার তাগিদে বোরকা পরার প্রচলন তখনও ছিল না। আর এখন ক্লাসে শতকরা নব্বই ভাগ মেয়েরই পোশাক হিজাব বা বোরকা। যারা পরে না তারা হয় হিন্দু, নয় আমার মতো উচ্ছন্নে যাওয়া কোনো মেয়ে। চিটাগাং এর এক স্কুলে দেখলাম ইউনিফর্মই বোরকা। স্কুলের সব মেয়েরা দল বেঁধে নীল বোরকা পরে স্কুলে যাচ্ছে। কী ভয়ংকর!
ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে যদি মেয়েরা হিজাব করে থাকে তবে বলে রাখা ভাল যে, ইসলাম ধর্মে শরীর ঢেকে রাখা, নিজেকে আবৃত করার সাথে সাথে দৃষ্টিকে সংযত রাখার কথাও বলা হয়েছে। এবং তা নারী ও পুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য।
শরীর ঢেকে রাখা মানে সৌদি আরব থেকে আমদানীকৃত ‘বোরকা’ বা ‘হিজাব’ নামক যে বিশেষ পোশাকটির প্রচলন আমরা শুরু করেছি, তা নয়। মূলত এটা কোনকালেই বাংলার পোশাক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের ছবি, সিনেমা বা গানগুলো যদি দেখি, হিজাব করা মেয়ে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। সেই সময়ের মেয়েরা শাড়ি পরতো।
তাহলে তখন কি এই বাংলাদেশের মানুষের কোন ধর্ম ছিল না? তখন কি তারা মুসলমান ছিল না? ভৌগোলিক এবং আবহাওয়াগত কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা পোশাক পরে। সেটা নারী- পুরুষ উভয়ই পরে। এই পোশাক মানেই যদি ইসলাম ধর্ম হয়, তবে বাংলাদেশের ছেলেরা কেন সাদা আলখাল্লা পরে না? তাদের প্যান্ট নামতে নামতে কেন আন্ডারগার্মেন্টসের নীচে চলে যায়? সৌদি আরব মানেই যদি ইসলাম ধর্ম হয় তবে বাংলাদেশের মুসলমানেরা তথা আমরা কেন আরবীতে কথা বলি না? আমাদের প্রাণের ভাষা কেন ‘বাংলা’? বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত ভাষা থেকে। যা মূলত হিন্দুদের ভাষা হিসেবে পরিগণিত।
আমরা কেন কুরবানীর ঈদে গরু জবাই দেই? আমাদের ‘দুম্বা’ কুরবানী দেওয়া উচিত। সৌদিতে তো দুম্বা কুরবানী দেয়। ধর্মই যেহেতু পালন করছি, সবক্ষেত্রেই তা করা উচিত। শুধু নারীর পোশাকেই তা সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? সৌদির নিয়মকে আদর্শ মানলে, বিশ্বের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াতে আসলে কোনো মুসলমানই নেই।
ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। সার্বজনীন ধর্ম। এই ধর্মের নিয়মকানুন কোনো একটা নির্দিষ্ট দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মনে করাটাও কিন্তু এক ধরনের ধর্ম গর্হিত কাজ।
ঢাকা হলো মসজিদের শহর। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কী ভীষণ বৈপরীত্য! তাই না?
যুক্তি বলে, সবচেয়ে বেশীসংখ্যক মসজিদে গমনকারী এই মুসলমানেরাই তাদের কৃত-কর্মের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে আমাদের জন্য এই বিরাট সম্মান(!) বয়ে এনেছে। আজকে কেউ খুন হলে আমাদের সরকার প্রধান বলেন, ‘দেখতে হবে ঊনি ফেইসবুকে কী লিখেছেন’। যেন কেউ কিছু লিখে থাকলে তাকে খুন করাটা আমাদের সবার দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যায়!
যাই হোক, আমার আজকের লিখাটা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। বা আমি কাউকে কাপড় না পরে রাস্তায় বের হবার জন্যও উৎসাহিত করছি না। যখন বেণী দুলানো কিশোরীর হাসিমাখা একটি মুখের পরিবর্তে পুরো শরীর বোরকায় ঢাকা চার বছর বয়সী মেয়েশিশুকে মায়ের কোলে দেখি, তখন খুব কষ্ট হয়। ইচ্ছে হয় যেয়ে বলি, “বাচ্চাটাকে ওর শৈশব দ্যান। ওকে ওর মতো করে বড় হতে দ্যান। ওর প্রতিটা বয়সের আনন্দ উপভোগ করতে দ্যান। নইলে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আপনাকে মাফ করবেন না। ওকে আপনি সৃষ্টি করেন নাই। কাজেই ওর আনন্দ কেড়ে নেয়ার অধিকার আপনার নাই”।