নিউইয়র্কের বাসা সমাচার

মনিজা রহমান: মনে খুব কষ্ট নিয়ে আমার দুই বাঙ্গালী প্রতিবেশী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাসা ছাড়ল। এ্যাপার্টমেন্টের এই ভবনে আমরা এখন একা হয়ে গেলাম। ওই পাশের ভবনে আরেকটি বাঙ্গালী পরিবার আছে। পুরো ভবনে মোট ৬০ পরিবারের মধ্যে এখন আমরা দুই ঘর মাত্র বাঙ্গালী।

Monijaদূর থেকে অনেকে ভাবেন, আমি নিজেও এক সময় ভাবতাম, বিদেশে বুঝি সব কিছুই ভালো। আমরা শুধু নিজের দেশের সঙ্গে তুলনা করে এখানকার উন্নত জীবনের নানান দিক তুলে ধরি। ধনী দেশে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্ন পথঘাট,যানজটহীনতা, ছেলেমেয়েদের ভালো লেখাপড়া আর নানাবিধ চাকচিক্যের কথা বলি। মনোরম কোন দৃশ্য কিংবা স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে ছবি তুলে বুঝিয়ে দেই আমরা কত সুখে আছি, কত ভালো আছি, কত আনন্দে আছি !

কিন্তু আসলেই কেমন আছি আমরা ?

মানুষের জীবনে মৌলিক পাঁচটি উপাদান খাদ্য আর বস্ত্রের পরেই যার নাম আসে, সেই বাসস্থানের ক্ষেত্রে এই শহর মানে নিউইয়র্ক বড়ই নির্মম। দিনরাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অর্জিত ডলারের তিনভাগের দুইভাগ চলে যায় বাসা ভাড়া দিতে। তারপরও সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয় কখনও ম্যানেজমেন্ট, কখনও সুপার, কখনও প্রতিবেশী অন্য দেশের ভাড়াটিয়াদের জন্য। কথার কথা না, সত্যি রাতের ঘুম হারাম করে দেয় তারা।

NY 1আমার দুই বাঙ্গালী প্রতিবেশীর লিজ শেষ হয়ে গেছে। বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট আর নতুন করে লিজ নবায়ন করবে না। কারণ করলে তাদের ক্ষতি। ভাড়াটিয়া আইন অনুযায়ী কোন বাসার ভাড়া প্রতি বছরে বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটা নিয়ম অনুসরণ করতে হয। যদি বাসার বর্তমান ভাড়া হয় ১৫০০ ডলার, তবে সেটা এক বছর পরে হবে ১৫৫০ ডলার। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের অর্থের খায়েশ আরো অনেক বেশী। তারা এই বাসা ১৮৫০ থেকে ১৯০০ ডলার ভাড়া দিতে চায়। কিন্তু বর্তমান ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে সেই ভাড়া তারা আইন অনুযায়ী দাবী করতে পারে না। তাই লিজ বাতিল করে দিয়েছে তারা। এখন নতুন ভাড়াটিয়া ওঠাবে। ভাড়া বাড়বে চারশ ডলারের বেশী ! পকেট ভারী হবে তাদের !

চলে যাওয়া দুই পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল আমার। ওনাদের আমার ছোট ছেলের বয়সী একটি সন্তান আছে। কাকতালীয়ভাবে ওরা শহরের আরেক প্রান্তে একই স্কুলের, একই ক্লাশে পড়ত। ছেলেটির নাম মাথিন। আমার ছোট ছেলে সৃজনের একমাত্র বন্ধু হল সে। এক সঙ্গে অন্ধকার থাকতে দুই বন্ধু স্কুলে যেত। আবার একই বাসে বাসায় ফিরতো তিনটার দিকে। ছোট খাট যে কোন প্রয়োজনে মাথিনদের বাসায় ছুটে যেতাম। অনেক সুখ দু:খের আলাপ হত। তুষার পড়ে যখন পুরো শহর ঢেকে যেত, তখন আর কোথাও না হোক, মাথিনদের বাসায় বেড়াতে যেতে পারতাম আমরা।

NY 2মাত্র দুই বছর ছিল ওরা এই বাসায়। এরমধ্যে লিজ বাতিল। একটা মানুষের জীবনে দুই বছরের দৈর্ঘ্য কত বড় ? বলতে বলতেই কেটে যায়। থিতু হতে না হতে আবার পাড়ি জমাতে হয় নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে। এখানে এমনিতে খুব বাধ্য না হলে শুধু শখের কারণে কেউ বাসা পাল্টায় না। আগের চেয়ে ভালো বাসা পেলাম কিংবা অফিসের বা ছেলেমেয়েদের স্কুলের কাছে, বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি এখানে না। এখানে ট্রেন ও বাস সার্ভিস উন্নত হওয়াতে কোথাও যেতে প্রত্যাশিত সময়ের বেশ লাগে না। তাছাড়া, একটি পরিবার যে এলাকায় থাকে, সেখানকার জোন স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাতে হয়। সবই পাবলিক স্কুল। প্রায় একই মানের।

এখানে বাসা পাল্টানোর বড় সমস্যা হল সবকিছু করতে হয় নিজেদের। কোন গৃহকর্মী নেই যে এসে সাহায্য করবে। আত্নীয়-প্রতিবেশীরা প্রত্যেকে থাকে দৌড়ের ওপর। কাউকে বলার সুযোগ নেই। এক বাসা থেকে সব কিছু গুছিয়ে আরেক বাসায় নিয়ে যাবার মতো শারীরিক ও মানসিক খাটুনি খুব কম আছে পৃথিবীতে। আরেকটা সমস্যা হল বাসা পাল্টানোর পাশাপাশি সর্বত্র ঠিকানা পাল্টে যায়। সবাই এখানে বাসার ঠিকানা বা প্রুভ অব এ্যাড্রেস চায়। এটা অনেকটা সেই ব্যাক্তির ডকুমেন্ট হিসেবে কাজ করে। বাসা পরিবর্তনের পরে শুরু হয়, দোরে দোরে গিয়ে নতুন ঠিকানা জানানোর হয়রানি।

এই যে দুই বাঙ্গালী পরিবার চলে গেল, আমরা ছাড়া সেভাবে টেরই বা পেল কে ? কেউ জানতেও চাইলো না, কেন ওরা চলে গেল ? ওদের কি সমস্যা ছিল ? কিছুই না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। হাই-হ্যালো ছাড়া প্রতিবেশী সুলভ কোন আচরণ নেই। এভাবে মাত্র দুই বছরের মাথায় লিজ বাতিল করে, নতুন করে নবায়ন না করার বিরুদ্ধে কেউ এখানে এক জোট হয়ে রুখে দাড়ায় না।

NY 3কিভাবে এক জোট হবে ? কেউ তো কাউকে চেনেই না। আমার বাসার ছয় তলায় এক অশীতিপর বৃদ্ধা থাকেন। ওনার বয়স ৯৩ বছর। কিছুদিন আগে ওনার মেয়ের সঙ্গে এলিভেটরে দেখা। আমাকে দেখে বললেন, ‘‌‌মা গত জানুয়ারিতে বাসায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্য ভালো যে তখন ওনাকে দেখাশুনা করার জন্য যে নার্স থাকেন, ওই সময় উপস্থিত ছিলেন। তৎক্ষনাৎ ওই নার্স ৯১১ এ ফোন করেন। পরে মাস খানেক হাসপাতালে থাকতে হয় মাকে।’

বৃদ্ধা যে এভাবে অজ্ঞান হয়েছেন কিংবা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দীর্ঘদিন, এই খবরটা সম্ভবত পুরো বাড়ীর কেউ জানে না। হয়ত আমিও জানতাম না। হঠাৎ করে সেদিন ওনার মেয়ের কাছে যদি না তার মায়ের খবর জানতে চাইতাম। আমি তাও জানলাম ঘটনার চার মাস পরে। আমার মনে হয় জিজ্ঞাসা করি, আপনার বৃদ্ধা মা এখানে একা থাকে, আপনি কাছে নিয়ে রাখতে পারেন না ? কিন্তু এসব প্রশ্ন এদেশে করা যায় না। ৯৩ বছর বয়সী বৃদ্ধা, ওই ফ্ল্যাটে গত ৬২ বছর ধরে বাস করছেন। এবং তিনি ওই বাসাতেই মারা যাবেন। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই তার !

আমাদের ভবনে এমন অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, যারা এভাবে একা থাকেন। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে রাষ্ট্র তাদের জন্য বাসা ভাড়া খুব কম ধার্য করেছে। বাসায় নিয়মিত নার্স-সোশ্যাল ওয়ার্কার আসে। কিন্তু শরীরের সুস্থতার চেয়েও তো বড় সুস্থতা দরকার মনের। সেটা কি তারা পান ? ওই বৃদ্ধার তবু তো একজন মেয়ে আছে। নিউইয়র্ক সিটির বাইরে থেকে মাসে দুই বার মাকে দেখতে আসেন। ফোনে খোঁজ খবর নেন। অনেকের তো তাও থাকে না।

যেমন আমার আমার ফ্ল্যাটের ডান দিকের প্রতিবেশী বয়স্ক ভদ্রলোক। ৬০/৭০ বছর হবে বয়স। স্ত্রী মারা যাবার পরে একাই থাকেন। আমরা দুই বছর ধরে আছি পাশাপাশি। আজ পর্যন্ত কাউকে দেখলাম না তার বাড়ীতে বেড়াতে আসতে। ক্রিসমাস, ইস্টারসানডের দিনেও তার পরনে সাদাসিধে প্রতিদিনের পোষাক। পুরো একটা দিন লোকটা হয়ত কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান না। এভাবে কথা না বলতে বলতে উনি এখন মানুষ এড়িয়ে চলেন। এই বৃদ্ধ শরীরেও এলিভেটর ব্যবহার করেন না। সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা-নামা করেন। হয়ত মনে মনে ভাবেন, তার তোবড়ানো মুখ, মলিন জীর্ণ পোষাক দেখে কেউ যদি নাক সিটকায়, কিংবা অবজ্ঞার চোখে তাকায় ! আমরা মাঝে মাঝে গুড মর্নিং বা হাই বললে বুড়োর সেই তোবড়ানো গালে হাজার আলো আতশবাজি জ্বলতে থাকে। হয়ত পুরো দিনে এই একবারই কেউ তাকে গুডমর্নিং বলল। এভাবে শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে আছেন যেন মানুষটি।

কল্পনা করতে পারেন, আমরা চারশ স্কোয়ার ফিটের যে ফ্ল্যাটে থাকি, তার ভাড়া ১৬৫০ ডলার ! আমরা উঠে গেলে তার ভাড়া হবে ১৮৯৫ ডলার ! মানে প্রায় ১৯০০ ডলার। বিল আছে তার বাইরে। তাহলে একটু চিন্তা করে দেখেন, কোন পরিবারের এই শহরে থাকতে হলে কত ডলার ব্যায় করতে হচ্ছে বাসা ভাড়ার পিছনে ? আয়ের প্রায় সিংহভাগই কি নয় ?

এজন্য অনেকে সাবলেট থাকেন কিংবা সাবলেট দেন।

মাত্র চারশ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট, একটা বাথরুম, একটা কিচেন- সেখানে থাকছে দুটি পরিবার ! কেমন মানবেতর জীবন যাপন- ভাবা যায় ! এইভাবে সাবলেট থাকা পরিবারটি হয়ত দেড় থেকে দুই হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে থাকতো বাংলাদেশে। তিনটা বেডরুম, তিনটা বাথরুম, বিশাল ড্রইংরুম, ডাইনিং কাম লিভিং, বিশাল কিচেন, সার্ভেন্টস কোয়ার্টার….। একটা লিভিংয়ের সমানই হয়ত এখানে পুরো বাসা। পাখীর খাঁচার মতো জীবনে দমবদ্ধ ছটফট করে মরা। তারপর সাবলেট কেন দেয়া হল ? এনিয়ে ম্যানেজমেন্ট, সুপারের চোখ রাঙ্গানি তো থাকেই।

ঢাকার ফ্ল্যাটবাড়ীতে ম্যানেজমেন্ট বলতে ফ্ল্যাট মালিকদের একটা সমিতি বোঝায়। তাদের একজন কেয়ারটেকার থাকেন। সার্ভিস চার্জ তোলা ছাড়া তাদের কোন কাজ নেই। সেখানে আবার মালিক ও ভাড়াটিয়ারা যৌথভাবে এপার্টমেন্টের হলরুমে নানা প্রোগাম করে। পয়লা বৈশাখ, ঈদ পুনর্মিলনীতে বিরাট আয়োজন থাকে। এখানে সেইসব চিন্তা করা স্বপ্নের চেয়েও অধিক কিছু।

স্বপ্নের দেশে যাবার আগে কত কল্পনা ভাসে মানুষের মনে। ইংরেজী ছায়াছবির মতো বিশাল লনঅলা বাড়ী থাকবে। পিছনে সুইমিং পুল। বিরাট বাগান। ছবির মতো সুন্দর সবকিছু। বাস্তবতা হল তার পুরো বিপরীত। দেড়শ বছরের পুরনো ভবন। সেখানে খোপের মতো দুটি ঘর। ছোট্ট শিশু একটা দৌড় দিলে, নীচের তলার প্রতিবেশী ফোন করেন সুপারকে, সুপার ফোন দেন ম্যানেজমেন্টকে, তারপর আসে নোটিশ ! তবে কুকুর থাকলে সমস্যা নেই। কারণ ওরা দৌড়ালে আওয়াজ হয় না। আর তাছাড়া, প্রাণীদের বিরুদ্ধে কথা বলাটা সভ্যতার পর্যায়ে পড়ে না ! আশেপাশের ফ্ল্যাটে তাই কোন শিশুর মুখ দেখি না, শুধু দরজার ওপাশে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শুনি। আসলে এই শহর শিশু বান্ধব নয়। ছোট শিশু নিয়ে ভাড়া চাইতে গেলে ম্যানেজমেন্টের কপালে চওড়া ভাজ পড়ে।

মাথিনের মা কাল রাতে ফোন করেছিলেন। বিষন্ন কণ্ঠে বললেন, মাথিন দিনে কত বার যে সৃজনের নাম বলছে, হিসাব নাই। সে এখনও পুরনো বাসাকেই বলে তাদের হোম। বাসা পরিবর্তনকে কোনভাবে সে মেনে নিতে পারছে না। সারাদিন কান্নাকাটি করে আগের বাসায় ফেরার জন্য। স্পেশাল নিডস আছে এরকম যে কোন শিশু, পরিবর্তনকে সহজে নিতে পারে না, কিন্তু সেই সব বোঝার কি সময় আছে কারো ? একটা শিশুর মন, একটা মায়ের মন বোঝার কি দায় এই সব ম্যানেজমেন্টের।

 

শেয়ার করুন:

আমরা সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ধাবাহিকতাময় দেশে বড় হওয়া মানুষ। আমাদের জন্য শুধুই উন্নত দেশ আর পরিবেশ যথেষ্ট নয়….আমাদের চাই….অখন্ডঅবসরময় চায়ের আড্ডা….উন্মাতাল শাহবাগ….টিএসসির অবসরময় রোমান্টিকতা….
এই লেখার বাস্তবতা সে কথারই প্রমাণ দেয়

আপনার নিউ ইয়ররক এ বাসা ছোট বলে প্রবলেন হলে অন্য স্টেটে যান, বা এই স্টেট এর কোন ছোট শহরে যান। সমস্যা কি? বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাবার সাহস করেছেন, নিউ ইয়ুরক ছারার আর কত কঠিন।

এটাই বাস্তব। উপর থেকে দেখা মানে –ওপাড়েতে যত সুখ আমার বিশবাস–এর মত।আমরা যে সময়ের গতিতে চলেছি তার পরিনতি এই ভাবেই দেখতে পাবো–সাধারণ ভাবে।যাকে বলে– সোনার হরিণ।কবির ভাষায় ” ধ্রা সে যে দেয় না”র মতো।

Sure. NY is expensive, but there’s a reason behind that. It’s where all the investment bankers, management consultants live who are pulling in $120- $250K a year. Majority of the bengalis that live in NYC make max $50-60K, if that. So a better alternative is living a bit outside of NYC. They still provide good education for kids, cleaner roads and all other benefits, but at a cheaper price.