বিথী হক: কোনো এক অজানা কারণে এখানে পুরুষদের সব কর্মকাণ্ডের অলিখিত বৈধতা আছে, কিন্তু নারীদের ভাল কাজকেও অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। পুরুষরা রাস্তার মোড়ে লুঙ্গি তুলে, উরু দেখিয়ে, পেট চুলকাতে চুলকাতে পান খেয়ে ঢেকুর তুলে রসিয়ে রসিয়ে নারীবন্দনা করতে পারেন। তারা পৃথিবীর যে কোনোখান থেকে সিগারেট, মদ, গাঁজা, কনডম কিনতে পারেন।
ওয়ান কোয়ার্টার, টু-কোয়ার্টার, থ্রি-কোয়ার্টার, স্যান্ডো গেঞ্জি, গেঞ্জি, শার্ট সব পরে রাস্তায় বের হতে পারেন। পাবলিক বাসে উঠে যেকোনো সিটে বসে ধপাস করে বসে পড়তে পারেন। যখন খুশি তখন বাড়ি থেকে বের হতে পারেন, একলা বের হচ্ছেন নাকি সঙ্গে বড় ভাই/ছোট ভাই যাচ্ছেন সেসবের গুরুত্ব নাই। যত খুশি তত প্রেম করতে পারেন, সবাই জানে, ছেলেরা একটু আধটু ওরকম হবেই, তারা ইভটিজিংও করতে পারেন। তাদের যেভাবে খুশি বনে, জঙ্গলে, ট্রামে, বাসে, নৌকায়, রিকসায়, বিছানায় তারা যে কাউকে নিয়ে পড়ে যেতে পারেন। ছেলেরা তো এমনই, মেয়েরা ভালভাবে রাখঢাক করে চললেই হয়।
বউ এর রান্না পছন্দ না হলে বাটি ছুঁড়ে বউকে আহত করার অধিকারও পুরুষরা ভ্রুণাবস্থায় সেক্স অরগ্যান ডেভেলপ করার সময়ই পেয়ে যায় আর নারীদের পৃথিবীতে পাঠানোই হয়েছে এক পতি দেবের সেবা আর বাচ্চা উৎপাদনের জন্য। তারা বাচ্চা নেয়ার জন্য শারীরিক, মানসিকভাবে কতটা তৈরি সেসব কেয়ার করলে কি আর পৃথিবী চলে?
কর্তা যখন যেটা বলবেন সেটাই শিরোধার্য, কোন কথা হবে না। সুতরাং বাচ্চাকাচ্চা পালার দায়িত্বও নিশ্চয়ই বাবাদের মানায় না, দু’য়েকটা ডায়াপার বদলানো বা ফিডার খাওয়ানো হলে সেটা অবশ্য ভিন্ন কথা। বউ যতই যা করুক হেঁসেল না ঠেললে, পাতিল না সামলালে, বাচ্চা না সামলালে কিসের তার নারীত্ব! সংসার ধর্ম বড় ধর্ম, বাকি সব উচ্ছন্নে খারাপ ছেলে যদি সমাজ কর্তৃক নিগৃহীত না হয় তবে তথাকথিত খারাপ মেয়েরা সমাজে থাকবে এটাও স্বাভাবিকভাবেই নেয়ার কথা।
কিন্তু না, খারাপ মেয়েরা সিগারেট কিনতে গেলে দোকানিসহ অত্র এলাকার মানুষজন তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসবেন। ভাবখানা এমন যেন আপনি আমার দোকানে সিগারেট কিনতে এসেছেন, আপনি মেয়ে হয়েও সিগারেট খান এটা কিন্তু আমি জানি।
খারাপ মেয়েরা মদ খেতেই পারে, খারাপ ছেলেরা যেমন খায় । কিন্তু ছেলেরা মদ খেয়ে মাতাল হলে এমন কিছু না, যেন এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম আর মেয়েরা খেলেই জাহান্নামের কীট, বেশ্যা মাগী! তারা স্লিভলেস পরে বাইরে বের হতে চাইলেও সমস্যা, বিশাল সমস্যা । বাইরের মানুষ হাত দেখলে ইজ্জত চলে যাবে, মানুষে উগ্র বলবে, ভদ্র ঘরের মেয়েরা এসব কাপড়-চোপড় পরেন না ইত্যাদি।
অনেক সভ্য মানুষকেও দেখলাম তাদের বউ, গার্লফ্রেন্ডদের স্লিভলেস নিয়ে আপত্তি। মেয়েরা পাবলিক বাসে ওঠামাত্র কন্ডাক্টর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেন, আপা সামনে সিট ফাঁকা আছে, সেখানে বসেন; কই একথা তো কখনো কোনো ছেলেকে বলতে শুনি না।
একজন পুরুষ রাত ১২ টায় মাতাল হয়ে বাসায় ঢুকলেও সমাজের মাথামুন্ডু ঠিকঠাক থাকে কিন্তু একজন নারী অফিস শেষে রাত ১০ টায় বাসায় ফিরলেও আশেপাশের মানুষের চোখ দেখে মনে হয়, আহারে, কাস্টমার সামলে এতোক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো?
আসলে সমস্যাটা কোথায়? রাত করে বাড়ি ফেরা খারাপ? তাহলে ছেলেদেরও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেন না, সমস্যাটা কোথায়? সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়া খারাপ অভ্যাস? তাহলে ছেলেরা খেলেও সেভাবেই তাকান, যেভাবে একটা মেয়ের দিকে তাকান ।
সমস্যাটা কোথায়? একটা মেয়ে ন্যাপকিন, কনডম কিনছে সেটা? নাকি ন্যাপকিন, কনডম কেনা খারাপ?
সমস্যাটা কোথায়? রান্না না জানা ? নাকি মেয়েদের রান্না না জানা? অনেক ছেলেরা যেমন রান্না জানে না, তেমনি অনেক মেয়েরাও নাই জানতে পারে! সমস্যা হচ্ছে, আমরা যে সমাজে বাস করি তা মোটেই নারীবান্ধব নয়। নারীরা ভালো কাজ করছে, নাকি খারাপ কাজ করছে, তার চেয়ে বড় ব্যাপার তারা নারী।
স্ত্রীলিঙ্গের কাছে একজন নারীর জ্ঞান, বুদ্ধি, গরিমা, আত্মসম্মান, ভালো কাজ, আবিষ্কার, মেধা সবকিছু পুরুষতন্ত্রের স্বত:স্ফূর্ত পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিমুহুর্ত হেরে যায়। তাতে মানবতার তেমন ক্ষতিসাধন না হলেও নারীরা সচেতনভাবে স্বাধিকার আন্দোলনের কথা বললেই মানবতা ধ্বংসের মুখে পড়ে, একমাত্র পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রেরই এই ধ্বংস ঠেকানোর দায়।