ঝরে পড়া বকুলদের গল্প

তাহমিনা দিলসাদ: বাসার পিচ্চিটার পরীক্ষা। অনেকদিন পর স্কুলে গেলাম। যেহেতু অল্প সময়, ভাবলাম কিছুক্ষণ বসে থেকে পিচ্চিকে নিয়েই বাসায় ফিরি।

কয়েকজন মা বসে আছেন। একজনের মুখটা দেখলেই বোঝা যায় এককালে তিনি কেমন মার মার কাট কাট সুন্দরী ছিলেন। এককালে কেন বলছি, হয়তো বছর সাতে’ক আগেই ছিলেন। বিশাল ভুঁড়ি, দ্বিতীয় চিবুক থাকার পরেও তাঁর রূপের ঝলক চোখে পড়ে। আরেকটু সামনে যে নারীটি বসা, তাঁর চোখ দুটিতে বুদ্ধির ঝিলিক ঠিকরে বেরুচ্ছে। মায়াময় মুখের মেয়েটি একটু পর পর টিস্যু দিয়ে ঘামে ভেজা মুখ মুছে নিচ্ছে।

Dilshad
তাহমিনা দিলসাদ

একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম, এখানে বসে থাকা নারীদের বয়স ২৫ থকে ৩৫ এর মধ্যেই বেশি। কেউ তাঁর এক সন্তানকে স্কুলে দিয়েছেন বছর দুয়েক হলো। দুজন, তিন জন সন্তান স্কুলে পড়ে এমন মাও আছেন। যদিও সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে তারা কম।
তবে সবাই মা। সবাই বসে আছেন ধানমণ্ডি লেকের গাছের ছায়ায় দল বেঁধে। সন্তানদের ছুটি হবার আগ পর্যন্ত এরা দল বেঁধেই বসে থাকে। আড্ডা দেয়। খাওয়া-দাওয়া করে, শপিংও করে। এই মায়েদের জন্যই লেকের পাড়ে ছোটখাটো এক মার্কেট জমে উঠেছে। স্কুল ছুটি হবার সাথে সাথেই মার্কেটও ছুটি।

কী পাওয়া যায় না এখানে! জামা, জুতা, চুড়ি, আংটি, গয়না, ক্লিপ ব্যান্ড , গেঞ্জি, মোজা, ট্রাউজার, ব্যাডকভার, হাড়িপাতিল, সব ধরনের সবজি, গরম মশলা, ফল, দুধ, পোলাওয়ের চাল, আচার, হজমি, ফুচকা, সিঙ্গাড়া, চা, স্যান্ডউইচ, সিগারেট, পিঠা, মুড়ি, পরোটা, ভাজি, ডিম, আরও কত কী।
ডাইবেটিস পরীক্ষা করার ডাক্তার, মিনি পোর্টেবল জিম, সবই আছে। খুঁজে দেখিনি, হয়তো বাঘের দুধও আছে।
মোট কথা সে এক বিশাল আয়োজন।

হাসি, আড্ডায় উচ্ছল মায়েদের পাশাপাশি কিছু পুরুষ মানুষেরও দেখা পাওয়া যায়। কিছু হয়তো বাচ্চাদের বাবা (?), কিন্তু অনেকেই না। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে লেকের পাড়ে বসে থাকা বাবার সংখ্যা নেহায়েত কমই হবার কথা। সবারই কাজ থাকে। থাকারই কথা। ব্যবসা, চাকুরি,… সবাই ব্যস্ত।

তবে কিছু পুরুষ আছেন যারা অনেক স্বাস্থ্য সচেতন(?)। খুব করে লেকের পাড়ে দৌড়ানো শেষে তারা তেলে চুপ চুপ করে ভাজা ছয়টা পরোটা, মালাই চিনি দেয়া চা, ডিম ভাজি খেয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করেন এবং লেকের পাড়ে বসে থাকা মায়েদের দিকে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকেন।

