তাসলিমা আক্তার: আমার জন্ম এবং বড় হয়ে উঠা সবই ঢাকায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বলার অপেক্ষা রাখেনা, আমি ছিলাম আম্মার একেবারে ন্যাওটা। ছেলেবেলায় ঘন ঘন গ্রামের বাড়ি যাওয়া হত। গ্রামের নাম চান্দেরকান্দি। এখনকার মত এত মানুষ না থাকলেও গ্রামে তখনও মানুষের কমতি ছিলনা। অন্য সকলের মাঝে আমার একজন বিশেষ মানুষ ছিল, তার নাম সুফিয়া আপা।
সুফিয়া আপা সম্পর্কে আমার বোন, বয়সে আম্মার সমান। আমি তখন ক্লাস ওয়ান কি টুতে পড়ি। গ্রামে আম্মা অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। আমরা গিয়েছি শুনলেই গাঁয়ের সকলে ছুটে আসত দেখা করতে। কিছু আগে অথবা পরে সুফিয়া আপা আসতো। এসেই এদিক সেদিক তাকিয়ে আমাকে খুঁজত। খুঁজে পেলে দুহাত বাড়িয়ে দিত আর আমি দিতাম ঝাঁপ।
সুফিয়া আপা জিনের আছরগ্রস্থ মানুষ। জীবন ছিল তার রং বাহারী। চেহারার সাথে নায়িকা ববিতার আদলের খানিক মিল ছিল। ছিপছিপে গড়নের শরীর, চামড়ার রং উজ্জ্বল শ্যাম। যুবতী বয়সে তার একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সে বিয়ে টেকেনি। সংসারের কাজে কামে মন নাই। উড়াল বিড়াল স্বভাব। তার উপরে বাঁজা মেয়েমানুষ! বিয়ে টিকে থাকার কথা না। সুফিয়া আপা আবার তার বাপের বাড়ি ফিরে আসে। একসময় পাট গাইতে যাত্রায় নাম লেখায়। সেখানেও মন লাগে না, সন্দেহ করি। ফিরে আসেন আবার চান্দেরকান্দি গ্রামে। রাত বিরাতে ঘর থেকে বের হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত। কোনোদিন সকালবেলা হয়তো অচেতন অবস্থায় পাওয়া যেত কবরখানার পাশে।
তখন ঠিক দুপুরবেলা। সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে এক কথা, সুফিয়ার আবার জিনের আছর উঠছে। সকলের সাথে সাথে আমিও দৌড়ুই। চান্দেরকান্দি গ্রাম থেকে রেল লাইনে উঠার জন্য অনেক দূর মাটির পায়ে চলা পথ পার হতে হয়। পথ বিরান। কয়েকটা তেঁতুল গাছ আর শিমুল গাছ দাঁড়িয়ে আছে মাঝে মধ্যে। গ্রামের মানুষ শিমুল গাছ বলে না, বলে তুলা গাছ। তুলা গাছে ডাল কম। আমি দেখলাম, এত উঁচু গাছের একটা ডালে উঠে সুফিয়া আপা হাত-পা ছুঁড়ে গান গাইছে। হলুদ শাড়ির আঁচলটা প্যাঁচ দিয়ে কোমরের কাছে গোঁজা। আমি তাজ্জব হয়ে জিনগ্রস্থ মানুষ দেখি।
গ্রামের লোকে ট্যারা চোখে দেখতো, কিন্তু আম্মা তাকে কখনো দূরে ঠেলে দিত না। বাচ্চাদের প্রতি তার ছিল অনেক ভালোবাসা। হলে হবে কি, গ্রামের কেউ নিজেদের বাচ্চাদেরকে তার সাথে মিশতে দিত না। অথচ আম্মা আমাকে এতোটাই অবলীলায় তার কাছে যেতে দিত, আমি সুফিয়া আপার এসব ইতিহাস জেনেছিলাম অনেক বড় হয়ে।
ছোটবেলায় আমি অন্য বাচ্চাদের চেয়ে একটু বেশী আদর পেতাম আমার কিছু গুণাবলীর জন্য, তার একটি হলো আমি গান গাইতে জানতাম। নতুন কাউকে পেলেই আম্মা সোনামুখ করে আমার গুণের কথা জানান দিত। আমি বাধ্য হতাম গান শুরু করতে।
সুফিয়া আপাও গানের মানুষ। আপা আমাকে নিয়ে গ্রামের দূর দুর চলে যেত। কখনো আলপথ ধরে, কখনো খাল বিলের পাড় ধরে শুকনো মাটির উপরে হেঁটে হেঁটে। গ্রামে তখন এতো দোকানপাট ছিল না। ছাড়া ছাড়া একটা কি দুইটা থাকতো। চিনির এক ধরনের মিশ্রী পাওয়া যেত সেসময়। আপা আমাকে হাতভর্তি করে মিশ্রী কিনে দিত আর আমি হাতের চেটোয় রেখে খেতাম। আমরা দুজন যখন খুব নির্জনে, তখন আপা আমাকে “মায়ো” বলে ডাকতো। এই ডাকের অর্থ “মা”।
সুফিয়া আপাদের বাড়ির সবাই আমাকে বিশেষ ভালোবাসতো। বলা যায় ওটা ছিলো আমার ভালোবাসা বাড়ি। তার বড় ভাইয়ের নাম আনোয়ার। সবে আবুধাবি থেকে ফিরেছেন। ফেরার সময় সাথে করে এনেছিলেন চার ব্যাটারির টেপ রেকর্ডার। রেকর্ডারে আমার গান রেকর্ড করা থাকত। আমি গ্রাম থেকে চলে আসলে সুফিয়া আপা আমার রেকর্ড করা গান শুনতো। আনোয়ার ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সন্ধ্যার পরে গ্রামের বৌ-ঝিয়েরা আনোয়ার ভাইয়ের বাড়িতে শুনতে আসতো দুর্বার সংগীত। উঠানে মাদুর পেতে বসার ব্যাবস্থা। আর আমার বসার জায়গা সুফিয়া আপার কোলে।
তখনো গ্রাম এত ঘিঞ্জি হয়ে উঠেনি। অনেক পতিত জমি। আমরা সেখানে খেলা করতাম। একদিন সকাল বেলা আমি পতিত জমিতে অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছি। পাশ দিয়ে আনোয়ার ভাই যাচ্ছিলেন গঞ্জে। আমাকে দেখে তিনি বললেন, চল তোমারে গঞ্জে নিয়া যাই। আগুপিছু কিছু না ভেবেই আমি সাথে চললাম। গঞ্জের চালকলে চাল ছাঁটাতে দিলেন। ভূমি রেজিস্টার অফিসে গেলেন।
সবশেষে আমাকে নিয়ে গেলেন পঁচা ময়রার দোকানে। এই বড় বড় মিস্টি! এক মিস্টি খেতে চার মানুষ লাগে। ফেরার পথে এক পাতিল মিস্টি কিনে আমায় দিয়ে বললেন, “এই মিস্টি চাচীর লাইগ্যা”। বেলা তখন দুপুর। এতোক্ষণ আমাকে না পেয়ে বাড়িতে মরাকান্না শুরু হয়ে গেছে। যখন ফিরলাম আনোয়ার ভাই কটাক্ষের জলে ডুবতে আর আমি আদরের সাগরে ভাসতে থাকলাম। আমি আম্মার কোলে। সুফিয়া আপার করমচার মতো ফুলে উঠা লাল চোখ। চিলের মত ছোঁ মেরে আম্মার কোল থেকে আমাকে নিয়ে আপা চলে গেল পুকুর পাড়ে।
আপা আমাকে গান শেখাতো। দেহতত্বের বিষয়ে আমার হাতেখড়ি সুফিয়া আপার কাছে। যাত্রার গান। সতের আঠার অন্তরার বিশাল বিশাল গান। আমি মুখরা আর পাঁচ অন্তরা শিখেছিলাম। অদ্ভুতসব কথামালায় সাজানো গানের লাইন। সবচেয়ে পরিশীলিত একটা অন্তরা এরকম,
বালতি ভরা পানি আছে বন্ধু
পাও দুখানা ধোও
বুকের সাথে বুক মিশাইয়া বন্ধু
এক বিছানায় শোও
শেখার আনন্দে ছলছল করতে করতে আমি সেই গান যেইনা আম্মাকে শোনালাম, আম্মা বললো, “সুফিয়ার সাথে তোমার মেলামেশা বন্ধ”। নিষেধের প্রতি টান সকলের মতো আমারও কম না। আমি গোপনে তার সাথে মিশতে থাকলাম। আপা যখন আমাকে বুকে টেনে নিত, তার আঁচলের গন্ধের সাথে আম্মার গায়ের গন্ধের মিল খুঁজে পেতাম খানিকটা।
আমি বড় হতে লাগলাম আর ধীরে ধীরে গ্রামের বাড়ির সাথে আমাদের সম্পর্ক দূর হতে লাগল। মানুষগুলো অচেনা হতে থাকে। স্মৃতিরা আবছা হয়। শুধু ভালোবাসাটা বুকের কোথাও খুটা গেড়ে বসে থাকে। বড় হয়েও সুফিয়া আপার কথা আমার প্রায়ই মনে হত। আম্মা কিংবা বড় আপাদের কাছে তার জীবনের না জানা অনেক কথা শুনতাম। আবার গোপন কৌটায় ভালোবাসাটা খিল দিয়ে রেখে দিতাম।
প্রায় পনের বছর পর দু’চার বছর আগে একবার গ্রামে গিয়েছিলাম। স্মৃতির কাছে ঠিকঠাক ফিরবো বলে ট্রেনেই চেপে গেলাম। ট্রেনের দরজা পেরোতেই বুঝলাম কিছু আর আগের মত নেই। মানুষে গিজগিজে গ্রাম। প্রায় কাউকেই চিনি না। এখানে সেখানে পাকা দালান। আমি সুফিয়া আপার বাড়িতে যাই। কাউকে পাই না। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম তার কথা। এক একজন একেক রকম উত্তর দেয়। একজন জানালো,
-’শেষ বইস্যে সুফিয়া ফুফু বদ্ধ পাগল অইয়া গেছিল্। আতকা আতকা কই জানি যাইতগা। কবে যে শেষবার বাড়ি ছাইরা গেছিল্ বছর গইন্যা কইতাত্তামনা। পরেদা হুনছিলাম, মেতিকান্দা ইস্টিশনের কাছে রেলে কাডা পরছিল্ এক পাগল বেডি। মুখটা চিনা গেছেনা-অক্করে থেত্লাইয়া গেছিল্গা। গতরের কাপড় দেইক্যা আমার পুতে কইছিল্-এইডা দাদীর কাপড়’।
পুনশ্চঃ উইমেন চ্যাপ্টার ইতিবাচক লেখা খুঁজছে। লেখাটা ইতিবাচক কিছু হলো না হয়তো সেই অর্থে। আমি অন্যরকম একজন মানুষের ভালোবাসার কথা লিখতে চেয়েছিলাম, জীবন যার অনুকূলে ছিল না। অপ্রকৃতিস্থ একজন মানুষ, যার বুকের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকতো একজন মা আর আমাকে পেলেই লাফিয়ে বের হয়ে আসত। ভালোবাসা কখনো নেতিবাচক হয় না। যে ভালোবাসার কথা লিখতে চেয়েছি তার নাম, অপত্য। যে ভালোবাসার কথা মনে হলে মনের ঘরে আমার মন পোড়ে।
অন্য আরেক তাসলিমার লেখা মনে পড়ে গেল। খুব আপন লাগলো লেখাটা আপা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর ভাষা মনে হলো..
এরকম কিংবা এরচেয়ে গা ছম ছম করা জ্বীনে ধরার গল্প আমিও ছোটবেলায় গ্রামে শুনেছি। কিন্তু স্বচক্ষে দেখা হয়নি কখনো।
চমৎকার লিখেছেন। ভালো লেগেছে অনেক।
আপনি এতো ভালো লেখেন কোনো ?
Feeling emotional.
Apa lekhati ektu betikhor tai beshi vhalo laglo, abar onek kosto moner vitor bar bar uki dissilo. asholei vhalo-basha kokhono neti-bachok hoy na. apni onek vhalo thakben kemon ?