সন্তান লালন-পালনও শিখতে হয়

লায়লা খন্দকার: “এখন আমি বুঝতে পারি ‘শাস্তি’ আর ‘শৃঙ্খলা’-র জন্য শাসন করা ভিন্ন দু’টি বিষয়। আমরা আমাদের মা-বাবার দেখানো পথ ধরেই সন্তানদের লালন পালন করছি। তারা আমাদেরকে প্রায়ই মারতেন এবং আমরা ভাবতাম এটাই শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখানোর উপায়। যে কারণে এখন আমরা আমাদের সন্তানদের সঙ্গে একই কাজ করছি।

তবে এই প্রশিক্ষণ থেকে শাস্তি আর শৃঙ্খলার পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি। আমরা আসলে সন্তানদের শৃঙ্খলা শেখাচ্ছি না, তাদেরকে শাস্তি দিচ্ছি। ফলে কখনো কখনো তারা শাস্তির ভয়ে আমাদের কাছ থেকে পালিয়ে যায়। আগে শৃঙ্খলা শেখানোর অন্য কোনো কৌশল জানা ছিল না। এখন জেনেছি, ফলে আমাদের কাজে পরিবর্তন আসবে।”

Lailaকথাগুলো বলেছেন লাইবেরিয়াতে অনুষ্ঠিত পজিটিভ ডিসিপ্লিন ইন এভরিডে প্যারেন্টিং প্রশিক্ষণের একজন অংশগ্রহণকারী। আমি একই ধরনের কথা অন্য আরো অনেক দেশে শুনেছি, এমনকি বাংলাদেশেও।

শিশুরা বাড়িতে, বিদ্যালয়ে, প্রতিষ্ঠানে তাদের মা-বাবা, শিক্ষক ও দেখভালকারীদের কাছ থেকে উচ্চমাত্রার সহিংতার মুখোমুখি হয়।

গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, শারীরিক শাস্তি মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ককে নষ্ট করে, শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শিশুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা ও সহিংসতা দেখা দেয়। শিশুরা যখন তাদের সবচেয়ে আপনজনের (মা-বাবা) কাছ থেকে সহিংসতার মুখোমুখি হয়, তখন তারা একইভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষদের প্রতি সহিংস হওয়া শেখে।

শিশুদের শাস্তি দেয় এমন প্রাপ্তবয়স্কদের অনেকের শৈশবে একইভাবে নির্যাতিত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু শিশু নির্যাতনের ক্ষতিকর এই চক্র এভাবে চলতে দেওয়া যায় না, এটি অবশ্যই থামানো দরকার।

সাধারণভাবে আমরা লক্ষ করি সন্তান লালন-পালনে দুই ধরনের চরম ঘটনা ঘটে।

এক. কেউ কেউ শিশুর সকল চাহিদাকে ”হ্যাঁ” বলেন, এমনকি শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষা করবে কিনা সেটি পর্যন্ত বিবেচনায় নেন না।

দুই. কেউ কেউ শিশুদের মতামতের তোয়াক্কা না করে শিশুদের উপর নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেন।

দ্বিতীয় দলভুক্তরা মনে করেন যে শিশুদের প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা দেখালে শিশুরা “নষ্ট” হয়ে যাবে। এজন্য তারা শিশুদের ব্যাপারে খুব “কঠোর” থাকেন।

এসবই ধারণাপ্রসূত বিষয়, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত ৩০ বছর ধরে সন্তানের লালন-পালনের উপর পরিচালিত শতাধিক গবেষণা থেকে দু’টো মূল বিষয় জানা যায়, শিশুদের ভালোবাসা ও উষ্ণতাপূর্ণ পরিবেশে রাখা দরকার এবং তাদের শেখার জন্য কাঠামো থাকা দরকার।

শিশুদের সাফল্য লাভের সম্ভাবনা বেড়ে যায় যখন তাদের মা-বাবা শিশুর বিকাশের স্তরগুলো সম্পর্কে জানেন এবং বিকাশের স্তরের সঙ্গে শিশুর আচরণের সম্পর্কগুলো বুঝতে পারেন; নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং সন্তান লালন পালনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হন। প্রশ্ন হলো: আমরা কতোজন সন্তান লালন-পালনে আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি?

পজিটিভ ডিসিপ্লিন বা ইতিবাচক শৃঙ্খলা কার্যক্রমকে সাজানো হয়েছে একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজাকে কেন্দ্র করে, “সন্তানকে আঘাত না করে আমরা অন্য কী করতে পারি?” এই ধারণার প্রবর্তক হলেন শিশু বিষয়ক বিশিষ্ট ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যামিলি সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. জোয়ান ডুরান্ট। তিনি সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতায় এই কাজটি করেছেন।

এই কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের সুস্থ বিকাশ ও কার্যকর সন্তান লালন-পালন এবং শিশু অধিকারের নীতিমালাকে একত্রিত করা হয়েছে, যাতে শৃঙ্খলার প্রয়োজনে শিশুর মা-বাবা ও যত্নকারীরা একটি ইতিবাচক কাঠামোর মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন।

