হে নারী, তোমার শরীরের নেই কোনো দেশ

কিশোয়ার লায়লা: দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী সহকর্মীদের পোশাক নিয়ে বেশ ক’বার প্রশ্নের মুখে পড়েছি। অমুক কেন এই পোশাকে অফিসে আসে, অমুককে একটু বলো, অফিসের সবার চোখ সমান নয় – একটু মার্জিত পোশাকে অফিসে আসতে।

179215_10150130138436197_2019867_n
কিশোয়ার লায়লা

শুধু পুরুষ সহকর্মী নয় – এক নারী কর্মীর পোশাক নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে অন্য নারী সহকর্মীরাও। আমার কাছে দৃষ্টিকটু শব্দটি আপেক্ষিক। আমার দৃষ্টিতে কোনো পোশাক ভাল না লাগলে যে অন্যের চোখেও সেটি খারাপ, তা না। মনে করি আয়নায় যদি আমাকে ভাল লাগে সেই সাজসজ্জাতেই আমি বের হবো। কারণ প্রতিচ্ছবিই হলো একজন মানুষের প্রথম সমালোচক।

পোশাক নিয়ে কথা শুরু করলেও আমার মূল প্রসঙ্গ একজন নারীর শারীরিক গঠন। উন্নত বিশ্বে উচ্চ মানসম্পন্ন জীবনযাত্রা, সহনশীলতা কিংবা আরো ভালো ভালো বিশেষণে আমরা বিশেষায়িত করতে পারি কানাডাকে। যেখানে নারী স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, চলাফেরায় উদারতা সবই আছে। এমনকি পরিচ্ছদ স্বাধীনতাও শতভাগ।

একসময় দেশে থাকতে জুতোটা বা কানের দুলটা পোশাকের রংয়ের সাথে ম্যাচ করে বাইরে না বেরুলে মনটা খচখচ করতো। আর এখন শরীরে নানা রংয়ের সমাহার নিয়ে বেরুতে গেলে নিজের মনেই বলি, এখানে এসব কারো চোখে পড়বে না। মানে আমি কী পরেছি তা নিয়ে শুধু আয়নাই কথা বলবে। এ নিয়ে কথা বলার জন্য কারো সময়, রুচি বা মানসিকতা কোনটাই নেই।

আসলেই কী পুরোটা সত্য? কাল এখানকার ‘টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস টরন্টো’ দৈনিকে একটি খবরে বেশ ধাক্কা খেলাম। রাজধানীর অটোয়ার একটি নামকরা ব্যায়ামাগার একজন নারী ক্লায়েন্টের পোশাক নিয়ে ব্যাপক আপত্তি জানিয়েছে। সেই নারী এখন ব্যায়ামাগারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থার কাছে লিখিত অভিযোগ করছেন।

jenna-vecchio-featজানা গেছে, জেনা ভেশিয় নামের এই নারীর সুডৌল বক্ষ তাকে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সামনে এনেছে। মোভাতি অ্যাথলেটিক নামক এই ব্যায়ামাগারের অন্য সদস্যরা প্রথমে অভিযোগ করে কর্তৃপক্ষকে এবং পরে সুপারভাইসর ভেশিয়কে তার শরীরের গঠনের সাথে ব্যায়ামের পোশাক অপ্রীতিকর বলে জানায়।

শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ড্রেসকোডও নাকি এই নারী লঙ্ঘন করেছে! ভেশিয় এসব তার ফেইসবুক পেইজে জানিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, সেই ব্যায়ামাগারের ওয়েবসাইটে ব্যায়ামের পোশাক পরিহিত অনেক নারীর ছবি আছে। কিন্তু তাদের স্তনের আকার তুলনামূলক ছোট বলে সেটা আপত্তির মুখে পড়ছে না।

আরো লেখেন, তার পোশাক মোভাতি অ্যাথলেটিকের কাছে কোন ইস্যু নয়, বরং তার শারীরিক গঠন! আর এ কারণেই তিনি মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থার শরণাপন্ন হচ্ছেন।  

সত্যিই মারাত্মক। আর যাই হোক এমন একটি সংবাদ পড়ার মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না।

‘ডোন্ট মাইন্ড’ সমাজ কি তাহলে উঠেই যাচ্ছে? শারীরিক গঠনের কারণে একজন নারী চরম বৈষম্যের শিকার হবে, সেটা অন্তত এই দেশে আমি আশা করিনি। তবে বিশ্বাস করছি, ভেশিয় আইনের আশ্রয় নিলে অবশ্যই জয়ী হবেন। আইন হয়তো ধর্ম বা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির দোহাই দিতে পারবে না। অপেক্ষায় রইলাম।

এই সংবাদ পড়ার পর নিজের একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতাও মনে পড়ে গেলো। গত গ্রীষ্মে বাসার সামনের মাঠে ছেলেকে নিয়ে বল খেলছিলাম। স্কার্ট আর টপস পরা আমি। পুরো শরীর বোরখা আর হিজাবে ঢাকা এক বাঙ্গালী ভাবির ৭/৮ বছরের কন্যা, যে কিনা নিজেও হিজাব পরা, আমার সামনেই মা’কে সরল প্রশ্ন করলো, আন্টি কি মুসলিম? তার মায়ের ‘হ্যাঁ’ জবাবের পর প্রশ্ন, তাহলে আন্টির এই পোশাক কেন? মা কিছুটা বিব্রত হলে আমি আশ্বস্ত করে বলি, আমি রাগ করিনি। কিন্তু আপনার ছোট্ট মেয়েটিকে এমন শিক্ষা দেবেন যেন আগামীতে সে যেকোনো বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারে।

কিশোয়ার লায়লা

সাংবাদিক, টরন্টো  

 

শেয়ার করুন: