এসো অনুকরণ  করি

তামান্না ইসলাম: নব্বই দশকের শুরুর দিকে একবার জাপান গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সে। আমি তখন মাত্র ইউনিভার্সিটি শুরু করেছি। কনফারেন্সটাও তরুণদের জন্য, দক্ষিণ  এশিয়ার দেশগুলোর তরুণদের জন্য আয়োজিত কনফারেন্স। মূলত জাপানী তরুণ সম্প্রদায়ের সাথে  আমন্ত্রিত তরুণ -তরুণীদের  সংস্কৃতি, দেশ, সমাজ, মূল্যবোধ  এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা করাই এই কনফারেন্সের উদ্দেশ্য।

Japan 1কনফারেন্সে অনেক জাপানী ছেলেমেয়ের সাথে পরিচয় হলো। পরিচয় হলো ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশের তরুণতরুণীদের সাথে। ভারতীয়রা এতো ভালো ইংরেজি বলে দেখে খুব অবাক হয়েছি, পোশাক আশাকেও পাশ্চাত্যের ছাপ।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক লেগেছে জাপানীদের মাঝে আমেরিকান ক্রেজ দেখে। জাপানের তরুণ সমাজ তখন আমেরিকা বলতে অজ্ঞান। জাপান কিন্তু তখনই প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গেছে। ঝকঝকে তকতকে সাজানো গুছানো দেশটিকে একটি সমৃদ্ধ, সফল  দেশই বলা যায় নির্দ্বিধায়। কিন্তু তার পরেও তাদের তরুণ তরুণীরা হা করে তাকিয়ে আছে আমেরিকার দিকে। তাদের পোশাক আশাক, ফ্যাশন, সঙ্গীত, হাব-ভাব, খাবার, সব কিছুর অন্ধ অনুকরণ চলছে। আমারও তখন বয়স অল্প, তারপরেও আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কী আছে আমেরিকায়, আমেরিকান কালচারে যে সব কিছু পেয়েও তাদের মতো না হলে চলবে না?

আজ এতো বছর পরে, নিজের দেশের দিকে তাকিয়ে আমি খানিকটা সেই একই বাতাস অনুভব করি, তবে আমাদের অবস্থা আরও অনেক বেশি করুণ। জানি, সংস্কৃতি কোন পাথরে খোদাই করা ধ্রুব সত্য নয়, সময়ের সাথে এর পরিবর্তন হবেই। সেই পরিবর্তনের ধারাতেই বাঙ্গালি মেয়েরা শাড়ি ছেড়ে সালওয়ার কামিজ, তারপরে সালওয়ার কামিজ ছেড়ে প্যান্ট, ফতুয়া পরছে।

ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই পোশাক-আশাকে যে পরিবর্তন এনেছে সেখানে পাশ্চাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। এতে আর কী ক্ষতি? হয়তো খুব ধীরে ধীরে আমরা হারাচ্ছি আমাদের ঐতিহ্য, এই টুকুই। এই পরিবর্তন অনিবার্য।

শুধু পোশাকেই যদি ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলেও কথা ছিল। আধুনিক বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষাটা ও  ঠিকমতো বলতে পারে না। অদ্ভুত এক ইংরেজি উচ্চারণে তারা যেটা বলে সেটাকে ঠিক বাংলা ভাষা বলা যায় না। জানি না, ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোনের যুগে কয়জন তরুণ-তরুণী , শিশু-কিশোর বাংলা বই পড়ে, বাংলা গান শুনে। সারা বছর ইংরেজি গান শুনে, হিন্দি আর ইংরেজি মুভি, সিরিয়াল দেখে শুধু ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি আর পহেলা বৈশাখ পালন করলে তো আর বাঙ্গালি সংস্কৃতির চর্চা হবে না, হারিয়ে যাবে এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি।

IWD 7পোশাক, ভাষা ছাড়াও আরেকটি বড় সাংস্কৃতিক আগ্রাসান ঘটেছে খাওয়া-দাওয়ায়।  শহরগুলো ছেয়ে গেছে বিদেশী অনুকরণে পিজা, বার্গার, শর্মা, পাস্তা, হট ডগে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো “মাছে  ভাতে  বাঙ্গালি” বাক্যটি শুনতে বড় হাস্যকর শুনাবে। এখনকার ছেলেমেয়েরা পিঠা পায়েসের চেয়ে আইসক্রিম, কেকই অনেক বেশি পছন্দ করে।

শুরুতেই বলেছি সংস্কৃতি বহমান, তাই এর পরিবর্তন ঘটবেই। আমরা চাই আর নাই চাই, আজ হোক, কাল হোক সমাজে পরিবর্তন আসবেই, সেই পরিবর্তনগুলো একটু একটু করে আমাদের ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতিকে বদলাবেই।  

আমার শুধু দুঃখ একটা, যেই পাশ্চাত্যর  সংস্কৃতি, যেই আমেরিকান স্বপ্নের পিছনে ছুটছে আজকের বাংলাদেশ, কেন শুধু তাদের চটকদার সহজলভ্য, অদরকারি, মূল্যহীন জিনিসগুলোই আমাদের বেছে নিতে হবে? কেন ভালো দিকগুলো নয়? আমাদের মূল্যবোধ ছিল আমাদের গর্ব। পাশ্চাত্যর তুলনায় আমাদের যদি ভালো কিছু থেকে থাকে সেটা ছিল আমাদের সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধ, বড়দেরকে সম্মান করা, মা-বাবা, আত্মীয় স্বজনকে সম্মান করা, ভালবাসা, তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ, শিক্ষকদের সম্মান করা, দাম্পত্য জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া এইসব।

Pohela 3এসব মূল্যবোধ সমাজের জন্য ভালো না খারাপ সেগুলো নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো বিতর্কের অবকাশও আছে। কেউ যদি যুক্তি দিয়ে, চিন্তা করে নিজের কাছে পরিষ্কার হয় যে কোন মূল্যবোধটা ভালো আর কোনটার প্রয়োজন নেই, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকেই কিছু না ভেবেই শুধু আধুনিক হওয়ার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে ঝেড়ে ফেলে অনেক কিছু।

আর পাশ্চাত্যের কথা যদি বলতেই হয়, এদের অনেক ভালো দিকও আছে, সেগুলো কেন আমাদের চোখে পড়ে না? এখনো দেশে গেলে কেউকে কোন কিছুতেই কোন লাইন বা কিউ মানতে দেখি না। ধাক্কাধাকি করে এ ওর সামনে চলে যাবে গায়ের জোরে বা পয়সার জোরে। রাস্তায় যত্র-তত্র ময়লা ফেলাটা আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার মনে করি। যে ছেলেটা হেডফোন লাগিয়ে ফোনে গান শুনছে, চ্যাট করছে, মাথার চুলে স্পাইকের বাহার সেও হয়তো জনগণের মাঝখানে অবলীলা ক্রমে সিগারেট ধরিয়ে সবার ফুসফুসে ছড়িয়ে দেবে ক্ষতিকর ধোঁয়া। তারপরে রাস্তার উপরেই কিচ্ছু না ভেবে ছুঁড়ে মারবে সিগারেটের প্যাকেট।

child-girl-rapeএতোই যদি আমেরিকাকে অনুকরণ করা তাহলে কেন রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে মেয়েদেরকে দেখে বাজে মন্তব্য করা, অশ্লীল দৃষ্টিতে তাকানো, ভিড়ের মাঝে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া? কেন এখনো রাস্তায় অকারণে হর্ন বাজিয়ে কান ঝালাপালা করা? কেন কারণে অকারণে মাইক বাজানো? আজকাল বিয়ের মৌসুমে পাড়া প্রতিবেশীর সারা রাত ঘুমানোর কোন উপায় নেই, অসুস্থ মানুষেরও না। অন্যের ব্যাপারে নাক গলানো, সে তো আমাদের জন্মগত অধিকার। কার ছেলে ফেল করেছে, বেকার, চাকরি পাচ্ছে না, নেশা করে থেকে শুরু করে কে তার কাজের মেয়েকে বকা দেয় পর্যন্ত সব ব্যাপারেই আমাদের জানতে হবে, উপদেশও দিতে হবে।

কথায় কথায় আইনকে হাতে তুলে নেওয়া, গণপিটুনি, পাবলিক ইমোশনকে খোঁচা দিয়ে কাজে লাগিয়ে ছিঁচকে চুরির অপরাধে ছোট শিশুকে পিটিয়ে মেরে ফেলা এগুলোতেও আমাদের জুড়ি নেই।

কতো আর বলবো? এর শেষ নেই।  শেষ করাটাও জরুরি না, তবে জরুরি হলো নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করা আমেরিকানদের কী কী ভালো দিক আছে, অনুকরণ যদি করতেই হয় শুধু কানে ছয়টা ছিদ্র করে দুল না পরে, সেই সাথে দোকানে, অফিসে লাইন দিয়ে কাজ করাও শিখি।

 

শেয়ার করুন: