লীনা হাসিনা হক: গত ১৪ই জুন প্রকাশিত একটি খবরের সূত্র ধরে ভাবছি কেবল। খবরটি ছিল, মাগুরা পুলিশ সুপার স্থানীয় মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা রক্ষা কল্পে গ্রামবাসীদের নিয়ে ‘লাঠি-বাঁশি নিরাপত্তা বাহিনী’ গঠন করেছেন। খবরের সাথে ছবিতে দেখা যাচ্ছে পুলিশ কর্মকর্তা নিজের হাতে বাঁশি তুলে দিচ্ছেন সেই বাহিনীর সদস্যদের হাতে।
আমার মতন অল্পবুদ্ধি মানুষ খবরটি দেখে প্রথম প্রতিক্রিয়াতে খুশি হয়ে গেলাম যে, যাই হোক হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টির গভীরতা আরো ব্যাপক যা নিয়ে প্রাথমিকভাবে চিন্তা করি নাই। বরং বন্ধু, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ফারুখ ফয়সল এর সাথে এ নিয়ে বেশ খানিকটা তর্কাতর্কিও হলো।
আইনবিদ বন্ধু সাইদুর রহমান জানালেন, এটি কোন ভালো উদ্যোগ নয় এবং এটি বেআইনি ও মানবাধিকার বিরোধী একটি পদক্ষেপ। তর্কের খাতিরে তর্ক আমাকে করতেই হলো, যা আমার চিরকালীন অভ্যাস।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁদের বক্তব্য আমার অগভীর ভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আসলেই তো, নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেই দায়িত্বের দায়ভার রাষ্ট্র এড়িয়ে গিয়ে কোনোভাবেই জনগণের কাঁধে ঠেলে দিতে পারে না, তা সে লাঠি হাতে তুলে দিয়েই হোক, কী রাইফেল।
এখন এই যে পুলিশ কর্মকর্তা এই উদ্যোগটি নিলেন, ভালো মন্দ বিবেচনা পরে, আসলে এর আইনগত বিধান আছে কি? সাধারণ নাগরিক কি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নিতে পারে? কেবল লাঠি হাতে আর বাঁশি ফুঁকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়? বা উচিত? যদি যায়ও, সেটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আমার বন্ধুর ভাষায়, এ যেনো ইনফেকশনঘটিত জ্বরের জন্য এন্টিবায়োটিক না খেয়ে প্যারাসিটামলের প্রেসক্রিপশন দেয়া।
জনগণের হাতেই যদি লাঠি তুলে দিতে হয় তাহলে রাষ্ট্র কী করছে বা করবে? খবরে বলা হচ্ছে, যে কোন আক্রমণকারীকে প্রতিহত করতে সক্রিয় থাকবে এই বাহিনী। এলাকার জনগণও সন্তোষ প্রকাশ করছেন এই বিষয়ে। পুলিশের ক্ষমতার ছায়াতলে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা জনগণ না বুঝেই লাফালাফি করবে এটাই সত্য। অতঃপর কি? তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল?
এতোটা সরলীকরণ বোধহয় আমার মতন বেকুব শ্রেণীর মানুষই করতে পারে। এই লাঠি বাহিনীর কেউ যদি তাকে আক্রমণ করতে আসা কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলে তাহলে? করতেই পারে, কারণ তাকে তো রাষ্ট্রকর্তৃক সেই জেলার আইনশৃঙ্খলা জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার নিজের হাতেই বাঁশি তুলে দিচ্ছেন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। লাঠিও দিয়েছেন।
এখন পয়েন্ট হলো, এই যে অফিসার, তিনি কিন্তু রাষ্ট্রের মুখপাত্র সেই জেলায়। সাধারণ হিসাবে আমরা জানি এই লাঠি রাষ্ট্রের লাঠি হিসাবে বিবেচিত হবে সেই এলাকায়। তাহলে তার দেয়া লাঠির ক্ষমতার ব্যাপকতা ধারণা করতে পারি আমরা। কথায় বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত আর এতো লাঠি!
পৃথিবীর কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কি এই রকম নাগরিক লাঠি বাঁশি বাহিনীর অস্তিত্ব আছে? নিজের তৈরি এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে তার স্রষ্টার জন্য ঝুঁকি বয়ে আনবে না সেই গ্যারান্টি তো নাই-ই, বরং উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইতিহাস তাই-ই বলে।
আমি তবু তর্ক করছিলাম যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের তাই এটি একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। সিস্টেম তার কাজ ঠিক মতোন করা শুরু করলেই এটির আর দরকার হবে না।
আমার বন্ধুরা আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন, আসলে একটি নিরাপদ রাষ্ট্রে দেয়ালে ঠেকা পিঠ নিয়ে হাতে লাঠি দরকার, নাকি সামনে পুলিশ প্রয়োজন? রাষ্ট্রের আইন রক্ষাকারী বাহিনীর বিকল্প হিসাবে মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করা কারো জন্যই সুফল বয়ে আনবে না।
যদিও ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত কিনতু উল্লেখ্য যে ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর হয়ে এই একই ভূমিকা পালন করেছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে রক্ষী বাহিনীর ভূমিকাও বিতর্কিত। আশির দশকে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যর্থতা এবং কিছুটা বিতর্কিত ভূমিকার ইতিহাস সবাই জানি।
খবরে আরও প্রকাশ, মাগুরা জেলার আরও কিছু গ্রামে অচিরেই এই বাঁশি-লাঠি নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করবার কাজ চলছে।
লেখাটি লিখতে লিখতেই নজরে এলো পুলিশ অফিসারের স্ত্রী হত্যার বিচার চেয়ে পুলিশের মানব বন্ধন। পুলিশ নিজেই যেখানে পুরো বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার, সেখানে বিচার চেয়ে পুলিশের এই মানব বন্ধন প্রমাণ করছে যে, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সমস্যা প্রবল হয়েছে।
আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি অসফল, এমনকি তারা নিজের পরিবারের নিরাপত্তা বিধানও করতে পারছে না। তাহলে জনগণের করের টাকায় এই ব্যর্থ নিরাপত্তা বাহিনী পুষে আমাদের কী লাভ?
রাষ্ট্র বরং এই বাহিনী সৌদি আরবে ধর্মীয় স্থাপনা রক্ষার কাজে পাঠিয়ে দিক, আর আমরা জনগণ নিজেরা রাষ্ট্রপূর্ব যুগের গোষ্ঠী প্রথায় ফিরে যাই, যেখানে স্ব স্ব গোষ্ঠীর জানমালের নিরাপত্তা বিধান গোষ্ঠীর লাঠিয়াল বাহিনীর কাছে থাকবে। লাঠির সাথে একটি করে ভুভুজেলা বাঁশির ব্যবস্থা করা যাবে, ভুভুজেলার শব্দের অনেক জোর, কানে তালা লেগে যায়, বেশিদিন শুনতে হলে কান বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
তবে গোষ্ঠী প্রধানের জন্য সেটি তেমন সমস্যা হবার কথা নয়, কারণ বাঁশি তো বাজবে অন্যের কান বধির করার জন্য, আমরা না হয় কানে তুলো গুঁজেই থাকলাম!