সেই মেয়েটা তুমি, সেই মেয়েটা আমিও

শাশ্বতী বিপ্লব: সেই মেয়েটা হতে পারো তুমি। সেই মেয়েটা হতে পারি আমিও। কিংবা আমাদের আগের বা পরের জন্মের কেউ। যে “মেয়ে মানুষ” হয়ে উঠতে চায়নি কখনো। কিন্তু যাকে সেটা বার বার মনে করিয়ে দেয়া হয়।

Shaswati 5যে মেয়েটার জীবন জুড়ে থাকে শত “না” এর পাহাড়।

যে মেয়েটা একপা এগুলে, দুই পা পিছু টানে সমাজ।

যে মেয়েটাকে সব সময় নিজের শরীর নিয়ে বিব্রত থাকতে হয়।

যে মেয়েটার যে কোন বয়সে, যে কোন সময়, যে কোন জায়গায়, যে কেউ দ্বারা যৌন হয়রানীর বা ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

যে মেয়েটার শৈশবে, কৈশোরে লেগে থাকে কদর্য কিছু হাতের ছোঁয়া। বাবার বয়সী মামার বা চাচার। ভাইয়ের বন্ধুর বা শিক্ষকের। প্রতিবেশীর বা নিকট আত্মীয়ের।

যে মেয়েটা সেই কথা কখনো কাউকে বলতে পারেনি। প্রতিবাদও করতে পারেনি। দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারেনি সেই হাতগুলো।

যে মেয়েটাকে নিয়ে তার পরিবারের সামাজিক সম্মান হারানোর খুব ভয়।

যে মেয়েটা স্বাধীনচেতা, কিছুটা মারকুটে, কিছুটা পাগলাটে। মেয়েটা যৌবনে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখে। যে মেয়েটার শিরদাঁড়াটা ঋজু।

যে মেয়েটা নিজেকে মেয়ে বলে ছোট, অক্ষম ভাবতে পারে না। মাথা উঁচু করে হাঁটে। নিন্দুকের কথার থোরাই কেয়ার করে।

যে মেয়েটা রূপবতী বা রুপবতী না। “রুপ” নিয়ে যার কোন মাথা ব্যথাও নেই। নিজেকে সাজাতে চায় না একদলা রঙিন মেকআপে।

যে মেয়েটা চায় “রূপ” নয়, সবাই তার গুণের কদর করুক।

যে মেয়েটা শিখতে চায় না সমাজের বেঁধে দেয়া “মেয়েলীপনা”র ঢংঢাং গুলো। গৃহস্থালীর কাজের চাইতে বাইরের জগতটাই বেশি টানে যাকে।

যে মেয়েটা ভালো গান গায় বা ভালো নাচে। চমৎকার আবৃত্তি করে বা মনমাতানো ছবি আঁকে।

মনে দাগ কেটে যায় যে মেয়েটার অভিনয় বা যে ভালো বিতার্কিক। যে মেয়েটা নাট্য নির্মাতা, তুখোড় সাংবাদিক বা খেলোয়াড়।

যে মেয়েটা স্বাবলম্বী হতে চায়। স্বপ্ন দেখে সমাজকে বদলে দেয়ার। সেই অপরাধে যাকে সবাই “ক্যারিয়ারিস্ট” বা “স্বার্থপর” বা “লোভী” বলে গালি দেয়।

যে মেয়েটা ভালোবাসে তার বন্ধুকে, তার সহযোদ্ধাকে। ভালোবেসে ঘর বাঁধে সেই মানুষটার সাথে, যে তার “না-মেয়েলী” দৃঢ়, স্বাধীনচেতা, মারকুটে স্বভাবটাকেই ভালোবাসে।

যে মেয়েটার কবিতাকে, গানকে, নাটককে, খেলাকে, আঁকা ছবিকে, বিতর্ককে, সাংবাদিকতাকে, তার সকল পারাকে এবং না পারাকে ভালোবাসে সেই মানুষটা।

যে মেয়েটা জীবনের সঞ্চিত সবটুকু ভালো লাগা, সবটুকু কষ্ট, সবকিছু উগড়ে দেয় মানুষটাকে পেয়েই। নির্ভর করে। কিছু লুকোতে হবে, জানেই না যে মেয়েটা।

যে মেয়েটার স্বপ্ন ভাঙতে দেরী হয়না।

যে মেয়েটা তার গর্ভের সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক হতে পারে না।

যে মেয়েটার সকল যোগ্যতাকে ম্লান করে দেয় তার অকপট, সৎ স্বীকারোক্তির সাহস। সেই অপরাধে ঢাকা পড়ে যায় যে মেয়েটার যা কিছু সুন্দর, যা কিছু ভালো।

শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, তেজ, স্বাবলম্বিতা, নির্ভয়তা যে মেয়েটার দোষ। সমাজের কাছে কাঙ্খিত “মেয়ে” বা “নারী” না হয়ে উঠার ব্যর্থতা যে মেয়েটার যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি।

যে মেয়েটা এই বস্তাপঁচা সমাজকে অস্বীকার করতে চায়। যেখানে সে বড্ড বেমানান।

সেই মেয়েটার বয়স বাড়ে।

সেই মেয়েটা ধীরে ধীরে আপোষকামী হয়ে ওঠে।

সেই মেয়েটা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেয় অনেক কিছু।

সেই মেয়েটা সন্তানের ভবিষ্যতে খুঁজে ফেরে নিজের চুরি হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে।

সেই মেয়েটা ধীরে ধীরে ভিড়ের মাঝেও একা হয়ে যায়।

সেই মেয়েটা হতে পারো তুমি। সেই মেয়েটা হতে পারি আমিও। কিংবা আমাদের আগের বা পরের জন্মের কেউ। যে “মেয়ে মানুষ” হয়ে উঠতে চায়নি কখনো। কিন্তু সমাজ যাকে সেটা কখনো ভুলতে দেয় না।

শেয়ার করুন:

সেই মেয়ে মানুষটা হতে চাইনা, জানি কষ্ট হবে সহজে কেউ মানবেনা আমাকে হয়ত করতেও দিবেনা কিন্তু আমিও হার মানবনা। দিনশেষে হাজার লোকের ভিড়ে হাজার লোকের কথা শোনার ভয়ে একলা হওয়ার চেয়ে, নিজের মনের কথা শুনেই নাহয় একলা থাকলাম। জীবনতো একটাই তাইনা?