মৌসুমী বিশ্বাস: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় পড়েছিলাম, “অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। সে এখন অন্ধকার এক ছাপাখানায় কাজ করে”। আমি রোদ্দুর হতে চাইনি, কিন্তু প্রবলভাবে অমলকান্তির মতো হতে চেয়েছিলাম। কারণ তার জীবনবোধ আমাকে ব্যাকুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। তখনও মনে হতো এবং আজ এখনও মনে হয়, ইস্ একবার যদি অমলকান্তি হওয়া যেতো!
সুদিন আসবে বলে যারা অপেক্ষায় বসে থাকে, আমি বরাবরই তাদের দলে নই। প্রতিটি দিনযাপনের একটি ভিন্ন অর্থ থাকে এবং তাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও মানুষের থাকে। ভীষণ মন খারাপের দিনে দেখা গেল অমলকান্তির মতো একটা কবিতা পড়ে মন ভালো হয়ে গেছে।
অথবা কখনও এমন হয়েছে যে, রাস্তায় প্রবল উচ্ছাসে কাউকে হাসতে দেখে ভালোলাগা বোধটা নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে।
একদিন অফিস যাবো সকালে। কোনো যানবাহন নেই। সিএনজি পাবার আশায় হাঁটতে হাঁটতে শ্যামলী পর্যন্ত চলে গেলাম। প্রচণ্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার, সেইসাথে সময়মত অফিস পৌঁছুতে না পারার উদ্বেগ।
ঘড়ির কাঁটা তখন ৮.১০ ছাড়িয়েছে। আমি রাস্তা পার হয়ে অন্যপাশে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং রাস্তা পার হয়ে উল্টা দিকে চলেও গেছি। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম রাস্তার এইপাশে এক অতিবৃদ্ধা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তা পার হতে না পেরে।

পাশে দাঁড়ানো এক ছেলেকে বললেন মনে হয়, ‘বাবা, রাস্তাটা একটু পার করে দিবে’? ছেলেটি উত্তর না দিয়ে চলে গেলো অন্যদিকে। আমাদের বর্তমান নগর সভ্যতার (!) একটি অংশ হচ্ছে, দেখেও সবকিছু উপেক্ষা করে যাওয়া। আমিও যথারীতি উপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এইসব মুহুর্তে সাধারণত আমরা যা ভেবে থাকি, সেটাই ভাবলাম (সব মানুষের দায় তো আমার নয়, আমার কাজ আছে, সময়মতো অফিস পৌঁছানোর জবাবদিহিতা আছে)। কিন্তু সিএনজি খোঁজার সাথে সাথে চোখ বারবার বৃদ্ধার দিকেই টানছে। প্রত্যেক মানুষের ভেতর বিবেক বলে যে শব্দটির বসবাস সেটিকে সবসময় উপেক্ষা করা যায় না দেখেই এই গোলার্ধে আমরা অন্য প্রাণী থেকে আলাদা।
আমার মনে হলো, কী আর এমন হবে একদিন দেরি হলে অফিসের। আমি আবার রাস্তা পার হয়ে এপারে এলাম, ওনাকে সঙ্গে নিয়ে হাত ধরে আমরা একসাথে রাস্তা পার হলাম।
বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’ নামে একটা কবিতা আছে। পড়লেই একধরনের শান্তি শান্তি লাগে। সেখানে একটা লাইন আছে, খুব গভীরভাবে লেখা “আজ এই সকালবেলা কি যে ভালো লাগলো আমার”! আমার নিজের অবস্থাটা তখন অনেকটা ওইরকম।
ঊনি বললেন, “মা, প্রায় একঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি, কতজনকে বললাম কারো সময় হলো না। আমি চোখে দেখি না, অন্ধ। কিন্তু জগতের মানুষগুলো তো অন্ধ নয়, তারা কেন দেখতে পায় না”। আমি আবেগ আপ্লুত হলাম।
মনে হলো, দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপকও এই কথা এই উপলদ্ধি দিয়ে বলতে পারবেন না। বিস্ময়ের সীমা ছাড়ালো তখন, যখন এক’শ টাকার একটা নোট তার হাতে দিতে গেলাম। তখন ঊনি বললেন, ‘আপনার কাছ থেকে টাকা নিবো না মা, আপনি রাস্তা পার করে দিয়েছেন এটাই অনেক। আমি তো তিন বেলা খেতে পাই।’
পুরনো কথাটা আবার মনে এলো; শেখার কোন শেষ নেই। এই ঘটনা কখনো বলা হয়নি কাউকে, কিন্তু শিক্ষাটাকে আমি মনে রেখেছি- প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনকিছুই আমাদের দরকার নেই; এমনকি, দায়-দায়িত্ব, ভালোবাসাও। আমাদের সীমাহীন চাওয়া থেকেই (চেতন বা অবচেতনে) সকল অতৃপ্তির জন্ম হয়। আমরা ভালো থাকতে পারি না।
কর্মজীবন শুরুর সময়ের বেশিরভাগই আমাদের ঢাকার বাইরে যেতে হতো। মাসের হাতে গোনা কয়েকদিন হয়তো ঢাকাতে থাকতাম। ফলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো সেইভাবে আর উদযাপন করা হতো না। জীবনযাপনে বাধ্যবাধকতা তখন থেকেই মূলতঃ শুরু। এরকমই এক দিনে ছিল সহকর্মী বন্ধুটির জন্মদিন এবং সেই সময় আমরা কোনো এক গ্রামে স্কুল ভিজিটে গিয়েছি। খুব মনে হচ্ছিল কিছু একটা করতে পারলে ভালো লাগতো। হঠাৎ চোখ পড়লো গাছ ভর্তি কদম ফুলের দিকে। তখন ঘোর বর্ষা নামা দিন। ভাবা মাত্রই কার্য সিদ্ধি হলো। স্থানীয় দুই কিশোরকে ওঠানো হলো কদম গাছে এবং গাছের মোটামুটি অর্ধেক ফুল জন্মদিনের উপহার হিসাবে হাজির করা হলো মানুষটির সামনে।
আমি আজ সত্যিই জানি না, এই ঘটনা তার মনে আছে কীনা, কিন্তু সেদিনে তার সেই বিস্ময়, আনন্দ ও মুগ্ধতা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।
খুবই সামান্য একটি ঘটনা, কিন্তু অসামান্য আনন্দময় মুহুর্ত। জীবনে বহুবার বহুক্ষেত্রে এইসব ছোট ছোট অসামান্য মুহুর্ত কাটিয়েছি। সামান্য বাদাম কিংবা কমলালেবুর খোসা বেছে খাওয়ার মধ্যেও একধরনের গভীর আনন্দ আছে, আছে প্রবল জীবনবোধ। আমি সেই জীবনবোধে বিশ্বাসী এক মানুষ।
আপনি রোদ্দুর হতে চাননি…কিন্তু রোদ্দুরকে আপনি পেয়েছেন!!!
জীবনবোধে বিশ্বাশী মানুষেরা এসো জোট বাঁধি। এমন লেখা পড়া এবং সেখান থেকে বোধের জন্ম দেয়া সকলের হয় না, এর জন্যও আলাদা বোধ বা মন লাগে। এমন লেখা আরো আরো চাই, আমিও লিখতে চাই, আমারও এমন হাজার গল্প আছে, লিখবো কোথায়, কিভাবে?
ঝুনু আপা, তুমিও লেখো। এখানেই লেখো। আমি ছাপাবো। – সুপ্রীতি
আপনি ও আপনার লেখা এমনি হবার কথা ছিল,লিখে যান ভাল থাকুন।
এই সাত সকালে মৌসুমী বিশ্বসের ভালো থাকার গল্প পড়ে আমিও গভীরভাবে আপ্লুত। আসলেই আমাদের সময় নেই। কোনো কাজেই না। আমরা শুধু ছুটছি। কিসের নেশায় তা আমরা নিজেরাই জানি না।
খুব ভাল লেখা। কিভাবে ভাল থাকা যায় তা আমরা বেশীর ভাগ সময়ই ভুলে যাই, শুধু ছুটতে থাকি কিসের নেশায় কিসের আশায়…।। আমরা তা নিজেরাই জানিনা, ফলে আর ভাল থাকা হয়ে উঠেনা।
সত্যি সে চমৎকার। মনটা আমার অবেগ উজ্জলতা ভরে উঠলো।
লিখে যা আপু।