Frida Kahloব্যতিক্রমও আছে বৈকি। লেকের পাড় সবার জন্য উন্মুক্ত। সুন্দর জায়গা। সকালবেলা আরও সুন্দর লাগে। যে কেউ আসতে পারে। খামোখা কিছু লোকের জন্য সবাইকে একই রকম না ভাবি।
ফিরে আসি মায়েদের কথায়। আমার বরাবরই একটু নাক সিটকানো ভাব ছিল এই সব মায়েদের নিয়ে। যখনই তাদের পাশে বসেছি, শুনতে পেয়েছি
জানেন ভাবী, আমার বুয়াটা না একটা বদ, একদিন এলে আরেকদিন খবর নাই।
ও মা! কী সুন্দর! ভাবী, কানের দুলটা কত নিল?
ও ভাবী, আমার শাশুড়িটা না কী যে দজ্জাল! জীবনটা ভাঁজা ভাঁজা করে ফেলল।
দেখেন ভাবী এই ডায়মন্ডের রিংটা ও কিনে দিয়েছে। ৫০ পড়লো। কী যে পাগল একটা!
বঁধুবরণ দেখেছিলেন কাল? আমি মিস করলাম। এই পর্বে কী হলো বলেন না ভাবী।

ওদের নিয়ে আমার নাক সিটকানো সেই থেকে শুরু। শাড়ি, গয়না, স্বামী, বুয়া, শাশুড়ি, বড়জোর কোন এক রান্নার রেসিপি নিয়ে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক বক করতে পারে। কীভাবে পারে, ভেবে আসলেই অনেক অবাক হতাম।
স্কুলের এই দুই ঘণ্টা এদেরকে আমি বিভিন্ন রূপে দেখেছি। একদিন দেখলাম এক ভাবী বাসা থেকে জুস, খিচুরি, গরুর মাংস রান্না করে নিয়ে এসেছেন। সকালের আড্ডার ভাবীদের খাওয়াবেন বলে। সবাই মিলে গোগ্রাসে খাচ্ছে। কী আনন্দ! হাসিগুলো যেন কিশোরীদের হাসি। কেমন যেন খিল খিল শব্দ। অনেক অনেক প্রাণবন্ত।
আজ অনেকদিন পর, অনেকদিন দিন পর আবারো আমি তাদের হাসি শুনলাম, দেখলাম। কিন্তু আজকের অনুভূতি একেবারেই ভিন্ন।
এই মায়েরা এই সময়টুকুতে সেই কিশোরী বেলায় ফিরে যায়। নিজেদের মতো থাকে, আড্ডা দেয়, হাসে। মোট কথা সংসারের ঘানি থেকে দুই ঘণ্টার মুক্তি। বুয়া, দারোয়ান, শাশুড়ি, রান্না কোন ঝামেলা নেই। শুধু নিজের জন্য সময়।

বাসায় মন খারাপের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা। সংসারের বিরক্তি নিয়ে হাসি-তামাশা। কখনও কুটনি শাশুড়িদের পেট ভরে বকা ঝকা, নিজের জমানো টাকা থেকে ইচ্ছেমত খরচ করা। ২৪ ঘণ্টা সংসারে সার্ভিস দেয়া এই মায়েরা নিজেদের এই দুই ঘণ্টা ভীষণ উপভোগ করে।
কৌতূহল নিয়ে দু চারজনকে পড়াশুনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানালো, ওরা সবাই মাস্টার্স করা। আমার তখন আরও একবার চমকানোর পালা। কেউ কেউ তো একাউন্টিং, ম্যাথ, ইকনমিক্স, ফিজিক্স এর মতো খিটমিটে সাবজেক্টে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর।
আমার কেন যেন মনে হতো, এইখানে আড্ডা দেয়া নারীরা বেশিরভাগ গ্রাজুয়েটই না। কত বড় বেকুব হলে এই টাইপের চিন্তা করতে পারি, ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।
লজ্জা পর্যন্ত থাকলে বেঁচে যেতাম। বিষয়গুলো কষ্টে রুপ নিল যখন জানলাম পরিবার তথা বাচ্চাদের সময় দেয়ার জন্যই তিনি আজ নিজেকে হারিয়ে … অমুকের মা…. অমুক ভাবী।

তাঁর পরিবার হয়তো ভেবেছে বাইরে কিছু করার চাইতে বাচ্চাদের সময় দেয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা তাঁর নিজেরই হয়তো মনে হয়েছে ক্যারিয়ার সামলে বাচ্চাকে ভালভাবে মানুষ করা সম্ভব না। কিংবা quality time and quantitive time ব্যাপারটা হয়তো তাঁর স্বামীকে বুঝানো যায়নি। কিংবা স্বামীর পরিবারকে।

নিজের পরিবারের চাইতে ক্যারিয়ারকে বড় করে ভাববে। এই রকম মেয়ে বাংলাদেশে অন্তত দুর্লভ। সবার আগে পরিবার, মেয়েরা এই জেনেই বড় হয়। এই ধারণা তাদের রক্তে মিশে গেছে।
অথচ আমি চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারি কী সুন্দর একটা ক্যারিয়ার থাকতে পারতো এখানকার প্রতিটা মায়ের। অসামান্য মেধা যা শুধুমাত্র সন্তান লালন আর রান্নায় খরচ হচ্ছে, সে চাইলেই পারতো তাঁর জন্য আনন্দময় অন্য একটা জগত খুঁজে নিতে। কর্পোরেট লেডি, ব্যাংকার, শিক্ষিকা, ব্যবসায়ি, যে কোন জায়গায় সে চাইলেই নিজেকে দেখতে পারতো। তাঁর সে মেধা, যোগ্যতা সবই আছে, ছিল।

কেন এভাবে বেছে নিতে বলা হয়, ক্যারিয়ার কিংবা পরিবার? দু’য়ের একটাকে। কখনো কি কেউ শুনেছে ডান চোখ চাই, নাকি বাম চোখ, এমন প্রশ্ন? দুটো চোখে problem কোথায়?
এক সাথে পরিবার আর ক্যারিয়ার… থাক, একটু বেশি চাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
কোনো এক ভাবীকে জিগ্যেস করেছিলাম, এভাবে বুয়েট পাশ মেয়ে ক্যারিয়ার ছেড়ে এখানে লেকের পাড়ে কী করছে?
আড্ডায় ব্যস্ত ঝলমলে কাপড় পরা ভাবীর চোখগুলোতে একটু যেন বিষণ্ণতা উঁকি দিয়ে গেল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাসও মনে হয় কানে বাজলো।
নইলে কি সন্তান মানুষ হবে? বলেই হাসলেন। আরও জানালেন, তাঁর মেয়ে বরাবরই ফার্স্ট হয়।
আপনার মতোই মেধাবী হয়েছে, বলতেই একটু লজ্জা পেলেন।
আমার কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়ে তিনি জানালেন তাঁর husbandও নাকি বুয়েট পাশ। ক্লাসমেট বিয়ে করেছেন। আর সবসময় তিনি তাঁর husband এর চেয়ে বেশি নাম্বারই পেতেন।
বাহ! মেয়েতো মেধাবী হবেই। বাবা-মা ভীষণ মেধাবী যে!
ভাইয়া কী করেন?
ওর নিজের একটা ফার্ম আছে।

আমার কেন জানি কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল। উঠে চলে এলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে কয়েকটা কথা বলি। বলা হয়নি। যেই সাজানো সুখ নিয়ে তিনি আছেন,তা যদি নড়বড়ে হয়ে যায় সেই ভয়ে।
যা বলতে চেয়েও পারিনি-

মেয়েকে এভাবে সময় দেয়াতে মেয়ে যে একটা “জুয়েল” হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ কি। সে অবশ্যই তাঁর মেধা দিয়ে জায়গা করে নিবে তাঁর বাবা মায়ের মতই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভালো রেজাল্ট নিয়েই বেরুবে।
ভাবী নিশ্চয় তা চাইবেন, চাইছেন। সেজন্যই তো তাঁর এত কষ্ট করা। নিজের ক্যারিয়ার ছেড়ে দেয়া। কিন্তু খেলা জমবে তখনই, যখন তাঁর এই “জুয়েল” মেয়ে আগামী ২৫ বছর পরে ঠিক এখানে তাঁর কন্যার জন্য অপেক্ষা করবে, তাঁর নিজের ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে।

একজন মা হিসেবে তাঁর তখন কেমন লাগবে? যে মেয়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলা, সেই মেয়ে যদি তাঁর মেয়ের জন্য নিজেকে হারায়? তাঁর মেয়ের জীবনটাও যদি তাঁর মতো হয়? সোনাদানায় মোড়ানো এক সংসারের গিন্নি। তিনি কি খুশি হবেন? তাঁর কি হবার কথা?

সব বাদ-
ভাবী আপনার নিজের মা কেমন আছেন? তিনি কি খুশি?
আপনার নিজের মেয়ের সুখ চাইতে গিয়ে আপনার মায়ের জীবন, সাধনাকে কি আপনি অসম্মান করলেন না?

কথা কয়টা আর জিগ্যেস করা হয় না…

শেয়ার করুন: