শাশ্বতী বিপ্লব: টিপ টিপ বৃষ্টিটাকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছে করলো মালার। অফিস থেকে বেরিয়েছে সাড়ে তিনটায়। এখন বাজে প্রায় পাঁচটা। এখনো একটা সিএনজি ম্যানেজ করতে পারেনি মালা।
অনেকক্ষণ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে হাঁটতে শুরু করেছে মালা। খালি সিএনজি নেই বললেই চলে। একটা দুইটা পাওয়া গেলেও তারা মিটারে যেতে রাজি হয় না। দুশো টাকার ভাড়া চারশো চায়। মালা নিরুপায় হয়ে হাঁটা শুরু করেছে। কিন্তু কতক্ষণ? সাথে ছাতা নেই, তার উপর রোজা রেখেছে। হাঁটতে ক্লান্ত লাগছে মালার।
আজ প্রথম রোজা। বাসায় গিয়ে ইফতারি গোছাতে হবে। সকালে ছোলা আর ডাল ভিজিয়ে এসেছে সে। কখন বাসায় পৌঁছাবে আর কখন সব গোছাবে ভেবে মালার অস্থির লাগতে থাকে।

ব্যাগের ভেতর মোবাইলটা নাছোড়বান্দার মতো বাজতেই থাকে। ফোনটা ধরে না সে। শামীম কল করেছে, মালা জানে। প্রতি দশ মিনিটে একবার ফোন করছে শামীম। ফোন ধরলেই হতাশ গলায় বলছে, “এখনো গুলশানে কি করছো তুমি!!”
মালার আর উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না। ক্লান্ত লাগে। শামীমের অফিস ফার্মগেটে। গুলশানের ভয়াবহ জ্যাম তাকে পোহাতে হয় না। শামীম আজ সাড়ে চারটার মধ্যে বাসায় পৌঁছে গেছে। মালা না পৌঁছানো পর্যন্ত সে দশ মিনিট পর পর কল করতেই থাকবে।
রাস্তার ওপাশে একটা খালি সিএনজি দেখতে পেয়ে মালা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। কেউ নিয়ে ফেলার আগেই তাকে সিএনজির কাছে পৌঁছাতে হবে। সিএনজির উপর রীতিমতো হামলে পড়লো মালা। সাড়ে তিনশ, তাই সই। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। সংযমের শুরুতে কি বেমক্কা খরচ হয়ে গেলো সময় আর টাকা। মেজাজটাই বিগড়ে গেছে।
মোটামুটি ছয়টায় আধভেজা হয়ে বাসায় ফিরতে পারলো মালা। কোন রকমে ব্যাগটা রেখে রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। মালার দেরী দেখে শামীম হালিম আর জিলাপী কিনে এনেছে। লেবুর শরবত বানিয়ে ফ্রিজে রেখেছে। এবার মালার সাথে রান্নাঘরে হাত লাগালো।
শামীমের দিকে তাকিয়ে মালার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। তাদের সংসারে অনেক কিছুর অভাব আছে। শুধু অভাব নেই সহমর্মিতার। শামীম আর দশটা ছেলের মতো নয় বলে অভাবের কষ্টটা মালার গায়ে লাগে না। মালার ক্লান্তিকে শামীম বুঝতে চেষ্টা করে।
অফিসের সহকর্মীরা একারণে মালাকে হিংসা করে। কিছু বললেই বলে, “আপনি বুঝবেন না। আপনার তো আর আমাদের মতো সারাদিন কথা শুনতে হয় না।”
মালা সবটাই বোঝে। সে তার নিজের মায়ের কষ্টের জীবন দেখেছে। মা একটি বেসরকারী সংস্থায় কাজ করতেন। সেটা নিয়ে বাবার অভিযোগের অন্ত ছিলো না। অথচ তাদের তিনবোনের প্রাইভেট পড়া, ছোটখাটো আবদার সব মায়ের আয় থেকেই মিটতো।
বাবার কাছে কখনো কোন আবদার করার সাহস পেতো না তারা তিন বোন। ভাই না থাকার অপরাধের সাথে যোগ হয়েছিলো মায়ের চাকরি করার অপরাধ।
সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করেও কখনো বাবার মন পায়নি তার মা। বাবা কখনোই সন্তুষ্ট হতো না। সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে অভিযোগ লেগেই থাকতো। পান থেকে চুন খসলেই সব দোষ গিয়ে পড়তো মায়ের চাকরির উপর। তারা তিনবোন আর মা সবসময় অজানা অপরাধের দায় নিয়ে মুখ বুঁজে থাকতো।
মালার নিজের জীবনটা একইরকম হতে পারতো। কিন্তু হয়নি শামীমের জন্য। যে যাই বলুক, মালা জানে সময় বদলাচ্ছে। মালা সারাজীবন এমন একজন জীবনসঙ্গী কামনা করেছে যে তাকে বুঝতে পারবে। তার কাজকে, যোগ্যতাকে সম্মান করবে। আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা সে খুব একটা কখনোই ভাবেনি।
মালা ভাগ্যবান। নিজের পছন্দে বিয়ে করে সে ঠকেনি। শামীমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আর এক অপূর্ব ভালো লাগায় মালার মন ভরে গেলো। মালা, শামীম আর তাদের ফুটফুটে দুই রাজকন্যা হাসি মুখে টেবিলে গোল হয়ে বসে গেল। ইফতারের আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই মালার।
০৭ জুন ২০১৬