ইতিবাচক শৃঙ্খলা কার্যক্রমের মাধ্যমে মা-বাবা বিভিন্ন বয়সে শিশুরা কীভাবে চিন্তা করে ও তাদের অনুভূতি কেমন হয় সেটা বুঝতে ও জানতে পারেন। এমনিতে শিশুর বিকাশ সম্পর্কে বেশিরভাগ মা-বাবার ধারণা সীমিত। যেকারণে শিশুদের সঙ্গে তাদের বিরোধ ঘটে। যেমন ধরুন, কোন এক শীতকালে মা-বাবা তাদের তিন বছরের শিশু সন্তানকে বকাঝকা করছে কারণ শিশুটি বাইরে যাওয়ার জন্য গরম কাপড় পরতে চাচ্ছে না। অথচ ওই বয়সের শিশু জানেই না যে, গরম কাপড় না পরলে তার ঠাণ্ডা লাগতে পারে।

ইতিবাচক শৃঙ্খলা কার্যক্রম এই ধরনের পরিস্থিতিতে মা-বাবার করণীয় সম্পর্কে সচেতন করা হয় যাতে করে তারা সন্তান লালন-পালনে একটি “উষ্ণতাপূর্ণ” পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় “কাঠামো” গড়ে তুলতে পারেন।

উষ্ণতাপূর্ণ পরিবেশের মানে হলো সন্তানের সঙ্গে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা। কাঠামো হলো তথ্য, দিক নির্দেশনা ও শিক্ষাদান, যা সম্পূর্ণরূপে শাস্তি ও নিয়ন্ত্রণ থেকে ভিন্ন। ইতিবাচক শৃঙ্খলা কার্যক্রমের কৌশলগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে মা-বাবা পরিস্থিতি অনুযায়ী উপযুক্ত সমাধান খুঁজে পেতে পারেন। যা তাদেরকে সন্তান লালন -পালনের “দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য” অর্জন অর্থাৎ নিজেদের চাওয়ার মতো করে সন্তানকে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। পাশাপাশি চিৎকার চেঁচামেচি কিংবা বকাঝকা ছাড়াও তারা প্রতিদিনকার সন্তান লালন-পালনের কাজটি সারতে পারেন।

কারণ পজিটিভ ডিসিপ্লিন কার্যক্রম মা-বাবার দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করার প্রয়োজনীয় জ্ঞান দিয়ে থাকে।

পজিটিভ ডিসিপ্লিনের মৌলিক ভিত্তি দু’টি- শিশুদের সকল ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদ। শিশু অধিকার নিয়ে কারো কারো মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে।

তারা মনে করেন শিশুদের অধিকার দেওয়া মানে মা-বাবার কর্তৃত্ব না থাকা। প্রকৃতপক্ষে শিশু অধিকার সনদে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অভিভাবকদের নির্দেশনার গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সনদের ৫ ধারায় বলা হয়েছে: ”শিশু যাতে এই সনদে স্বীকৃত অধিকারগুলো প্রয়োগ করতে পারে সেজন্য তার ক্রমশ বাড়তে থাকা সামর্থ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাকে উপযুক্ত দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য শরিক রাষ্ট্রগুলো শিশুর মা-বাবা কিংবা যেখানে প্রয়োজন, দেশাচার অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত বৃহত্তর পরিবার বা সমাজের সদস্য, আইনগত অভিভাবক বা আইনানুগভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য যেকোনো ব্যক্তির দায়িত্ব, অধিকার বা কর্তব্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।”

আজকাল আমি অনেক অভিভাবকের কাছ থেকে তাদের কিশোর বয়সী ছেলেমেয়ের ব্যাপারে অভিযোগ শুনি যে, তারা ইন্টারনেটে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। মা-বাবার দায়িত্ব হলো সন্তানদের জীবনের জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদেরকে জানানো। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া।

শিশু সন্তানেরা কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে সেই বিষয়টিও তাদেরকে মা-বাবা কিংবা অভিভাবকরা জানাবেন।

সন্তান লালন-পালন করা যে শেখার বিষয়, এটি যে আপনাআপনি হয় না সে ব্যাপারে এখনো সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, সন্তানের মা-বাবা হওয়া মানেই সন্তান লালন পালনের দক্ষতা অর্জন করা নয়। কার্যকরভাবে সন্তান পালন করা শিখতে হয়।

সন্তানকে বড় করে তোলা, তাকে দরকারি তথ্য দিয়ে সহায়তা করা এবং তার জন্য একটি সফল জীবনের ভিত রচনা করে দেওয়া সহজ কাজ নয়। সন্তান লালন-পালনে এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যখন মা-বাবা বিচলিত হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় সন্তান লালন পালনের কৌশলগুলো শেখা ভালো।

আজকাল সন্তান লালন-পালনের কৌশল জানার ও শেখার অনেক ব্যবস্থা রয়েছে। আমি মনে করি বর্তমান ও আগামীর সব মা-বাবার জন্য সন্তান লালন পালন করার কৌশল শেখানোর জন্য সরকারের দিক থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।

লায়লা খন্দকার: পরিচালক, চাইল্ড প্রটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন

 

শেয়ার করুন: