রান্নাঘর বনাম পৌরুষের সম্মান

বিথী হক: আমার ভাই আমার চেয়ে ভাল রান্না করে। বিষয়টা আমি রান্না ভাল পারি না বলে যতোটা না লজ্জাজনক, তার চেয়ে বেশি লজ্জাজনক হচ্ছে আমার ভাইকে ছেলেমানুষ হওয়া সত্ত্বেও রান্না করতে দেই!

ভাই এর রান্নার শখ। সে প্রায়ই নতুন নতুন রেসিপি আবিষ্কার করে, রান্না করে আমাকে খাওয়ায়। আমিও বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাই। সেদিন দুপুরে ভাই জিজ্ঞেস করলো, পুরি খাবো কিনা? আমি কাজের ভেতর থাকায়, না শুনেই হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ালাম। কিছুক্ষণ পর আমার কম্পিউটার টেবিলের সামনে গরম গরম আলু পুরি, টমেটো সস দেখে খেতে খেতে কাজ করা শুরু করলাম। সে অনেকক্ষণ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

Cook 1আবার ফেরত এসে জিজ্ঞেস করলো, আমার কেমন লাগলো? আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মোড়ের দোকান থেকে এনেছ!’

ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে জানালো, এটা তার বানানো, অথচ আমি তাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিচ্ছি না! আমি চোখ কপালে তুলে জানতে চাইলাম ‘সিরিয়াসলি?’ এই গেল একটা উদাহরণ। গরুর মাংস, পোলাও, ফ্রাইড রাইস, রোল থেকে শুরু করে হেন কিছু নাই যেটা সে আমার চেয়ে ভাল করে না!

ভাই আমার থেকে সাড়ে চার বছরের ছোট। ছোটবেলা থেকে আমাদের দু’জনের আচরণে বিশাল ফারাক। আমার যেসব কাজ ভাল লাগে, যা কিছুতে আনন্দ পাই প্রচলিত সমাজে সেগুলো ছেলেদের কাজ বলে পরিচিত, আর ভাই যেসব কাজ করে বা করতে পছন্দ করে সেগুলো মেয়েদের কাজ বলে পরিচিত।

মা অসুস্থ হলে আমি পাশে বসে বসে কাঁদতাম। মা’র সুস্থতার জন্য তো অবশ্যই, পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্যও মাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ দরকার। কখনো আমার মাথায় আসেনি, আমিই রান্না করে খেতে পারি; এটা তো এমন কোন কাজ নয়।

ভাই আমার পুরোপুরি বিপরীত। সে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই মা অসুস্থ হলে নিজে রান্না করতো, মাকে খাওয়াতো, নিজে খেতো, আমাকে খাওয়াতো, তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করে স্কুলে যেত।

আমার ঘরে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যায়, বাইরে না বেরুলে মনে হয় মরে যাচ্ছি। রান্নাঘরে গেলে মশলার ঝাঁঝে হাঁচি দিতে থাকি, ঝাড়ু দিলে ডাস্ট এলার্জির সমস্যা শুরু হয়ে যায়, কোমর ব্যথায় পাক্কা দু’দিন বিছানায় পড়ে থাকি।

ভাই এর সেসব সমস্যা নাই। আমি সারাদিন বাইরে কাজ করি, অফিসে থাকি। কাজের লোক না থাকলে সে দিব্যি বাসার সব কাজ করে, রান্না করে। সকালবেলা আমার বেশি দেরি হলে না খেয়ে বের হতে গেলে সে নিজের হাতে তুলে আমাকে খাইয়েও দেয়। এতে আমরা দু’ ভাই-বোনের বা আমার পরিবারের সদস্যদের কোন সম্মানহানি না হলেও বাইরের মানুষ এসব দেখলে তাদের আত্মসম্মানে লাগে।

Bithy 3
বিথী হক

এই ভয়ানক সমাজ উল্টানো বিষয়টা নিয়ে বড়রা, বিশেষত বয়স্ক মুরুব্বি আন্টিরা এবং তাদের বাড়ির বউরা আমাকে খোঁচা মেরে কথা বলেন। যেন আমার বাড়ির বাইরের, অফিসের কাজ যতোই গুরুত্বপূর্ণ হোক, বাসার রান্নাবান্নার কাজ শেষ না হলে সেসব করা উচিত নয়। আমার ভাই এর কোনো কাজ না থাকলেও তার এসব করা যাবে না, ঘরের কাজ তার ডিপার্টমেন্ট না!

আহা! তাদের ঘরের পুরুষরা কী গর্ব করে বলে, সে কখনো একটা প্লেট ধুয়েও খায়নি! রান্না তো বহুত দূর কী বাত, হাহ হা !

ঠিক তো, এই মানসিকতা পরিবারের পুরুষ সিংহ এবং দাসী-বাঁদিদের যুগপৎ চিন্তার সমন্বয়। তারা যদি চান ছেলেরা তাদের রান্না করাকে অসম্মানের কাজ ভাবুক, ছেলেদের পৌরুষ রান্না না জানার মধ্যেই পূর্ণতা পাওয়া উচিত, তবে আপনার-আমার কীই বা করার থাকতে পারে?

এসব অপমানজনক খোঁচানিতে আমার ভাবান্তর না হলেও আমার ভাই মানসিকভাবে কিছুটা বদলে যেতে শুরু করছিল। আমি যতোই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি না কেন, বাসার কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে রীতিমতো টানা-হেঁচড়া করে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে আমার হাতে খুন্তি ধরিয়ে দিয়ে নিজে বই হাতে নিয়ে তারপর দরজা খোলা শুরু করলো।

শুরুতে দু’একদিন কিছু না বুঝেই রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থেকে বাসা থেকে মানুষজন বিদায় হলে আবার কাজ করতে বসতাম। কিন্তু প্রকট হলো সেদিন, যেদিন প্রজেক্টের ছবি জমা দেয়ার জন্য রাত ১০টার মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে, আর ভাই সাড়ে ন’টায় এসে টানা-হেঁচড়া শুরু করলো।

আমি শুধু বিরক্তই হইনি, মেজাজ খারাপ করে ধমক দিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলাম। এবং কারণ শুনে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম, এই অসভ্য মানুষজন আর তাদের মানসিকতার সঙ্গে ডিল করার চেয়ে একা থাকাই ভালো। নিজেরা পরিবারের নারীদের দাসী-বাঁদি ভাববে এবং সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষ না ভাবলেও জোর করে ভাবতে বাধ্য করবে!

এরপর আসি সমাজের অতি উচ্চ শিক্ষিত পতি-পরমেশ্বরদের কথায়। তারা নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করাকে সমর্থন করেন, সালোয়ার কামিজ বা জিন্স পরাকে আরামদায়ক হিসেবে মেনে নিতে পারেন, পুরুষ কলিগদের সঙ্গে স্ত্রীর নিরাপদ দূরত্বে থেকে কাজ করাকে উৎসাহ দেন, কিন্তু একসঙ্গে অফিস থেকে বাসায় ফিরলেও স্ত্রীর সাথে একসঙ্গে কাজ করাকে সমর্থন করেন না।

রান্নাঘরে যাওয়া মানে বন্ধু-বান্ধবের কাছে তারা ‘স্ত্রৈণ’। ইজ্জতের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হওয়া এই শব্দ তারা শুনতে চান না। তারা মুখে স্বীকার না করলেও এটা সত্যি যে রান্নাঘর তাদের কাছে সতীত্ব হারানোর মতই গুরুতর বিষয়!

নারীগণ যা খুশি করতে পারেন, স্বাধীনতা তো আছেই; শুধু রান্নাঘরে পুরুষদের না ডাকলেই কি নয়? পুরুষরা যেমন নারীদের কথা চিন্তা করে, নারী ক্ষমতায়নকে শুভ দৃষ্টি দিয়ে দেখে এত ত্যাগী হচ্ছেন, নারীদেরও উচিত স্বামীদের এবং ঘরের পুরুষদের পৌরুষের সম্মান বাঁচাতে রান্নাঘরের মতো অসম্মানজনক স্থানে তাদের প্রবেশাধিকার সিলগালা করে দেয়া! পৌরুষের সম্মান সর্বাগ্রে।

আর আমার ভাইয়ের মতো মানুষরা চিরকাল তাদের বোনের পাশে, বউ এর পাশে, মা’র পাশে দাঁড়িয়ে হাতে হাত লাগিয়ে রান্না করুক।   

 

শেয়ার করুন:

Salute to your brother. He has learnt good skills, very caring for the family, and on top of that, he enjoys it too! Good for him! You, on the other hand, seem to be a lazy one. According to your own admission, you do not take much part in household work, or care about the care you are getting from the family members. Much like the proud males of other families you happily disparaged.

আমি সব কাজ পারি এবং সময় পেলে করি। কিন্তু নিজের কাজের জন্য সারাদিনই বাসার বাইরে থাকার দরুন সাংসারিক কাজ তেমন একটা করা হয়না। সর্বোপরি, আমি সাংসারিক কাজের চেয়ে বাইরের কাজ বেশি উপভোগ করি। মেয়ে বলে যে আমার কাছে সাংসারিক কাজই প্রাধান্য পাবে এমন ভাবনায় আমার তাচ্ছিল্য। আমি সব কাজ পারি, কিন্তু করি যেটা আমার ভাল লাগে। আমার কি ভাল লাগাবে তার পূর্ণ স্বাধীনতা ভাল লাগার। ধন্যবাদ
🙂